ঢাকা : আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করেন। তাদের জীবিকা নির্বাহ করতে হয় দিন এনে দিন খেয়ে। করোনার মহামারি শহর ও গ্রামীণ সমাজের সকল স্তরে প্রভাব বিস্তার করেছে। তার রাহু গ্রাস থেকে মুক্তি পাননি ধনী-গরীব কেউই। তবে শহরের প্রান্তিক সীমিত আয়ের মানুষদের উপর করোনার থাবা বসেছে ভয়াবহ ভাবে। অন্য দিকে মরার উপর খরার ঘা হয়ে এসেছে লকডাউন।
রাজধানীর প্রান্তিক শ্রমিকদের না আছে দেখার মতো কেই আবার পকেটে না আছে চলার মতো পর্যাপ্ত টাকা। তারা কেউ জীবিকা নির্বাহ করেন বাদাম, ঝালমুড়ি, চা-বিস্কিট, বিভিন্ন ধরনের সবজি-ফলমূল এবং নানা প্রয়োজনীয় জিনিস বিক্রি করে। তাদের এখন চলছে তিন বেলার পরিবর্তে দু’বেলা এবং কোনও কোনও সময়ে একবেলা খেয়ে। কেও বাসা ভাড়া ঠিক মতো দিতে পারছেন না আবার অনেকে বদলাচ্ছেন নিজের পেশা। করোনার প্রথম দিকে সরকারি এবং ব্যক্তি পর্যায়ের সহযোগিতা পেলেও এখন নির্ভর করতে হচ্ছে বেচা-বিক্রির উপর। লকডাউনের কড়াকড়ি থাকলেও তাদের বেচা-বিক্রি করতে হচ্ছে প্রশাসনের সঙ্গে ইঁদুর-পুলিশ খেলে।
আমিরুল মিয়া রাজধানীর বাসাবোতে থাকেন। ভ্যানে করে বিভিন্ন ধরনের সবজি বিক্রি করেন। করোনা আসার আগে ছিলেন বাস চালক। লকডাউনে যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় জীবিকার তাগিদে ভ্যানে সবজি বিক্রি শুরু করেন।
তিনি সোনালী নিউজকে বলেন, ‘আগে মিনি বাসের ড্রাইভার ছিলাম। লকডাউনে সব বন্ধ হয়ে গেলো। যার গাড়ি চালাইতাম, হেই মালিক মারা গেলো। তার ছেলে দশ কেজি চাইল, তেল, নুন দিলো। কদিন চললাম। তারপর কোনও উপায় না দেহে এই কাজ শুরু করলাম। মনে করেন তাও যা-তা অবস্থা। সবজির দাম পাই না, কাইল পাঁচশ টাহা লস হয়ছে, আজ বৃষ্টির মইধ্যে বাইর হয়ছি। তিন-চার মুঠা শাক বেচলে দশ টাহা লাভ হয়। এই দিয়ে সংসার চলে কন আপনে। বেবাকের কাছে শুনি সরকার টাহা দেয়। কই দেয়, আজ পর্যন্ত দেখলাম না। গরীবের দাম আছেনি কন।’
একটি ঝুড়িতে বাদাম-বুট-ছোলা নিয়ে রাজধানীর ফকিরাপুলে বসে আছেন সকিনা বিবি। তিনি বলেন, ‘এই যে দেহেন সকাল থেকে বসে আছি। কয় টাহা বিক্রি করছি যানেন, ষাইট টাহা। একটু পর পুলিশ আইসা দৌড়ানি দিলে চলে যাবো। এই ভাবে যাচ্ছে, মনে করেন ক্ষিধা পেটে রাইখা চলতে হচ্ছে আমাদের। একবেলা খাইলে আর একবেলা না খেয়ে থাকতে হচ্ছে লকডাউনে। ঘর ভাড়া দিতে পারি না তিন মাস ধরে। বাড়িওয়ালা মানতে চায় না। আগে দোকান আছিলো, করোনায় তা শেষ হয়ে গেছে। এহন এই ভাবে যতদিন চলা যায়। হুনি, হেয় করোনায় মরে, অয় করোনায় মরে। আল্লাহ আমারে দিতে পারে না। কষ্টে আর চলতে পারি না। আগে ধরেন প্রতিদিন দুই-তিন হাজার টাহা থাকতো। এই টাহা থাইকা এক সমীতিতে রাখতাম। তারা সব নিয়া চইলা গেলো।এখন আমি কান্দি মনে মনে, আমার কইলজাডা ফাইট্টা যায়।’
নিখিন সরকার রাজধানীর কাঁটাবনে বসে জুত সেলাই করেন। তিনি পেশায় মুচি। নিখিন বলেন, ‘আমি ত্রিশ বছর ধরে মুচির কাজ করি। টানাটানির সংসার করোনার আগেও ছিলো। কিন্তু এখন তো বেকার। না খেয়ে মরতেছি, মনে করেন কোনও রকম বেঁচে আছি। খাইয়া-না খাইয়া। আমরা তো একদম খাইট মড়া। আমাদের মতো গরীব যারা আছে, তাদের কোনও উপায় আছে বলেন। দেখি সরকারি সাহায্য পায় অনেকে। আমি আগেও পাইনাই, এখনও না। বাঁইচা থাকতে কোনও দিন পাব কি না জানি না। কাজ না থাকলে বাসা ভাড়া-খাওয়া খুবই কষ্ট, এই কথা কার কাছে গিয়ে বলবো, আমার হাড়িতে চাইল নাই, খাইতে পারছি না। বলার মতোও কেউ নাই।’
রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে দশ-পনেরো বছর ধরে ভ্যান চালিয়ে সংসার চালান লালন মিয়া। রাজধানীর ধানমন্ডিতে ভ্যান নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে। সকাল থেকে কোনও ধরনের কাজ পাননি। তিনি বলেন, ‘দশ-পোনারও বছর ধরে ভ্যান চালাই। এমন পরিস্থিতিতে পড়ি নাই। আগে আল্লায় দিলে ডেলি ১৫’শ-দুই হাজার কামায়ছি। এহন পাঁচ-ছয়’শ কামাতে হিমশিম খাই। ভ্যান যদি নিজের হই তো তাইলে একটু পড়তায় পরতো। ভ্যানের ভাড়া দেওন লাগে মালিককে। সাহায্য তেমন পাই নাই। প্রথম যহন লকডাউন দিছিলো তহন কিছু পাইছি। বউ বাসা-বাড়িতে কাজ করে। সেইহান থেকে পাইছি। এবার তেমন পাই নাই। চলতে খুব কষ্ট হয়।’
রাজধানীর শনির আখড়ায় একটি বন্ধ দোকানের সামনে জুতা নিয়ে বসে আছেন মইনুল হোসেন। তিনি সোনালী নিউজকে বলেন, ‘আমাদের কথা কে হুনবো। এইযে দেখেন এই হানে জুতা নিয়ে বসে আছি একটুপর পুলিশ আসলে চলে যাইতে হইবো। এক এক দিন এক এক যায়গায় বসে বিক্রি করতে হয়। না করে উপায় কই। খাইতে হইবো না। পোলাপান আছে। ঘরে অসুস্থ মা আছে। সব আমার দিকে তাকায় থাকে। করার তো কিছু নাই। চাইতেও পারি না, আবার কেউ দেয়ও না। বাঁইচা আছি, না মরে।’
সোনালীনিউজ/এসএন/আইএ