ঢাকা : কেউ মারা গেলে চাঁদা তুলে মরদেহ দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন মালদ্বীপে বাংলাদেশি প্রবাসীরা। কখনও চাঁদা তুলে ব্যবস্থা না করা গেলে বাধ্য হয়ে মালদ্বীপেই দাফন করা হয়। বৈধ কর্মীদের খরচ কোম্পানি বহন করলেও অবৈধ কর্মীর মরদেহ পাঠাতে প্রবাসীদের চাঁদাই ভরসা। বৈধ-অবৈধ ভেদাভেদ না করে যেকোনও বাংলাদেশির মরদেহ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে দেশে পাঠানোর দাবি জানান মালদ্বীপ প্রবাসীরা।
মালদ্বীপে বেশির ভাগ বাংলাদেশি পর্যটন খাতে কাজ করেন। মাছ ধরার কাজেও যুক্ত আছেন অনেকে। এর বাইরে দোকানের সেলসম্যান, সিকিউরিটি গার্ড, নির্মাণ শ্রমিক হিসেবেও কাজ করেন প্রবাসীরা। পর্যটন নির্ভর দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে প্রায় ১ লাখ বাংলাদেশি আছেন। তাদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার অনিয়মিত (অবৈধ)।
জানা গেছে, যারা নিয়মিত কর্মী তাদের কেউ মারা গেলে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মরদেহ দেশে পাঠানোর খরচ বহন করে থাকে। মূলত নিয়োগচুক্তির আওতায় এ সুবিধা পান তারা। তবে কোনও ক্ষেত্রে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান দায়িত্ব না নিলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মৃতদেহ পাঠানোর ব্যবস্থা করে দূতাবাস। মূলত দেশ থেকে বিদেশ যেতে নির্ধারিত ফি দিয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের সদস্যপদ নিতে হয় বৈধ কর্মীদের। প্রবাসীদের দেওয়া ফি থেকে গঠিত ফান্ড ব্যয় করে কল্যাণ বোর্ড। প্রবাসে কল্যাণ বোর্ডের সদস্য কোনও প্রবাসী মারা গেলে পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে মৃত্যুবরণকারী কর্মীর মৃতদেহ দেশে আনতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। একইভাবে দূতাবাসও কল্যাণ বোর্ডে আবেদন করে মরদেহ দেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে।
১৭ বছর ধরে মালদ্বীপে আছেন নরসিংদীর মামুন আব্দুর রউফ। কোনও প্রবাসী মালদ্বীপে মারা গেলে তার মরদেহ দেশে পাঠানোর জন্য সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য স্বেচ্ছায় শ্রম দেন তিনি।
মামুন আব্দুর রউফ বলেন, ‘মরদেহ দেশে পাঠাতে সরকারি সহযোগিতা পাওয়া যায় না। বৈধরা যেমন দেশে টাকা পাঠান, যিনি অবৈধ তিনিও পাঠান। সবাই বাংলাদেশি। দালালের খপ্পড়ে পড়ে বিদেশে এসে তারা তো পুরোটা সময় কষ্টে পার করেছেন। সরকারি কোনও সুবিধা পাচ্ছেন না। অবৈধ বলে তার দায়িত্ব নেয় না রাষ্ট্র। রাষ্ট্র তার নাগরিকের মরদেহ দেশে নিতে কোনও ব্যবস্থা নেবে না—এটা মেনে নেওয়া কষ্টের।’
মালদ্বীপ প্রবাসীরা বলছেন, একজন প্রবাসীর মরদেহ দেশে পাঠাতে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়। কেউ মারা গেলে মরদেহ মর্গে রাখতে হয়। মালদ্বীপে প্রতিদিন মর্গের বিল দিতে হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। কোনও অবৈধ কর্মী মারা গেলে তারা মরদেহ দেশে পাঠানোর আগে পুলিশ রিপোর্ট, হাই কমিশনের ছাড়পত্রসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতায় সময় বেশি লেগে যায়। কোনও অবৈধ কর্মীর যদি পাসপোর্ট না থাকে তাতে আরও সময় বেশি প্রয়োজন হয়।
মালদ্বীপ প্রবাসী জনকল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি মো. আব্দুল কাদের বলেন, ‘মালদ্বীপে যারা অনিয়মিত হয়ে গেছেন, তাদের বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কেউ মারা গেলে তার মরদেহ পাঠাতে আমারা চাঁদা তুলে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। সরকারি উদ্যোগে কখনও কখনও শুধু বৈধকর্মীদের মরদেহ দেশে পাঠানো হয়।’
আব্দুল কাদের বলেন, ‘মরদেহ দেশে পাঠাতে বিমান ভাড়া যোগাড় করতেই আমাদের কষ্ট হয়ে যায়। ভাড়ার টাকা জোগাড় করতে দেরি হলে মর্গের বিল বাড়তে থাকে। সব সময় সবার ক্ষেত্রে টাকা জোগড়া করতেও পারি না। তখন বাধ্য হয়ে মালদ্বীপেই দাফন করা হয়। চেষ্টা করি মৃত প্রবাসীদের পরিবারকে সামান্য হলেও আর্থিক অনুদান দিতে।’
এই প্রবাসী আরও বলেন, ‘প্রত্যেক প্রবাসী চান নিজের দেশের মাটিতে তার দাফন হোক। পরিবারও শেষবারের মতো মুখটা দেখতে চায়। এই চাওয়াটা খুব বেশি নয়। আমরা চাই, সরকার কোনও প্রবাসী মারা গেলে তার মরদেহ দেশে পাঠানোর উদ্যোগ নিক।’
মালদ্বীপে ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করছেন মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি মালদ্বীপে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন-বাংলাদেশ কমিউনিটি ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, ‘একমাত্র মালদ্বীপিয়ান এয়ারলাইনস মরদেহ বহন করে। প্রায় ১ লাখ টাকা বিমান ভাড়া দিতে হয়। প্রতিদিন তাদের ফ্লাইট নেই। ফলে তাদের ফ্লাইটের জন্যও মরদেহ মর্গে রাখতে হয়। টাকার জন্য একজন প্রবাসীকে তার পরিবার শেষ দেখা দেখতে পারবে না, তা হয় না। এ জন্য সরকারের আশায় বসে না থেকে প্রবাসীরা যার যার সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করেন। মানবিক দৃষ্টিকোন থেকে আমরা আশা করি, সরকার প্রবাসীর মরদেহ দেশে আনার ব্যবস্থা করবে।’
এ প্রসঙ্গে মালদ্বীপে বাংলাদেশের হাই কমিশনার রিয়ার অ্যাডমিরাল নাজমুল হাসান বলেন, ‘এটি একটি মানবিক বিষয়। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী মিশনকে স্বল্প পরিমাণের বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই বরাদ্দ থেকে টাকা খরচ করার ক্ষেত্রে প্রতিটি ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের লিখিত অনুমতি নিতে হয়। আর মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেয়, নিয়মিত প্রবাসীকর্মী এবং যাদের বিএমইটি কার্ড আছে তাদের ক্ষেত্রে সুবিধা দেওয়া হয়। এর মানে এই নয় যে, অনিয়মিতদের ক্ষেত্রে বরাদ্দ দেওয়া যাবে না। তবে অনিয়মিতদের ক্ষেত্রে দেওয়া হলে যে লোকটি চাঁদা দিয়ে বোর্ডের সদস্য হলেন, তার ওয়েলফেয়ারের টাকা দিয়ে এমন একজনকে সুবিধা দিচ্ছি, যিনি বোর্ডের চাঁদা দেয়নি বা বোর্ডের সদস্য হয়নি; এ বিষয়টা অনেক সময় প্রবাসীদের স্বজনরা বুঝতে চান না।’
নাজমুল হাসান বলেন, ‘আমরা অনেক সময়ই অনিয়মিতদের জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি চাই। মন্ত্রলায়ের অনুমতি পেলে দেওয়া চেষ্টা করি। এখানে প্রবাসীদের কল্যাণমূলক কিছু সংগঠন আছে, তারাও চাঁদা দিয়ে মৃতদেহ পাঠাতে সহায়তা করে।’ সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন।
সোনালীনিউজ/এমএমএইচ