ঢাকা : খ্যাতিমান অভিনেতা ও নির্দেশক আলী যাকেরকে হারানোর এক বছর পূর্ণ হলো আজ। ২০২০ সালের ২৭ নভেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। দীর্ঘদিন ক্যানসারের সাথে লড়াই করছিলেন, মৃত্যুর দুদিন আগে করোনায় আক্রান্ত হন তিনি।
আলী যাকের ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী মানুষ। তিনি পড়াশোনা করেছেন সেন্ট গ্রেগরি স্কুল, নটর ডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার এই সুশিক্ষার আলো ছড়িয়েছে অভিনয়ের জগতেও। শুদ্ধ সংস্কৃতি চর্চায় তিনি নিজেকে পুরোপুরি ঢেলে দিয়েছিলেন।
দেশে থিয়েটারের অবস্থান তৈরি করার পেছনে যে’কজন ব্যক্তির অবদান সবচেয়ে বেশি, তাদেরই একজন আলী যাকের। যাকে বলা হয় দেশের থিয়েটার আন্দোলনের বরপুত্র।
আলী যাকের প্রথম মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সেটা ছিল মুনীর চৌধুরীর বিখ্যাত নাটক ‘কবর’। তার অনবদ্য অভিনয় দেখে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি জিয়া হায়দার আর সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান আলী যাকেরকে আহ্বান জানান। তাদের নাট্যদল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেয়ার জন্য বলেন। আলী যাকেরও যুক্ত হন। তারপর এক লম্বা বর্ণিল পথচলা।
মঞ্চে আলী যাকের অভিনয় করেছেন অনেক বিখ্যাত নাটকে। সেসব নাটকের মধ্য থেকে তিনি নুরুলদীন, গ্যালিলিও ও দেওয়ান গাজী ইত্যাদি চরিত্রে বিপুল পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তার অভিনীত মঞ্চনাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’, ‘বাকী ইতিহাস’, ‘বিদগ্ধ রমণী কুল’, ‘তৈল সংকট’, ‘এই নিষিদ্ধ পল্লীতে’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘অচলায়তন’, ‘কোপেনিকের ক্যাপ্টেন’, ‘ম্যাকবেথ’, ‘টেমপেস্ট’, ‘নূরুলদীনের সারাজীবন’, ‘কবর দিয়ে দাও’, ‘গ্যালিলিও’ ও ‘কাঁঠাল বাগান’।
মঞ্চ নাটকে কেবল অভিনেতা নয়, একজন সফল নির্দেশকও ছিলেন আলী যাকের। তার অভিনীত বেশিরভাগ নাটকের নির্দেশনা তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি দর্শনীর বিনিময়ে নাটক প্রদর্শনীর যাত্রা শুরু করেন। যা ছিল দেশের থিয়েটার জগতের জন্য বিশাল মাইলফলক।
আলী যাকের দেশজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন টিভি নাটকের জন্য। দেশের ইতিহাসে অন্যতম দুটি বিখ্যাত ও কালজয়ী নাটক ‘বহুব্রীহি’ ও ‘আজ রবিবার’-এ অভিনয় করেছেন তিনি। ‘বহুব্রীহি’ নাটকে তার মামা চরিত্র এবং ‘আজ রবিবার’-এ বড়চাচা চরিত্র দুটি তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যার ফলে দর্শকদের কাছে তিনি এখনো বড়চাচা নামেও পরিচিত।
এছাড়াও আলী যাকের অভিনয় করেছেন ‘একদিন হঠাৎ’, ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’, ‘পাথর সময়’, ‘অচিনবৃক্ষ’, ‘আইসক্রিম’, ‘পান্ডুলিপি’, ‘গণি মিয়ার পাথর’ ইত্যাদি টিভি নাটকে।
চলচ্চিত্রে খুব বেশি অভিনয় করেননি আলী যাকের। সর্বসাকুল্যে তার অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা চারটি। এগুলো হচ্ছে- ‘আগামী’, ‘নদীর নাম মধুমতী’, ‘লালসালু’ ও ‘রাবেয়া’। চলচ্চিত্রের সংখ্যা অল্প হলেও আলী যাকের তার অভিনয়ে উজ্জ্বল।
মঞ্চনাটকে অসামান্য অবদান, বর্ণিল অভিনয় জীবন; এসবের জন্য আলী যাকের পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। ১৯৯৯ সালে তিনি দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত হন। এছাড়াও পেয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদক ও মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা পুরস্কার।
ব্যক্তিগত জীবনে আলী যাকের বিয়ে করেছেন সারা যাকেরকে। তিনিও একজন গুণী অভিনেত্রী। সেই সঙ্গে সফল ব্যবসায়ীও। এ দম্পতির এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রয়েছে। এর মধ্যে পুত্র ইরেশ যাকের দেশের গুণী অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত আর কন্যার নাম শ্রিয়া সর্বজয়া।
সোনালীনিউজ/এমটিআই