শামুক-ঝিনুক বিক্রি করে চলে তাদের সংসার

  • হাদিউল হৃদয়, সিরাজগঞ্জ | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৪, ০৩:৩৮ পিএম

সিরাজগঞ্জ: পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে গঠিত বৃহৎ চলনবিল। চলনবিলের নদী, বিল ও জলাভূমিতে প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেওয়া শামুক ও ঝিনুক জীবিকা অর্জনের অন্যতম অবলম্বন হয়ে উঠেছে এ অঞ্চলের নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত হাজারও মানুষের। বর্ষা মৌসুমে কর্মহীন সময়ে তারা শামুক ও ঝিনুক কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের শেষের দিকে বিলের পানি শুকানোর সময় দুই মাস ধরে শামুক সংগ্রহ ও বেচাকেনার মহোৎসব চলে।

শামুককে কেন্দ্র করে চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের মাকড়শোন এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি ভাসমান হাট। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত অন্যান্য হাটগুলোর মতোই এই হাটে পাইকারী হিসেবে বিকিকিনি হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শামুক ও ঝিনুক। নওগাঁ, পাবনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার পাইকাররা এখান থেকে শামুক কিনে নিয়ে উন্নতমানের পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাদ্য হিসেবে হাঁসের খামারিদের কাছে বিক্রি করছেন। চলনবিলে মাছ কমে যাওয়ায় শামুক কুড়িয়ে বেচাকেনা করেই  জীবিকা নির্বাহ করছেন এখানকার জেলেরা।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চলনবিলের ১৬টি নদী, ৩৯টি বিল ও ২২টি খাড়িসহ বিভিন্ন জলাভূমি থেকে প্রতিদিন প্রায় ২০০ টন শামুক-ঝিনুক সংগ্রহ করা হচ্ছে। শামুক-ঝিনুক বেচা-কেনার জন্য পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া, তাড়াশ ও নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলায় ৫০টির বেশি আরৎ গড়ে উঠেছে। সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে আড়ৎদাররা প্রতিবস্তা শামুক-ঝিনুক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে কিনে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ীরা এসব শামুক-ঝিনুক কিনে ট্রাকে করে রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, বগুড়া, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণাঞ্চলের মাছের ঘেরের মালিকদের কাছে প্রতিবস্তা ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা দরে বিক্রি করছে। চিংড়িসহ চাষ করা অন্য মাছ দ্রুত বৃদ্ধিতে কম খরচে খাদ্য হিসেবে শামুক-ঝিনুকের বিকল্প নেই। তাই এর চাহিদা বেশি। এ কারণে এই অঞ্চলের ঘেরের মালিক ও ব্যবসায়ীরা আড়ৎদারদের কাছ থেকে শামুক ঝিনুক কিনছেন। বর্ষা মৌসুমে শামুক-ঝিনুক বিক্রির টাকা দিয়েই সংসার চালান এখানকার জেলেরা। প্রতিদিন গড়ে দুই বস্তা শামুক ধরেন। যা বিক্রি করে আয় হয় ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা।

সরেজমিন শামুকের হাটে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার পাশে রাখা হয়েছে নৌকা, আর সেখানে শতাধিক বস্তা শামুক। ফড়িয়া ও সংগ্রহকারীদের কাছ থেকে বস্তা হিসেবে শামুক কিনে নিচ্ছেন আড়ৎদাররা। আড়ৎদারের কাছে শামুক বিক্রি করতে আসা ফড়িয়া তাড়াশ উপজেলার সগুনা গ্রামের সজিব হোসেন বলেন, এলাকার দরিদ্র ছেলেমেয়েরা শামুক-ঝিনুক ধরে। অনেক গরীব মানুষ বর্ষার দিনে কাজ না থাকায় শামুক ধরে বিক্রি করে।

উপজেলার কুন্দইল গ্রামের আজিুজল হক, দিঘী গ্রামের মিরাজুল ইসলাম, মাকশোন গ্রামের গোলাম মোস্তফা জানান, প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে ৬-৭ জনের একটি দল নৌকা ও জাল নিয়ে চলনবিলের বিভিন্ন খালে যান। সারারাত জাল ফেলে শামুক সংগ্রহ করেন তারা। এরপর সকালে শামুক থেকে অন্যান্য ময়লা ফেলে বস্তায় ভরে প্রায় ৩৫-৪৫ মণ শামুক পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। এতে প্রতিদিন চার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়।

বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলা থেকে শামুক কিনতে আসা পাইকার মো. রবিউল হোসেন জানান, শামুক পুষ্টিগুণ সম্পন্ন। শামুকগুলো হাঁসকে খাওয়ালো হাসের মাংস বৃদ্ধি পায় এবং ডিমও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হয়। আর সেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটলে বাচ্চাগুলোও শক্ত ও হৃষ্টপুষ্ট হয়। এ জন্যই হাঁস খামারীদের কাছে শামুকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এ কারণে জেলেদের কাছ থেকে শামুক কিনে দেশের বিভিন্ন জেলার হাস খামারীদের কাছে বিক্রি করা হয়।

অপরদিকে ঘের মালিকরা শামুক-ঝিনুকের মাংস বের করে নেয়ার পর খোলস বিক্রি করে দেয়। পোলট্রি ও ফিশমিল্ক তৈরিকারকরা এই খোলস কিনে নেয়। শামুক-ঝিনুকের খোলস রোদে শুকিয়ে মেশিন দিয়ে গুঁড়া করা হয়। পরে তা নেটিং মেশিনে দিলে দু’ধরনের প্রক্রিয়াজাত দ্রব্য পাওয়া যায়। এর একটি পাউডার অপরটি দানা পাউডার। ফিশমিল্ক তৈরিতে পাউডার এবং মুরগির খাবার তৈরিতে দানা পাউডার ব্যবহার করা হয়। উৎপাদিত দানা পাউডার প্যাকেটজাত করে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হয়।

তবে নির্বিচারে শামুক নিধনের ফলে মাটির উর্বতা ও পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে জানান তাড়াশ ডিগ্রি কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মর্জিনা ইসলাম। তিনি আরও জানান, চলনবিল অঞ্চলের যেসব শামুক ধরা হয়, তা মূলত আপেল শামুক গোত্রের। এই শামুক ধরে নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মাছের ঘেরের যে চিংড়িকে খাওয়ানো হচ্ছে সেগুলো আমাদের দেশের মানুষ পাচ্ছে না। প্রতিদিন চলনবিল থেকে প্রায় ২০০ টন শামুক ধরা হচ্ছে।

তাড়াশ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমাদের এই শামুক প্রাকৃতিক সম্পদ। আমার জানা মতে, এ অঞ্চল থেকে নিয়ে যাওয়া শামুকের ভেতরের অংশ মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। খোলস ব্যবহার হয় চুন ও সার তৈরিতে। আর নির্বিচারে শামুক নিধন এই অঞ্চলের জমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি ও খাদ্যশৃঙ্খলার জন্য ক্ষতিকর। এটি নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের জন্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তবে শামুকের অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। মাছের এবং হাঁসের খাদ্য হিসেবে শামুক ব্যবহৃত হয়। তাই চলনবিলে শামুক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রকল্প গ্রহণ করার পরিকল্পনা আছে বলে জানান, তাড়াশ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মশগুল আজাদ।

এসএস