ঢাকা : সময়টা ১৯৭১। ভয়াল ২৫ মার্চের পর সারা ঢাকা শহরে কারফিউ। তরুণদের থাকতে হচ্ছে পালিয়ে পালিয়ে। এ অত্যচারে মাহবুব নামের সদ্য কৈশোর পেরোনো ডানপিটে এক তরুণ ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে। বন্ধুদের সাথে মিলে সে সিদ্ধান্ত নিলো – এভাবে নয়, মরলে যুদ্ধ করেই মরবে। ভারতে গিয়ে ট্রেনিং নেবে বলে ঠিক করলো সবাই। যুদ্ধ করবে তারা দেশের জন্য।
ছোটবেলা থেকেই ভীষণ সাহসী আমাদের মাহবুব। মাত্র সতেরো বছর বয়সে ‘ক্রান্তি’ শিল্পীগোষ্ঠীর হয়ে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গান গেয়েছে সে নির্ভয়ে। এর পরিণামে পুলিশের তাড়াও খেয়েছে। তারপরও পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গান করা থামেনি। গোটা বিশ্বজুড়েই সত্তরের দশক ছিলো খুব উত্তাল এক সময়। চারদিকে শেকল ভাঙার উল্লাস। সে উচ্ছ্বাস থেকে বাংলাদেশে জন্ম নিলো পপ গান। রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে, পুরাতনের বিরুদ্ধে এ যেন এক বিপ্লব! আর সে বিপ্লবের নেতা আমাদের মাহবুব। ইতিহাস অবশ্য পিতৃপ্রদত্ত মাহবুব নামে তাকে মনে রাখেনি। মহাকালের কাছে তিনি আজম খান – বাংলা পপ সঙ্গীতের গুরু আজম খান। তবে সে সময়টা এখনো কিছুটা দূরে। ফিরে আসি যুদ্ধের গল্পে।
মাকে গিয়ে ছেলে বলে, “মা, যুদ্ধে যেতে চাই।” মা বললেন, “ঠিক আছে, তোর বাবাকে বল।” বাবা আফতাব উদ্দীন খান প্রশাসনিক কর্মকর্তা। ভয়ংকর গম্ভীর এ মানুষটার সামনে কাঁপতে কাঁপতে গেলো মাহবুব। মাথা নিচু করে বললো, “আমি যুদ্ধে যাচ্ছি।” প্রমাদ গুণলো, এই বুঝি বাবা রেগে যাবেন। কিন্তু মানুষের অবাক করে দেবার ক্ষমতা যে অসীম! বাবা বলে উঠলেন, “ঠিক আছে, যুদ্ধে যাইবা ভালো কথা। দেশ স্বাধীন না কইরা ঘরে ফিরতে পারবা না।”
এবারের দৃশ্যপট মেলাঘর। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প সেখানে। টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে সেন্ট্রি ডিউটি করতে থাকা কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সামনে মঞ্চস্থ হচ্ছে অদ্ভুত মায়াবী এক দৃশ্য। টিলার নিচে একটা তাঁবুতে আলো জ্বলছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর:
হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ
কেঁপে কেঁপে ওঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে,
সে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ।
…………………………
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী
অবাক তাকিয়ে রয়ঃ
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।
সেন্ট্রিরা বুঝলেন মাহবুব গাইছে৷ মাহবুবের গানের গলা চমৎকার। অন্যদিকে ভীষণ সাহসী এক গেরিলা সে। তাকে ভেবেই যেন বিদ্রোহী কবি লিখেছেন – “… মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য …।”
চারদিক ভীষণ অন্ধকার। অন্য সব তাঁবুর সবাই বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। ন’টা-দশটাতেই মনে হচ্ছে নিশুতি রাত। ঐ একটা তাঁবুর ভেতর হারিকেনের আলো ছড়িয়ে সাদা রঙের পুরো তাঁবু জ্বলছে ফসফরাসের মতো উজ্জ্বল হয়ে। দেখে মনে হচ্ছে বিশাল অন্ধকার সমুদ্রে যেন একটা আলোকিত জাহাজ আর অলৌকিক সে জাহাজ থেকে সুর যেন ইথারে ভেসে হাজার হাজার মাইল ছড়িয়ে পড়ছে।
মুক্তিসেনাদের গা কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আজম খানকে নিজ হাতে এলএমজি চালাতে শেখানো শহিদ রুমি এমন করেই মা জাহানারা ইমামকে বলেছেন বন্ধুর কথা। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বইয়ে যা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।
যুদ্ধক্ষেত্রেও গান গাইতে গাইতে লড়াই করে মাহবুব। সহযোদ্ধারা নিষেধ করে গান গাইতে, শত্রু সেনারা অবস্থান টের পেয়ে যাবে এ আশংকায়। কিন্তু কে শোনে কার কথা। তার কাছে অম্লযানের খুব পৃথক কিছু তো নয় গান। সহযোদ্ধারা মরণের ভয় দেখায় তাঁকে। বলে, “ওই! গান থামা। পাক সেনারা শুনলে বুইঝা যাইবো তুই কোথায়। তোর মরণের ভয় নাই নাকি?” মুচকি হাসে মাহবুব। বলে, “আরে, মরবোইতো একদিন। ভয় পাওয়ার কী আছে? গান গাইয়া লই।”
সেকশন কমান্ডার হিসাবে ঢাকা ও এর আশপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেয় মাহবুব। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলো তাঁর নেতৃত্বে সংঘটিত অপারেশন তিতাস। মুক্তিযুদ্ধে সর্বশেষ মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে সংঘটিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করে সে। ঢাকায় অভিযান চালাতে গিয়ে বাম কানে আঘাত পায় মাহবুব। পরবর্তীতে এ আঘাত ভুগিয়েছিলো তাঁকে।
এক কানে কম শুনেই মাহবুব যুদ্ধের পর জয় করে মানুষের মন। এক আজম খান হিসাবে সে বদলে দেয় পুরো বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গন।
আমাদের আজম খান
সত্তরের প্রথমার্ধে বংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় তাঁর প্রথম কনসার্ট। ভিন্নধর্মী পরিবেশনার কারণে তরুণদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৭২ সালে বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেককে ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকাল করে আজম খান পারফর্ম করা শুরু করেন। ঐ বছরই “এত সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে” আর “চার কালেমা সাক্ষী দেবে” গান দুইটি সরাসরি প্রচারিত হয় বিটিভিতে। গানগুলোর মাধ্যমে ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় উচ্চারণ ব্যান্ড।
১৯৭৪-১৯৭৫ সালের দিকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে “রেললাইনের ওই বস্তিতে” শিরোনামে গান গেয়ে আজম খান হইচই ফেলে দেন। তাঁর অন্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে “আমি যারে চাইরে”, “ওরে সালেকা, ওরে মালেকা”, “আলাল ও দুলাল”, “একসিডেন্ট”, “অনামিকা”, “অভিমানী”, “আসি আসি বলে”, “হাইকোর্টের মাজারে”, “পাপড়ি”, “বাধা দিও না”, “যে মেয়ে চোখে দেখে না” ইত্যাদি। শুধু সংগীতে নয়, মিডিয়ার অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর বিচরণ ছিলো সাবলীল।
আরেকটি পরিচয়ে তাঁর বেশ সুনাম। ক্রিকেটার হিসেবে। গোপীবাগ ফ্রেন্ডস ক্লাবের হয়ে প্রথম বিভাগে ক্রিকেটে ওপেনার হিসেবে খেলতেন আজম খান।
সব মিলিয়ে ১৭টিরও বেশি হিট গানের অ্যালবাম বের করেছিলেন আজম খান। বাজারে কয়েক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত কপিরাইটের কারচুপির কারণে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না এ শিল্পী৷
শেষ পর্যন্ত টাকার অভাবেই সিঙ্গাপুরে ক্যান্সারের চিকিৎসা করানো তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এ দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে লড়াই করে ২০১১ সালের ৫ জুন সেই চির তরুণের মৃত্যু হয়।
এত সব কথা বলার কারণ, অনেক অভিমান নিয়ে বিদায় নেয়া মাহবুব নামের এ মানুষটার জন্মদিন আজকে। শুভ জন্মদিন, পপ গানের মুকুটবিহীন সম্রাট! শুভ জন্মদিন, গুরু! গুরু, তোমায় সালাম!
সোনালীনিউজ/এমটিআই