ঢাকা : নারিকেল দেশের অন্যতম অর্থকরী ফসল। নারিকেল গাছের পাতা, ফুল, ফল, শিকড় সব কিছুই বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। নানারকম মুখরোচক খাবার তৈরিতেও নারিকেল ব্যবহূত হয়। এ ছাড়া সুস্বাদু পানীয় ও রোগীর পথ্য হিসেবে ডাব ব্যবহার হয়ে থাকে। বর্তমান সরকার সারাদেশে বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করছে। এসব এলাকায় নারিকেল চাষের জন্য অতি অনুকূল অবস্থা বিরাজ করছে। এই বিবেচনায় ভিয়েতনাম থেকে খাটো ও উন্নতজাতের ওপেন পলিনেটেড নারিকেলের চারা আমদানি করে ব্যাপক আকারে সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে খাটো জাতের নারিকেল গাছের পরিচর্যা ও রোগ বালাই ব্যবস্থাপনার বিষয়ে কৃষকদেরকে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। নারিকেলের মালা দিয়ে একটিভেটেড কাঠ কয়লা, বাটি, বাক্স, ঘর সাজাবার দ্রব্যদি তৈরি হয়। পাতা দিয়ে মাদুর, ঘর আচ্ছাদন এবং শলা দিয়ে ঝাড়ু তৈরি হয়। নারিকেলের কোপ্রা হতে বিভিন্ন উপদেয় খাবার, কেশ তৈল তৈরি হয়। পৃথিবীর অনেক দেশে নারিকেলের তেল খাবার হিসাবে ব্যবহূত হয়। পৃথিবীর প্রধান নারিকেলের উৎপাদনকারী দেশ হলো ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ইত্যাদি।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া নারিকেলের উৎপত্তিস্থল বলে ধরা হয়। বর্তমানে নারিকেল উৎপাদনকারী দেশ সমুহের মধ্যে ফিলিপাইন, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভিয়েতনাম, ব্রাজিল, জ্যামাইকা, পানামা, বাংলাদেশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। যে সব দেশ সমুদ্র উপকূল বিদ্যমান সে সব দেশে নারিকেল ভালো হয়। বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতে কম বেশি নারিকেলের হয় তবে উপকূলাঞ্চে বেশি ভালো হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে নারিকেল চাষ হয় যার উৎপাদন প্রায় ১ লাখ টন। বাংলাদেশে কৃষক তিনটি কারণে নারিকেলের ভালো ফলন পায় না যথা- (অ) প্রাকৃতিক কারণ (যেমন- মাটি ও জলবায়ু সমস্যা, জেনেটিক্যালি সমস্যা, ঝড়, শিলাবৃষ্টি, খরা প্রভৃতি), (আ) রোগ ও (ই) পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়ে। সঠিক পরিচর্চা ও রোগ-পোকামাকড় দমন করে প্রথম ক্ষতি আংশিক এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষতি প্রায় সম্পূর্ণরূপে সমাধান করা সম্ভব।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, খাটো জাতের হাইব্রিড নারিকেল গাছের চাষে গুরুত্ব দিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এই নারিকেল গাছ সনাতনী গাছের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি ফল দিবে। চারা রোপণের দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া যাবে। নতুন উদ্ভাবিত এ নারিকেল গাছ বছরে ১৫০ থেকে ২৫০টি ফল দিয়ে থাকে। যা দেশি নারিকেল গাছের তুলনায় তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি। গাছের উচ্চতা ২ থেকে ৪ ফুট হলেই ফল ধরা শুরু করে। বাংলাদেশে দুটি খাটো জাতের নারিকেল গাছের চাষ হয়। একটি হলো ডিজে সম্পূর্ণ হাইব্রিড ডোয়াফ নারিকেল এবং অন্যটি হলো ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা ‘উন্নত ও খাটো’ ওপেন পলিনেটেড (ওপি) জাত। ভিয়েতনাম থেকে সংগ্রহ করা এ জাতটি আবার দু-ধরনের, সিয়াম গ্রিন কোকোনাট এবং সিয়াম বস্নু কোকোনাট। দুটি জাতই বছরে প্রায় ১৫০টি নারিকেল দেয়। এই জাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নারিকেল থেকেই এর চারা হবে। দুই থেকে আড়াই বছরে গাছে ফুল আসবে। প্রতিটি ডাব থেকে ৩০০ এমএল পানি পাওয়া যাবে।
খাটো জাতের হাইব্রিড নারিকেল চাষে করণীয় : আমাদের দেশে বর্তমানে যে প্রচলিত নারিকেলগুলো রয়েছে তা থেকে ফলন পেতে স্বাভাবিকভাবে ৭ থেকে ৮ বছর সময় লাগে। নিকাশযুক্ত দো-আঁঁশ থেকে বেলে দো-আঁঁশ মাটিতে ডিজে সম্পূর্ণ ডোয়ার্ফ হাইব্রিড নারিকেল রোপণের সময় জুন-সেপ্টেম্বর। রোপণের দূরত্ব : ৬ বাই ৬ মিটার হিসেবে হেক্টরপ্রতি ২৭৮টি চারা প্রয়োজন। আদর্শ পিটের মাপ হবে ৩ ফুট বাই ৩ ফুট বাই ৩ ফুট। গর্ত তৈরির পর প্রতি গর্তে ১৫ থেকে ২০ কেজি পচা গোবর অথবা আবর্জনা পচা সার দিতে হবে। মাটিতে অবস্থানরত পোকার আক্রমণ থেকে চারা রক্ষার জন্য প্রতি গর্তে ৫০ গ্রাম বাসুডিন প্রয়োগ করতে হবে। সব কিছু মাটির সাথে মিশিয়ে গর্ত ভরাট করে দিতে হবে। ভরাটের পর পানি দিয়ে গর্তটাকে ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে সব সার ও অন্যান্য উপাদান মাটির সঙ্গে মিশে যায় যা চারা গাছের শিকড়ের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। নারিকেল গাছের মাঝখানে বারি মাল্টা-১ বা লেবু, ডালিম, আমড়া, সফেদা জাতীয় গাছ লাগিয়ে নারিকেল চাষকে আরো অর্থবহ করে তোলা যায়।
সূত্র জানায়, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় খাটো জাতের নারিকেল গাছ লাগানো শুরু হয়েছে। এছাড়া বান্দরবান, রাঙ্গামাটি জেলার পাহাড়ি এলাকায়ও এ জাতের গাছ লাগানো হয়েছে। সারা দেশে হর্টিকালচার সেন্টারের মাধ্যমে এ চারা কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়। রাজধানীতে আসাদগেট হর্টিকালচার সেন্টার থেকেও এ জাতের গাছ সংগ্রহ করছেন রাজধানীবাসী।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার নারিকেল ও ডাবের চাহিদা পুরণে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা খাটো জাতের নারিকেলগাছ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
এই প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড.মেহেদী মাসুদ বলেন মাননীয় কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নির্দেশনায় ২০১৬ সালের মার্চ মাসে ভিয়েতনাম থেকে সরাসরি এই খাটো জাতের নারিকেলের চারা আমদানি করা শুরু হয় এবং ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় সোয়া সাত লাখ চারা বিতরণ করা হয়েছে। ভিয়েতনাম থেকে দুই ধরনের খাটো জাতের নারিকেল চারা নিয়ে আসা হয়েছে। এর একটি হল সিয়াম গ্রিন কোকোনাট ও অন্যটি সিয়াম ব্লুু। এই দুই জাতই ডাব হিসেবে খুবই জনপ্রিয়। তিনি জানান এই নারিকেল গাছে অনেক নারিকেল ধরে অল্প সময়ে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রোপন করা অনেক গাছেই ফুল আসা শুরু হয়েছে এবং এই নারিকেল গাছ দিন দিন বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে এই নারিকেল গাছের অসংখ্য বাগান সৃজন করা হয়েছে এছাড়া সরকারি হর্টিকালচার সেন্টার ও উপজেলা কৃষি অফিসের থেকে প্রতিটি চারা পাঁচশ টাকা দরে ক্রয় করে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই এই নারিকেল গাছের বাগান করেছেন।
জানাগেছে, ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে যারা খাটো জাতের এই নারিকেলের চারা রোপণ করে নিয়মিত সঠিকভাবে পরিচর্যা করেছেন তাদের প্রায় সকলের গাছেই নারিকেলের ফুল আসা শুরু হয়েছে। মাওনা গাজীপুরের কর্নেল গোলাম মওলা, চন্দ্রার মো. আতিকুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গার মো. আকবর আলী, হারিছ উদ্দিন, হর্টিকালচার সেন্টার রহমতপুর, বরিশাল, হর্টিকালচার সেন্টার রামু কক্সবাজার, কাশিয়ানী হর্টিকালচার সেন্টার, মাগুরা হর্টিকালচার সেন্টার ও বারাদি, মেহেরপুর সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আড়াই বছরের গাছেই ফুল আসা শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশে বেশিরভাগ নারিকেলগাছ লম্বা জাতের। ফলন তুলনামূলক কম। এ গাছের ফলপ্রাপ্তির সংখ্যা বছরে গড়ে ৩০-৪০টি। এ নারিকেলগাছ অল্প সময়ে ফল দিতে শুরু করে। ফলদান ক্ষমতা অনেক বেশি। এ গাছ খাটো হওয়ায় সাধারণত ঝড়ে ভেঙে পড়ে না।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক কৃষিবিদ মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে অতিমাত্রায় ডাব বিক্রি হওয়ায় নারিকেলগাছের ফল বা (বীজ) প্রাপ্তির সংখ্যা দিন-দিন কমে আসছে। এ পরিস্থিতিতে ভিয়েতনাম থেকে খাটো জাতের ওপেন পলিনেটেড নারিকেলের চারা আমদানি করা হয়েছে। এ জাতের ডাব খুবই সুস্বাদু। এ ছাড়া ফলনও লম্বা জাতের গাছের চেয়ে অনেক বেশি। এ গাছে বছরে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০টি ফল ধরে। গাছ রোপণের দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে ফুল ফোটা শুরু হয়। সব ধরনের মাটিতেই এ গাছ লাগানো সম্ভব। তাছাড়া এ জাতের গাছ লবণাক্ততা অনেক বেশি সহ্য করতে পারে। গাছ খাটো হওয়ায় পরিচর্যাও সহজ।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা তালহা জুবাইর মাশরুর এর কাছে খাটো জাতের এই নারিকেল চাষ বিষয়ে কৃষকদের মাঠপর্যায়ে কী ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, খাটো জাতের নারিকেল গাছ থেকে ৩ বছরেই ফল পেতে হলে গাছ লাগানো থেকে শুরু করে সারা বছর নিয়ম মেনে পরিচর্যা করতে হয়। রোদ্রোজ্জ্বল ছায়া পড়ে না এবং সেচের ভালো ব্যবস্থা আছে এমন জায়গা নির্বাচন করে মাত্রানুযায়ী জৈব ও রাসায়নিক সার দিয়ে মাদা তৈরি করে গাছ লাগাতে হবে। নিয়মিত সেচ, মালচিং ও আগাছা দমন করতে হবে। বেশি শীতে ঠান্ডার হাত থেকে বাচাতে পাটের তৈরি চটের বস্তা দিয়ে চারা গাছ কে পেঁচিয়ে রাখতে হয়। এছাড়া ডাব ছোট অবস্থায় মাকড় নাশক স্প্রে করার বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে। বিশেষ করে বছরে অন্তত তিন বার মাত্রা অনুযায়ী জৈব ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে খাটো জাতের এই নারিকেল গাছের বৃদ্ধি দেখে বুকভরা আশা নিয়ে সফলতার স্বপ্ন দেখছেন অনেক কৃষক ও বাগান মালিকেরা। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এই নারিকেল গাছের চারা রোপণকারীদের সবধরনের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
লেখক : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক
writetomukul36@gmail.com