নড়াইল: যে সমাজে নারীকে শুধু ঘরের কাজের মানুষ হিসেবে ধরা হয়, সেখানে মল্লিকা রায় নামের এক গৃহবধূ প্রমাণ করে দিয়েছেন, নারীরাও আজ পিছিয়ে নয়। চাইলে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াও তারা সাবলম্বী হতে পারেন। নিজের পরিশ্রমে বড় অর্থ আয় করে সংসারের হাল ধরতে পারেন।
মল্লিকা রায়ের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার প্রত্যন্ত বামনহাট গ্রামে। বাড়ির পাশের পতিত জমিতে বস্তায় আদা চাষ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি। নিজ বাড়ির পাশের অপেক্ষাকৃত নীচু জলাবদ্ধতা থাকা দেড় একর জমিতে বস্তায় আদা চাষ করেছেন মল্লিকা। ৯ মাসের এই ফসলে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ টাকার বেশি আয়ের স্বপ্ন দেখছেন এই গৃহবধূ।
মল্লিকার আদা বাগানে গিয়ে দেখা যায়, টানা বর্ষার জলে মাঠ-ঘাটে ফসলের ক্ষতি হলেও পানির মধ্যে বস্তায় উঁকি দিচ্ছে হাজারো তরতাজা আদাগাছ। সিমেন্টের বস্তায় লাগানো গাছগুলো সবই বড় হয়ে গেছে। গাছের গোড়ায় আদা আসতে শুরু করেছে৷ দেড় একর জমিতে সবুজ রঙের এই গাছের সমারোহ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায় সবার। সেখানে কথা হয় গৃহবধূ মল্লিকা রায়ের সাথে।
[233280]
সোনালীনিউজকে তিনি জানান, বস্তা পদ্ধতিতে আদাচাষ এলাকায় নতুন হলেও কৃষি বিভাগের পরামর্শে দামী এই মসলা চাষে আগ্রহী হয়েছেন তিনি। স্বল্প খরচে এই আদা চাষে ব্যাপকভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন তিনি। শুধু তিনি নিজেই লাভবান হচ্ছেন তা কিন্তু নয়। তার আদার ক্ষেতে এলাকার অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
মল্লিকা বলেন, সারা বছর এই জমিতে পানি থাকে, ফলে এখানে অন্য কোন ফসল হয়না। পরে কৃষি বিভাগের পরামর্শে সিমেন্টের ফেলে দেয়া বস্তায় সার মাটি দিয়ে ৫০ গ্রাম করে আদা রোপন করেছি। বস্তায় সারমাটি দিয়ে সেখানে ৫০ গ্রাম আদা দিয়ে অঙ্কুরোদগম ঘটিয়েছি। প্রচুর আগাছা জন্মানোয় সেগুলো পরিস্কার করা সবকিছুই করেছি আমার স্বামীকে সাথে নিয়ে। তাছাড়া শ্রমিকও ছিলো। আশা করি ভালো ফলন পাবো।
তিনি বলেন, দেড় একর জমিতে প্রায় ১০ হাজার বস্তায় সাড়ে ৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ১৬ থেকে ১৭ লাখ টাকার আদা বিক্রি করতে পারবো। সবকিছু ঠিক থাকলে ১০ লাখ টাকা লাভের আশা করছি।
আদা চাষ করে মল্লিকা যে শুধু নিজের আর্থিক উন্নতি করছেন তাই নয়, তার আদার ক্ষেতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এলাকার কয়েকজনের। এখানে কাজ করেই এখন সংসার চলছে তাদের। তাদের মধ্যে একজন তুষার বিশ্বাস সোনালীনিউজকে বলেন, আদার ক্ষেতে ৫ ঘন্টা কাজ করে প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে পাই। সেই টাকা দিয়েই আমার সংসার চলে।
পরিত্যক্ত জমিতে মল্লিকার আদা চাষ দেখে আরও অনেকেই অভিনব এ পদ্ধতিতে আদা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সদর উপজেলার ভওয়াখালি এলাকার বাসিন্দা তাহের মোল্যা বলেন, মল্লিকা নামে একজন ১০ হাজার বস্তায় আদা চাষ করেছেন শুনে দেখতে এসেছে যে উনি কিভাবে চাষ করেছেন। দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। আমার কিছু আদা চাষ করা আছে। আমি আগামীতে আরও বৃহৎ পরিসরে চাষ করব৷
উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের মসলার মধ্যে আদা একটি গুরুত্বপূর্ন ও দামী উপাদান। আর সেই আদা বাণিজ্যিকভাবে বস্তা পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে নড়াইল জেলার প্রত্যন্ত বামনহাট গ্রামে। এই পদ্ধতিতে একদিকে যেমন মাটিবাহিত রোগের আক্রমণ অনেক কমে যায়, অন্যদিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে বস্তা অন্য জায়গায় সরিয়েও নিয়ে যাওয়া যায়। কৃষি খাতে আধুনিকতার প্রসার ঘটায় বর্তমান সময়ে বাড়ির উঠান কিংবা পতিত, নিচু জলাশয় জমিতে বস্তায় আদা চাষে ঝুঁকছে চাষিরা। অল্প খরচ আর অধিক লাভ হওয়ায় সাথী ফসল হিসেবে বস্তায় আদা চাষ করছেন এলাকার কৃষক-কৃষানী।
[233156]
তথ্য মতে, ছায়াযুক্ত জায়গাতে প্রধানত আদা চাষ করা যায়। সাধারণত বাঁশ বাগানের তলায় কোন ফসল চাষ হয় না। ফলে জায়গাটা পড়েই থাকে। সেই বাঁশ বাগানে বস্তায় আদা চাষ করা যায় খুব সহজেই। আদা চাষ করতে প্রথমে মাটির শুকনো ঢেলা ভেঙে চেলে নিতে হবে। যাতে ঝুরঝুরে হয়। বস্তায় মাটি যাতে ফেঁপে থাকে সেজন্যে ভার্মিকম্পোস্ট ও ছাই মেশাতে হয়। পরিমাণমতো যোগ করতে হয় গোবর সার। মাটি তৈরি হয়ে গেলে বস্তায় ভরে চাষের জন্যে বসিয়ে প্রতি ব্যাগে ৫০ গ্রামের একটি করে আদা রোপন করতে হবে।
তারপর দিতে হবে সামান্য পানি। এরপর বস্তার উপর ঢেকে দিয়ে রাখতে হবে। এতে মাটিতে আর্দ্রতা বেশিদিন থাকে। অল্প দিনের মধ্যেই কন্দ থেকে গাছ বেরিয়ে আসা শুরু করবে।
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রোকনুজ্জামান বলেন, অপেক্ষাকৃত নীচু ও চাষ অনুপযোগী জমিতে বস্তা পদ্ধতিতে আদা চাষ অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং কার্যকারী একটি প্রযুক্তি। দিন দিন এ প্রযুক্তির মাধ্যমে চাষাবাদ বাড়ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সদর উপজেলায় প্রায় ১৯২০০ বস্তায় আদা চাষ করা হয়েছে। কৃষকের লাভ হচ্ছে বলেই কৃষক এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বস্তায় আদা চাষের জন্য আলাদা করে জমির দরকার নেই। অনেকের বাড়িতে এ পদ্ধতিতে আদা চাষ করতে পারেন। আবার অতিবৃষ্টি বা বন্যায় ফসল ডুবে নষ্ট হওয়ার ভয়ও নেই। তাই স্থানীয় কৃষকরা বাড়িতে যে কোনো স্থানে এই চাষ করছেন। সাধারণ চাষে প্রতি গাছে সর্বোচ্চ ৮ শ’ গ্রাম আদা হলেও বস্তায় দেড় কেজি পর্যন্ত আদা ফলানো সম্ভব বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
এসএস