ঢাকা : পুলিশের প্রতিবেদনে ‘স্থায়ী ঠিকানাবিহীন ও ভূমিহীন’ আসপিয়া ইসলাম কাজল কনস্টেবল পদে নিয়োগ পাবেন কিনা তা নিশ্চিত না হলেও তিনি তার জন্মস্থান বরিশালের হিজলাতে জমি ও ঘর পাচ্ছেন। এক খণ্ড জমি না থাকায় যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েও আসপিয়া চাকরি পাচ্ছেন না-এমন খবরে প্রশাসন তাকে জমি ও ঘর দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। বিষয়টি নজরে আসায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহানুভূতিশীল হয়ে তাকে জমি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ নির্দেশ পাওয়ার পর হিজলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুক্রবার আসপিয়ার বর্তমান আবাসস্থল হিজলার খুন্না গোবিন্দপুরে যান। সেখানে তিনি আসপিয়ার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। আসপিয়ার পরিবারকে জমি ও ঘর দেওয়ার জন্য তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেবেন। এদিকে আসপিয়ার চাকরি না হওয়ার ঘটনা নিয়ে সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টির মুহূর্তে জানা গেছে-তার পরিবার ভূমিহীন নয়। ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় আসপিয়ার দাদাবাড়িতে তাদের ৬৮ শতাংশ জমি রয়েছে। প্রতিবছর ওই জমি বর্গা দিয়ে তার মা টাকা আনেন। এদিকে কনস্টেবল পদে তার চাকরি পাওয়ার গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আসপিয়ার চাকরি পাওয়ার গুজব ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লেও এ রকম কোনো নির্দেশনা পাননি বলে জানিয়েছেন বরিশালের পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন।
বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। শুক্রবার আসপিয়ার বাড়িতে হিজলার ইউএনও বকুল চন্দ্র কবিরাজকে পাঠানো হয়েছে। আসপিয়ার পরিবার বর্তমানে হিজলার যে জায়গায় থাকে সেখানেই যাতে তাকে সরকারিভাবে জমি এবং ঘর করে দেওয়া যায় সেভাবেই চেষ্টা করছি আমরা।’
হিজলা ইউএনও বকুল চন্দ্র কবিরাজ জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে চলমান আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় আসপিয়ার পরিবারকে ঘর ও জমি দেওয়া হবে। তিনি আরও জানান, নিয়োগের সময়সীমা কতদিন তা জানি না। তবে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে সেই সময়সীমার মধ্যে তার বা তার মায়ের নামে জমি ও ঘর হস্তান্তর করার চেষ্টা করব।
আসপিয়ার পুলিশে চাকরি হয়েছে-এমন তথ্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও বিষয়টি গুজব বলে আসপিয়া নিজেই জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান, আমার চাকরি হয়েছে-এমন পোস্ট ফেসবুকে দেখেছি। সাইবার-৭১ নামের একটি আইডি থেকে আমার চাকরি পাওয়ার পোস্ট দেওয়া হয়েছে। তবে এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এ সংশ্লিষ্ট কোনো চিঠি বা খবর আমি পাইনি।
জানা গেছে, ভোলার চরফ্যাশন উপজেলায় আসপিয়াদের ৬৮ শতাংশ জমি রয়েছে। প্রতিবছর ওই জমি বর্গা দিয়ে তার মা ঝরনা বেগম টাকা আনেন। হিজলা উপজেলার ভাড়াটিয়া বাসায় আসপিয়ার বাবা শফিকুল ইসলাম মারা গেলে তার লাশ চরফ্যাশনে দাদাবাড়িতে দাফন করা হয়।
এ ব্যাপারে আসপিয়া বলেন, ‘দাদাবাড়িতে কী আছে না আছে তাই নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। বহু বছর ধরে বরিশালের হিজলা উপজেলায় বসবাস করছি। এখানেই স্থায়ী হতে চাই। যেহেতু এখানে আমাদের কোনো জমি নেই। তাই স্থায়ী ঠিকানা নেই বলে জানিয়েছি। হিজলায় যে আমরা ভূমিহীন সেটা তো মিথ্যা নয়।’
বরিশালে বৃহস্পতিবার নাগাদ আসপিয়াকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে সব পর্যায়ে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হওয়ার পরও ভূমিহীন হওয়ার কারণে চাকরি হচ্ছে না এ রকম একটি অভিযোগ আসপিয়া গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তুলে ধরেন। এর আগে বরিশাল জেলা পুলিশ লাইন্সের সামনে প্রায় আড়াই ঘণ্টা তিনি দাঁড়িয়ে থাকেন। ভূমিহীন হওয়ার কারণে স্থায়ী ঠিকানা না থাকায় তার চাকরি হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ সময় তিনি নাগরিক অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। মুহূর্তে এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা প্রচার করেন সচিত্র সংবাদ। নেট দুনিয়ায় বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় উঠলে স্থানীয় পুলিশ বিভাগও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে।
সংবাদকর্মীদের কাছে আসপিয়া দাবি করেন, হিজলা উপজেলার খুন্না গোবিন্দপুর এলাকায় তাদের বসবাস। সেখানে মেজবাহ উদ্দিন অপু চৌধুরীর বাড়িতে ভাড়া থাকে তার পরিবার। বাবা শফিকুল ইসলাম মারা গেছেন। এক ভাই, দুই বোন আর মাকে নিয়ে বহু কষ্টে চলে তার পরিবার। ভাই চাকরি করে ঢাকার একটি গার্মেন্ট কারখানায়। একজনার আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে তার পরিবার। তাই চাকরি পাবেন বলে তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। কিন্তু পুলিশ ভেরিফিকেশনে জাতীয় পরিচয়পত্রে দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী হিজলায় তার কোনো স্থায়ী ঠিকানা না পাওয়ায় তার চাকরি হচ্ছে না। এ তথ্য ভেরিফিকেশনে যাওয়া হিজলা থানা পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর আব্বাস উদ্দিন জানিয়েছেন বলে দাবি করেন আসপিয়া। এরপর তিনি ছুটে আসেন বরিশালে। পুলিশ লাইন্সের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে ছুটে যান পুলিশ সুপার এবং রেঞ্জ ডিআইজির অফিসে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, আসপিয়ার দাদাবাড়ি চরফ্যাশন উপজেলার ৫নং আমিনাবাদ ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের হালিমাবাদ গ্রামে। তার বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের বসবাসও ছিল সেখানে। কাজের সূত্রে হিজলা উপজেলায় এসে ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন আসপিয়ার বাবা শফিকুল ইসলাম। এখানে আসপিয়ার জন্ম হলেও দাদাবাড়ির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং আসা-যাওয়া রয়েছে তার পরিবারের সদস্যদের।
এ ব্যাপারে আসপিয়ার মেজ চাচা মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে কথা হয়। নিশ্চিত করে মোশাররফ হোসেন বলেন, পৈতৃক সূত্রে আসপিয়ার পরিবার চরফ্যাশনে ৬৮ শতাংশ জমির মালিক। এর মধ্যে ১৪ শতাংশ ভিটা এবং ৩২ শতাংশ নাল জমি। এসব জমি চরফ্যাশন উপজেলার ৪২নং মৌজার ৭৪৬নং খতিয়ানের ৩১১৮, ৩১৩৬, ৩১৩৮, ৩৩১৮ এবং ৩৩২৮নং দাগে রয়েছে।
তিনি আরও জানান, এ এলাকার লতিফ সরদারের ছেলে হামিদ সরদারের কাছে জমি বর্গা দিয়ে টাকা নিয়ে যান আসপিয়ার মা ঝরনা বেগম। কেবল মোশাররফ হোসেন নয়, আমিনাবাদ ইউনিয়নের আরও অন্তত ৮-১০ বাসিন্দা নিশ্চিত করেন-এখানে আসপিয়ার পরিবারের জমি রয়েছে। এখানে তাদের নিয়মিত যাতায়াতও আছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে নিজেকে ভূমিহীন দাবি করা আসপিয়া বলেন, ‘সেখানে আমার দাদাবাড়ি। এটা মিথ্যা নয়। আমি ৩-৪ বার দাদাবাড়ি গিয়েছিও। তবে দাদাবাড়ির সঙ্গে আমাদের নিয়মিত কোনো যোগাযোগ নেই। এছাড়া জন্মের পর থেকে আমি হিজলাতেই থাকি। এখানেই স্থায়ী হতে চাই। চরফ্যাশনে দাদাবাড়িতে আমাদের জমি আছে। কিন্তু হিজলায় আমাদের কোনো জমি না থাকায় বরিশালে স্থায়ী হতে বা স্থায়ী ঠিকানা দিতে পারছি না বলেই আমার চাকরি হচ্ছে না। হিজলাই আমার বর্তমান ঠিকানা। আমি দাদা কিংবা বাবার বাড়ির ঠিকানা ব্যবহার করতে চাইছি না।’
বরিশালের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবাল হোসাইন বলেন, ‘পুলিশে চাকরি বিধির নিয়মানুযায়ী নিজ জেলা থেকে আবেদন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে জমিজমা না থাকার কারণে চাকরি হবে না-এমন বিধান নেই। নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভেরিফিকেশনে ধরা পড়ে আসপিয়ার নিজ জেলা ভোলা। বংশপরম্পরায় আসপিয়া ও তার পরিবার চরফ্যাশনের বাসিন্দা। হিজলায় তার বাবা আসেন চাকরিসূূত্রে। এরপর থেকে তারা এখানে বসবাস করছেন। দাদাবাড়ির সঙ্গে পরিবারটির নিয়মিত যোগাযোগ থাকলেও আসপিয়া ভোলা থেকে প্রার্থী না হয়ে বরিশাল থেকে হয়েছিলেন। আসপিয়া তথ্য গোপন কিংবা ভুল তথ্য দিয়েছেন কিনা-সেটা ভেরিফিকেশনে প্রমাণ হয়েছে। তিনি ভোলা থেকে আবেদন করলে এ সমস্যার সৃষ্টি হতো না।
পুলিশে ভূমিহীনরা চাকরি পাবেন না এটা বড় ধরনের ব্যর্থতা : ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া গণমাধ্যমকে জানান, পুলিশে ভূমিহীনরা চাকরি পাবেন না এটা স্বাধীনতার ৫০ বছরে একটা বড় ধরনের ব্যর্থতা। ভূমিহীনদের পুনর্বাসন করা সরকারের দায়িত্ব। তিনি বলেন, আমি মনে করি পুলিশের চাকরি বিধিমালা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আসপিয়াকে জমি দেবেন শ্রীপুরের মেজবাহ উদ্দিন : শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি জানান, ভূমিহীন হওয়ার কারণে চাকরি না পাওয়া আসপিয়াকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক জমি দান করবেন শ্রীপুরের যুবক মেজবাহ উদ্দিন। শুক্রবার গাজীপুর ইউনিয়নের ধনুয়া গ্রামের কফিল উদ্দিন মেম্বারের ছেলে মেজবাহ এ অভিমত ব্যক্ত করেন। উপজেলার জৈনা বাজারের জৈনা বাজার মেসার্স হাফসা ট্রেডার্সের মালিক মেজবাহ জানান, ভূমিহীন হওয়ার কারণে চাকরি না পাওয়ার বিষয়টি তার হৃদয় স্পর্শ করেছে। আসপিয়ার চাকরিতে ন্যূনতম যতটুকু জমির প্রয়োজন তা দেব অথবা আসপিয়ার এলাকায় তা কিনে দেব।
উল্লেখ্য, পুলিশে ট্রেইনি রিক্রুট কনস্টেবল (টিআরসি) পদে বরিশাল জেলায় ১০ সেপ্টেম্বর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে পুলিশ সদর দপ্তর। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বরিশাল জেলা থেকে টিআরসি পদে সাতজন নারী ও ৪১ জন পুরুষ নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী হিজলা থেকে অনলাইনে আবেদন করেন আসপিয়া। ১৪, ১৫ ও ১৬ নভেম্বর বরিশাল জেলা পুলিশ লাইন্সে অনুষ্ঠিত শারীরিক যোগ্যতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ১৭ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। ২৩ নভেম্বর প্রকাশিত লিখিত পরীক্ষার ফলাফলেও তিনি কৃতকার্য হন। ২৪ নভেম্বর পুলিশ লাইন্সে মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি মেধা তালিকায় পঞ্চম হন। ২৬ নভেম্বর পুলিশ লাইন্সে প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ২৯ নভেম্বর মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ঢাকার রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চূড়ান্ত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। সেখানেও আসপিয়া কৃতকার্য হন। তবে চূড়ান্ত নিয়োগের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনে গিয়ে তিনি নিয়োগ থেকে ছিটকে পড়েন। কারণ তিনি বরিশাল জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নন। এ নিয়োগ পাওয়ার অন্যতম শর্ত ছিল জেলার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে। বুধবার হিজলা থানার এসআই আব্বাস ভেরিফিকেশনে আসপিয়া বরিশাল জেলার স্থায়ী বাসিন্দা নয় উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দেন। এরপর আসপিয়ার নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে যায়। সূত্র : যুগান্তর।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ