ঢাকা : মিন্টো রোডের ডিবি অফিসের পুরোনো ভবনে ঢুকতেই একটি কাঠের সিঁড়ি ওপরে উঠে গেছে। সিঁড়ির মুখ থেকে বাঁয়ে ঘুরলে ডানে ছোট একটি হাজতখানা। দরজায় লোহার গ্রিল দেওয়া, বাইরে থেকে ভেতরের সবকিছুই দেখা যায়। সেটা পার হলেই একটি কক্ষ, সেখানে বসেন ডিসি সৈয়দ বজলুল করিম। যিনি সবার কাছে পরিচিত ‘বি করিম’ নামে।
ডিবি অফিসের ফটকে তখন এত কড়াকড়ি ছিল না। আমরা যেতাম বিনা বাধায়, কোনো রকম আগাম অনুমতি ছাড়াই। তো একদিন দুপুরে গিয়ে দেখি, সেই হাজতখানার খালি মেঝেতে ইয়া লম্বা এক লোক শুয়ে গুনগুন করে গান গাইছেন। তাঁর পরনে টি-শার্ট আর হাফপ্যান্ট। হাজতের আশপাশে কেউ নেই। উল্টো দিকে একটি পুরোনো সোফায় এক পুলিশ সদস্য বসে কী যেন পড়ছেন। শুয়ে থাকা লোকটার মুখ দেয়ালের দিকে বলে প্রথমে চিনতে পারিনি। এগিয়ে গিয়ে তাকাতেই চমকে উঠি, ও মা! এ যে আজিজ মোহাম্মদ ভাই! মানে ধনকুবের আজিজ মোহাম্মদ ভাই।
এ ঘটনা ১৯৯৯ সালের জানুয়ারির। তার আগে বলে রাখি, আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে দেশের অনেক সাংবাদিকের পরিচয় ছিল বা আছে। নানা ঘটন-অঘটনে বরাবরই তিনি ছিলেন আলোচনায়। সংবাদের প্রয়োজনে আমরা অনেকবার তাঁর অফিস বা বাসায় গিয়ে বক্তব্য নিয়েছি। সেই সুবাদে অনেকের মতো তিনি আমাকেও চিনতেন। সেই আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে হাজতে দেখে বেশ অবাক হলাম। কিন্তু তিনি খুব স্বাভাবিক। আমাকে দেখে মৃদু হেসে বললেন, ‘কী মিয়া, তামাশা দেখছ, দেখ।’
এবার বলি আজিজ মোহাম্মদ ভাই কেন হাজতে এলেন। ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবদিন টাওয়ারে সাততলায় ‘ক্লাব ট্রাম্পস’ নামে একটি ডিসকো ক্লাব গড়ে উঠেছিল। সেটা করেছিলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের চাচাশ্বশুর, আরেক আলোচিত ব্যবসায়ী বান্টি ইসলাম। সেই ক্লাবে ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর খুন হন চিত্রনায়িকা দিতির স্বামী চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী। ক্লাবের ভেতরেই তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ নিয়ে গুলশান থানায় মামলা হয়। তদন্ত আসে ডিবিতে। সেই মামলায় ১৯৯৯ সালের ৩ জানুয়ারি গুলশান থেকে প্রথমে বান্টি ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।
তিন দিন পর ৬ জানুয়ারি গুলশান লেডিস পার্কের সামনে থেকে এসবির সহকারী পুলিশ সুপার খলিলুর রহমান গ্রেপ্তার করেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে। পরে এসবি তাঁকে ডিবির কাছে হস্তান্তর করে। সোহেল চৌধুরী খুনের মামলায় বান্টি ও আজিজ মোহাম্মদ ভাই ছাড়া আরও আসামি ছিলেন তারিক সাঈদ মামুন, সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন, ফারুক আব্বাসী, আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী এবং শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন। ১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার আবুল কাশেম ব্যাপারী নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। হাইকোর্টের আদেশে এ মামলার কার্যক্রম এখন অবধি স্থগিত আছে।
হাজতে বসে আজিজ মোহাম্মদ ভাই আমাকে বলেন, গ্রেপ্তারের প্রথম কয়েক দিন তাঁকে অন্য জায়গায় রাখা হয়েছিল। আজ তাঁকে ডিবির হাজতে আনা হয়েছে। ডিবির ডিসি বি করিম তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন কয়েক দফা। এটুকু বলতেই সামনে বসা কনস্টেবল এগিয়ে এসে বললেন, ‘ওনার সঙ্গে কথা বলতে মানা আছে।’
তখন সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার ফলোআপ করতে আমরা প্রতিদিনই বি করিমের কাছে যেতাম। আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে তাঁকে নানা দরকারি-অদরকারি প্রশ্ন করতাম। বি করিমও বেশ রসিক মানুষ, বিরক্ত না হয়ে তিনি সব প্রশ্নের জবাব দিতেন। একদিন তিনি আমাকে সিলেটি ভাষায় বললেন, ‘তাইনতো খুন লইয়া কুনতা মাতইননা, খালি কুন পুড়ির লগে কিতা সম্পর্ক ইতা খালি ইনাইয়া-বিনাইয়া গফ করইন।’ (তিনি তো খুন নিয়ে কিছু বলেন না। শুধু কোন মেয়ের সঙ্গে কী সম্পর্ক, সেই গল্প ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেন।)
আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এক সিনেসাংবাদিক। তখন ৩৪ বিজয়নগর ঠিকানার ভবনটির নিচতলায় ছিল লাল-সবুজ পত্রিকার অফিস আর ওপরে এমবি ফ্লিমস। একদিন সেই সাংবাদিক আমাকে নিয়ে গেলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে।
আমরা দুজন দোতলার একটি কক্ষে ঢুকে দেখি ইয়া মোটা এক লোকের পাশে বসে শ্যামলা রঙের হালকা-পাতলা এক তরুণী বয়স্ক লোকটার ডান হাতের আঙুল ফুটিয়ে দিচ্ছেন আর ‘দাদু দাদু’ করছেন। সাংবাদিক সাহেব সেই মোটা লোকটিকে দেখিয়ে বললেন, ইনিই চিত্রপরিচালক এহতেশাম। আর মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন, তাঁর নতুন ছবিতে নায়িকা হচ্ছেন, নাম শাবনূর। সিমেনার নাম ‘চাঁদনি রাতে’। পরে শুনেছি, ছবিটি ফ্লপ করেছিল।
এহতেশামের পাশের রুমে বসতেন সিনেমা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এমবি ফ্লিমসের মালিক আজিজ মোহাম্মদ ভাই। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল, যার বেশির ভাগই ছিল বিভিন্ন নায়িকা প্রসঙ্গে। তিনি কথা বলেন হেসে হেসে আর একটু পরপর নিভে যাওয়া চুরুটে আগুন দেন। তাঁর কথা বলার ধরন এবং চুরুট টানা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল।
১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে একটি টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেই বিজ্ঞাপনের মডেল ছিলেন নওরিন ইসলাম নামে এক তরুণী। তাঁর বাবা ববি ইসলাম ইংরেজি দৈনিক মর্নিং সানের মালিক। ববি ইসলামের ছোট ভাই বান্টি ইসলাম ছিলেন আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বন্ধু। ববির বাড়িতে যাতায়াতের সুবাদে বয়সের বিস্তর ব্যবধান থাকার পরও নওরিনের সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদের সম্পর্ক তৈরি হয়। একপর্যায়ে পরিবারের অমতে আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে বিয়ে করেন নওরিন। সে সংসার এখনো আছে। নওরিন এখন ৩ ছেলে ও ২ মেয়ের মা। তবে নওরিনকে বিয়ে করার আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাই এক পাকিস্তানি তরুণীকে বিয়ে করেছিলেন।
যত দূর শুনেছি, ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের পরিবার ভারতের কানপুর থেকে পুরান ঢাকায় আসে। তাঁরা মূলত পারস্য বংশোদ্ভূত ‘শিয়া’ সম্প্রদায়ের লোক। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের জন্ম ১৯৬২ সালে, আরমানিটোলায়। তাঁর বাবা মোহাম্মদ ভাই ইস্পাত ব্যবসা শুরু করেন। ধীরে ধীরে অলিম্পিক ব্যাটারি, অলিম্পিক বলপেন, অলিম্পিক ব্রেড ও বিস্কুট, এমবি ফার্মাসিউটিক্যালস, এমবি ফিল্মসহ একাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। মোহাম্মদ ভাইয়ের বয়স হয়ে গেলে ব্যবসা দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে ছেলে আজিজ মোহাম্মদের ওপর। এতে খুব কম বয়সে তিনি বিপুল বিত্তের মালিক হন। সেই অর্থের একটি বিরাট অংশ নিজের ভোগবিলাসে ব্যয় করতে থাকেন। তাঁর গুলশানের বাড়িতে ছিল বিশাল একটি বার। সেখানে নিয়মিত পার্টি হতো। দেশের হোমরা-চোমরারা সেই পার্টিতে যেতেন। দেশ ছাড়াও বোম্বের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আসতেন তাঁর বাড়িতে। একবার সেই বাড়ির পার্টিতে উপস্থিত অভিনেত্রী মুনমুন সেন ও মমতা কুলকার্নির ছবিও ছাপা হয়েছিল কাগজে। গুলশান-বনানীর অনেক তরুণী সেই পার্টিতে আসতেন উদ্ভট পোশাক পরে। শুনেছি, এসব পার্টিতে তিনি নিজে কখনো মদপান করতেন না। পার্টির সময় চুরুট হাতে ঘুরে বেড়াতেন। সেসব পার্টিতে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতও আসতেন। আসতেন অনেক অচেনা মানুষ। এঁদের সঙ্গে আলাদা কথা বলতেন আজিজ মোহাম্মদ ভাই।
শোনা যায়, সেই সময়ে নামীদামি অনেক অভিনেত্রী ও তারকার সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বিশেষ সম্পর্ক ছিল। সেই গল্প রসিয়ে রসিয়ে করতেন আর বলতেন, মেয়েদের ‘মন জয়’ করতে তিনি দামি উপহার দিতেন।
আজিজ মোহাম্মদ একবার আমাকে বলেছিলেন, এক বান্ধবী নিয়ে এরশাদের সঙ্গে তাঁর অনেক ঝামেলা হয়। এরপর এরশাদ তাঁকে গ্রেপ্তার করিয়েছিলেন। পরে তাঁকে মুক্ত করতে প্রিন্স করিম আগা খান নিজে বাংলাদেশে আসেন।
ভোগবিলাস নিয়ে আজিজ ভাইয়ের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠলেও প্রথম খুনের অভিযোগ ওঠে জনপ্রিয় চিত্রনায়ক সালমান শাহ মারা যাওয়ার পর। সালমান শাহর মা অভিযোগ করেন, সালমানের স্ত্রী সামিরার সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে আজিজ ভাই তাঁর ছেলে সালমান শাহকে খুন করিয়েছেন। এ ঘটনার দুই বছর পর সোহেল চৌধুরী খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হন তিনি। তবে তিনি সব সময় কিছু না কিছু করে আলোচনায় থাকতেন।
১৯৯৬ সালের শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনায় পুঁজিবাজারবিষয়ক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হয়নি। এর আগে এটিভি নামে একটি স্যাটেলাইট চ্যানেল করেছিলেন তিনি। ব্যাংকক থেকে সেই চ্যানেল সম্প্রচার করা হতো। এ নিয়েও তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হলে চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় এসবি পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তবে খুনের মামলায় জামিন পাওয়ার পর তিনি আর দেশে থাকেননি। বিদেশ চলে যান, আর ফিরেও আসেননি।
আজিজ মোহাম্মদ ভাই দেশে না থাকলেও তাঁর আত্মীয়স্বজনও কম যান না। ২০০৭ সালে ইয়াবা ট্যাবলেট তৈরির জন্য তাঁর ভাতিজা আমিন হুদাকে র্যাব গ্রেপ্তার করে। সে সময় ইয়াবার সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের নাম আসে। ২০১৩ সালে আমিন হুদার ৭৯ বছরের জেল হয়। পরে তিনি কারাগারে মারা যান।
২০১৯ সালের অক্টোবরে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গুলশানের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বিপুল পরিমাণ মদের বোতল, সিসা ও ক্যাসিনোসামগ্রী উদ্ধার করে। ২০২১ সালের আগস্টে এনবিআর তাঁর যাবতীয় ব্যাংক হিসাব জব্দ করে।
আজিজ মোহাম্মদ ভাই এখন পরিবার নিয়ে থাইল্যান্ডে থাকেন। স্ত্রী নওরিন দেশে এসে ব্যবসা দেখেন। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং ও সিঙ্গাপুরে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের হোটেল ও রিসোর্ট আছে। শোনা যায়, মুম্বাইয়ের ডন দাউদ ইব্রাহিমের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। কিন্তু এসব নিয়ে আমি যতবার তাঁর কাছে জানতে চেয়েছি, তিনি বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই ভিত্তিহীন; বরং মিডিয়াই তাঁকে ডন হিসেবে বারবার প্রতিষ্ঠিত করেছে।
জানি না, তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আদৌ সত্য কি না। হয়তো সময়ই বলে দেবে চমকে ঘেরা এই রহস্যময় লোকটি আসলেই কেমন? সূত্র : আজকের পত্রিকা।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ