ঢাকা : স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে পাশ্চাত্য সংগীতের সঙ্গে দেশজ সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়ে বাংলা পপ গানের বিকাশ করেছেন যিনি, তিনি একাত্তরের কণ্ঠযোদ্ধা, কিংবদন্তী গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীর।
তিনি শুক্রবার (২৩ জুলাই) রাত ১০টা ৫৬ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর সময়ে তার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে সর্বস্তরের মানুষের ভেতরে । তার বিয়োগান্তে নীল-সাদার পৃষ্ঠায় নেটাগরিক তারকা থেকে শুরু করে সাধারণরাও শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে-
গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীরের প্রয়াণে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা লিখেছেন-
‘প্রখ্যাত গণসংগীতশিল্পী, বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলা একাডেমির ফেলো ফকির আলমগীর ২৩ জুলাই ২০২১ রাতে প্রয়াত হয়েছেন। ফকির আলমগীর বাংলা গণসংগীতের সংগ্রামী ধারায় এক বলিষ্ঠ ও ব্যতিক্রমী নাম। শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের মুক্তির আশা তার গানে সুরেলা ভাষা পেয়েছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই গুণী শিল্পী বাংলাদেশের মহান মু্ক্তিযুদ্ধেও রেখেছেন অসামান্য অবদান। তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীতে গণসংগীতের ইতিহাস সুচারুরূপে বিধৃত হয়েছে।
ফকির আলমগীরের প্রয়াণে বাংলা একাডেমি হারাল এক প্রিয় সুহৃদকে, বাংলাদেশ হারাল অন্যতম এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। আমরা তার আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জ্ঞাপন করছি আন্তরিক সমবেদনা।
ফকির আলমগীরের মৃত্যুতে হানিফ সংকেত লিখেছেন অকস্মাৎ মৃত্যুর সংবাদে স্বজন হারানোর কষ্ট অনুভব করছি। তিনি লিখেছেন-
‘চলে গেলেন গণমানুষের শিল্পী ফকির আলমগীর। মানবিক গুণাবলিতে মহান এই শিল্পীর অকস্মাৎ মৃত্যু সংবাদে স্বজন হারানোর কষ্ট অনুভব করছি। সম্প্রতি তার অসুস্থতার খবরে বেশ শংকিত হয়ে পড়েছিলাম। নিয়মিত খোঁজখবরও রাখছিলাম। দু’দিন আগেও ভাবীর সঙ্গে কথা হয়েছিলো, বলেছিলেন-‘এখন কিছুটা স্ট্যাবল, দোয়া করেন।’ কিছুটা আশার আলো দেখেছিলাম কিন্তু না প্রাণঘাতী করোনার কাছে পরাজিত হয়ে অবশেষে শুক্রবার রাত ১০টা ৫৬ মিনিটে চিরবিদায় নিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারের এই শব্দসৈনিক-বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ফকির আলমগীর। বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে পাশে থেকে তিনি যেমন মানুষকে উজ্জীবিত করেছেন, তেমনি শিল্পীদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন কর্মসূচীতেও তিনি সবসময় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সবসময় তিনি সবার সুখে দুঃখে পাশে থেকেছেন। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার অনেক আড্ডার-অনেক গল্পের-অনেক স্মৃতি। মনে পড়ে আমার অনেক অনুষ্ঠানে উপস্থিতির স্মৃতিময় সময়গুলোর কথা।
আমি তার মাগফেরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।’
বাংলাদেশের বিতর্কিত সাহিত্যিক ও চিকিৎসক তসলিমা নাসরিন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেখেন-
‘ফকির আলমগীর নেই, কোভিড তাকেও নিয়ে গেল! এমন প্রাণচঞ্চল মানুষ সংসারে খুব একটা মেলে না। যখনই দেখেছি তাকে, অনর্গল কথা বলতে দেখেছি, প্রাণ খুলে হাসতে দেখেছি, নতুন গান নিয়ে মগ্ন হয়ে যেতে দেখেছি। বয়স তাঁর হয়েছিল, কিন্তু রয়ে গিয়েছলেন শিশুর মতো; সরল, সহজ, এবং দুরন্ত। গাইবার জন্য গান খুঁজতেন, নতুন গান। আমাকেও বলেছিলেন গান লিখতে।
সাতাশ বছর প্রিয় প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য পাওয়া থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে দেশের শাসকেরা। দূর থেকে প্রিয়দের মৃত্যুর খবর ভেসে এলে বুকের ভেতরে হাহাকারের শব্দ শুনি।
দুঃখী দরিদ্রদের নিয়ে গান বেঁধেছেন চিরকাল। শ্রমজীবী মানুষের জন্য উদাত্তকণ্ঠে গণসংগীত গেয়েছেন। মানুষটিকে লাল সালাম। ছবিটিতে ফকির আলমগীর আর আমার মাঝখানে বসে আছেন ডাক্তার রশীদ, একজন সিনিয়র বন্ধু ডাক্তার। ছবিটি আমার শান্তিনগরের বাড়িতে।’
কবি ও কথাসাহিত্যিক লিখেছে সানাউল্লাহ সাগর ‘বিদায় কিংবদন্তি’ শিরোনামে লিখেছেন-
‘৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থান, ’৭১–এর মুক্তিযুদ্ধ ও ৯০–এর সামরিক শাসনবিরোধী গণ–আন্দোলনে তিনি শামিল হয়েছিলেন তাঁর গান দিয়ে। গান গাওয়ার পাশাপাশি বাঁশীবাদক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল।
আর হৃদ্যতার কথা কি বলবো! আমার মতো অজপাড়ার একটা ছেলেকে প্রথম সাক্ষাতে কেবল বিনয় ও হৃদ্যতা দিয়ে তিনি জয় করে নেন! ৭ বছর যতবার যত অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে,কথা হয়েছে।ছবি তুলেছেন স্বানন্দে,সময় দিয়ে। কখনো ব্যস্ততা দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে যাননি! বরং নিজ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কতো তথ্য জেনে নিতেন,পরামর্শ দিতে...
হ্যাঁ, আমি গণসংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর ভাইর কথা বলছি। তিনি আর নেই। করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।’
বদরুজ্জামান চৌধুরী নামক এক গানের শ্রোতা নীল-সাদার দুনিয়ায় লিখেছেন-
‘ফকির আলমগীর সাহেব ছিলেন একজন যুগের চারণ কবি তুল্য গণসংগীত শিল্পী, গণমানুষের শিল্পী। এদেশের ইতিহাসের অনেক ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গে শিল্পী ছিলেন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
গেয়ে গেছেন গণমানুষের মুক্তির গান। তার গান গুলো অনাগত সুদূর আগামীর কালজয়ী চেতনার অগ্নিমশাল হয়ে চির ভাস্বর হয়ে রইবে। আমার প্রথম যৌবনের গোপন প্রিয়ার মতো ভালো লাগার, ভালোবাসার অনুষঙ্গ ছিল তার উদ্দীপনা দীপ্ত গানগুলো ।
ফকির আলমগীর এক আমর, অব্যয় ইতিহাস। এদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের ইতিহাস রচনা করতে গেলে তাঁর নাম উচ্চারিত হতে হবে- অবশ্যম্ভাবী কারণেই । স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তাঁরা পাঁচ জন গানের জগতে যে অদ্ভুত সুন্দর জাগরণী জোয়ার তৈরি করেছিলেন- তা এদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে।
গানের কথায়, সুরে, যন্ত্র সঙ্গীতের সুর মূর্ছনায় তারা একটি সঙ্গীতের বিপ্লব ঘটিয়েছেন রীতিমতো। সেই সময়ের ‘পপ সঙ্গীতের’ ধারাবাহিকতার পথ ধরে ই পরবর্তী কালে এদেশে সূচিত হয়েছিল ব্যান্ড সঙ্গীতের বিপ্লব-- তা বহুকাল ধরে এদেশের তরুণ তরুণীদের হার্টথ্রোব পরিণত হয়ে গেছে!
তার এ অকাল প্রয়াণ আমাকে ব্যথিত করেছে; আমি তার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি প্রাণমনে!
কবি ও সাংবাদকি শব্দনীল লিখেছেন ফকির আলমগীরে সঙ্গে শেষ কথোপকথনের স্মৃতি-
‘সম্পাদক একটা লিস্ট হাতে ধরায় বললেন- তারকাতের ঈদ ভাবনা এবং ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করতে হবে। লিস্ট হতে নিয়ে দেখি- ফকির আলমগীর সকলের আগে। যদিও এর আগে কয়েকবার কথা হয়েছে। আমার সাক্ষাৎকার বইয়ের জন্য তিনি, কথা বলবেন। সময় ছিলো, ঈদের পর।
আমি লিস্টের প্রথমে ওনাকে ফোন দিলাম। বললো- দেখ ভাই। আমি সিটি স্ক্যান করতে আসছি, শরীর ভালো নেই। তুই কাল একবার ফোন দে। আমি রাতে ফোন দিয়ে খোঁজ নিলাম। আমাকে বললো- কাজের সময় তোর মুড অন্যরক থাকে।
আমি হা-হা-হা করে হেসে উঠতেই বললো, কি প্রশ্ন করবি ঈদ নিয়ে কর। বললাম- কাল সকাল অফিস টাইমেই ফোন দিবোনে। আমি আফিসিয়ালি ফোন করিনি। শুনে বললো- বাঁচালি। শরীর অতটা ভালো না। কথা বলতে কষ্ট হয়। টুকটাক আর একটু কথা বলে রেখে দিলাম।
পরের দিন আবারও কথা হলো, বললো- শোন, তুই সামনে এগিয়ে যা। আমার শরীর যদি বিকেলের দিকে ঠিক থাকে তবে তোকে ফোন দিবো। ফোন তো দিলেন না। এমন তো হয়নি কখনও!
আপনার ছেলের সঙ্গে আমার কথা হলো, আপনার সঙ্গে হলো না।