ঢাকা : বিএনপিতে অনেক ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ফলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে বারবার হোঁচট খাচ্ছে দলটি। ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচি ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হিসাবে সমন্বয়হীনতা চিহ্নিত করেছে দলটির হাইকমান্ড। শুধু দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে নয়, প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক জোরদারেও বড় বাধা হিসাবে দেখা দিয়েছে সমন্বয়হীনতা।
এতে বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির (এফআরসি) কার্যক্রম অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছে। আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এ কমিটির তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন হলেও প্রতিষ্ঠার পর মাত্র একটি বৈঠক হয়েছে। কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে অনেক সদস্যকে জানানো হচ্ছে না। কয়েকজন মিলে গড়ে তোলা হয়েছে একটি সিন্ডিকেট। তারই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।
অনেক সদস্যই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন। ফলে কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের পরিবর্তে দিনদিন আরও কমছে। সব মিলিয়ে এফআরসির কার্যক্রমে হতাশ নীতিনির্ধারকরা। সমন্বয়হীনতার কারণে ক্ষুব্ধ হাইকমান্ডও।
জানা যায়, কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদারে বরাবরই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে বিএনপি। একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে পরিচিত অনেক দেশই এখন বিএনপির পক্ষে নেই। আবার যারা সরকারের বিপক্ষে রয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর নানা অনিয়মের বিষয় আলোচনায় এলেও আন্তর্জাতিক মহলে তা ভালোভাবে তুলে ধরতে পারেনি দলটি।
এমন পরিস্থিতিতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে ২১ সদস্যের ফরেন রিলেশন কমিটি (এফআরসি) গঠন করা হয়।
[205350]
কমিটি গঠনের পর থেকেই কয়েকজন মিলে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়। কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক বা কূটনীতিকদের সম্মানে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজনে ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। তাদের ভয়ে কেউ নাম প্রকাশ করে এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। তবে নাম গোপন রাখার শর্তে অনেক জ্যেষ্ঠ নেতাও তথ্য দিয়েছেন। কমিটির অন্যতম সদস্য শামা ওবায়েদ বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না। আপনারা কমিটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
জানা যায়, ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সম্মানে বিএনপির অনুষ্ঠানে বিদেশিদের উপস্থিতি দিনদিন কমছে। সম্প্রতি বিএনপির এমন দুটি কর্মসূচিতে হাতেগোনা কয়েকটি দেশের প্রতিনিধি এসেছেন। কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে বৈঠকের আলোচ্যসূচি গণমাধ্যমে ব্রিফ না করায় দুই অঞ্চলের সঙ্গে বিএনপির বিদেশ কমিটির সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।
এর একটি দেশ ইউরোপে, অন্যটি এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চল। বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ঢাকায় নিযুক্ত অধিকাংশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক শিষ্টাচার মানা হচ্ছে না। রুটিন ব্রিফিং কিংবা বিশেষ বৈঠক ছাড়া দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের কোনো চেষ্টা হয় না। ফলে বিদেশিদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক কমিটির সুসম্পর্ক গড়ে উঠেনি।
বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে বিদেশিদের ধারণা দিতে বিএনপি গঠিত আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করে থাকে। ২৯ জুলাই অবস্থান কর্মসূচি দেওয়ার আগে আন্তর্জাতিক কমিটির শীর্ষ নেতা বলেছেন, বিদেশিরা শক্তভাবে মাঠে নেমে যেতে বলেছেন। কিন্তু অবস্থান কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হামলার পর প্রত্যাশিতভাবে বিদেশিরা প্রতিক্রিয়া জানাননি।
[205325]
ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। ২ আগস্ট এ সম্পর্কে কূটনীতিকদের ব্রিফ করা হয়। সেখানে মাত্র ৯টি দেশের প্রতিনিধি এসেছেন। কোনো দেশের রাষ্ট্রদূত আসেননি। কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা দূতাবাসের কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছেন, যারা কূটনীতিক নন। অথচ অনুষ্ঠান আয়োজকদের পক্ষ থেকে বলা হয়, সেখানে ২৫টি দেশের কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন।
এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকরা চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নীতিনির্ধারকদের একজন ফরেন কমিটির এক সদস্যকে উদ্দেশ করে বলেন, যে অনুষ্ঠানে একজন রাষ্ট্রদূত উপস্থিত করতে পারবে না, সেখানে আমাদের ডাকার প্রয়োজন নেই। এরপর ১৪ আগস্ট রাজধানীর গুলশানে একটি সেমিনারে বিদেশিদের আমন্ত্রণ করা হলে তাতে মাত্র চারটি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন।
কমিটির সদস্যদের অভিযোগ, বিদেশিদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কমিটির সম্মিলিত কোনো প্রয়াস নেই। সদস্যদের মধ্যে কোনো ধরনের সমন্বয় নেই। আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির কোনো কর্মসূচির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ত করা হয় না। কমিটির সদস্য হিসাবে কর্মসূচিতে উপস্থিত থাকতে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়।
এফআরসির সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে কয়েক মাস আগে বেশ সক্রিয় দেখা যায়। যে কোনো অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি লক্ষ করা গেছে। কিন্তু সম্প্রতি তাকে আর দেখা যাচ্ছে না। সিন্ডিকেট তাকে এড়িয়ে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রুমিন ফারহানা বলেন, আমাকে প্রয়োজন মনে করেনি, তাই ডাকে না। তবে বিদেশি দূতাবাস বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে তার নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি।
সম্প্রতি মার্কিন দুই কংগ্রেসম্যানের সঙ্গে বিএনপি পৃথক বৈঠক করতে চেয়েও পারেনি। এর আগে আইআরআই-এর প্রতিনিধি বাংলাদেশ সফরে বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কমিটির সঙ্গে বৈঠক করতেও ব্যর্থ হয়। অবশ্য বিএনপির এক নেতার ব্যক্তিগত নৈশভোজে অংশ নেন আইআরআই-এর ওই প্রতিনিধি।
আইআরআই সম্প্রতি বাংলাদেশ বিষয়ে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটি আগে থেকে পেয়েও গোপন করেছে। ফলে রিপোর্টের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য স্টাডি করতে পারেনি। বিএনপির দেওয়া প্রতিক্রিয়া দুর্বল ছিল বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
বিএনপির আন্তর্জাতিক কমিটির দুই সদস্য কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। বেশ কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্র থাকলেও স্টেট ডিপার্টমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করতে পারেননি ওই দুই নেতা।
কমিটির অন্য সদস্যদের সহায়তায় কোনো কাজে সফলতা পেলে ওই সিন্ডিকেট তা নিজেদের চেষ্টায় হয়েছে বলে হাইকমান্ডের কাছ থেকে বাহবা নিচ্ছে। শুরুর দিকে হাইকমান্ড বিষয়টি না জানলেও এখন আসল ঘটনা সম্পর্কে অবহিত। তাছাড়া কমিটির সদস্যরাও তাদের এ কৌশল সম্পর্কে জানার পর এখন আর আগের মতো সহায়তা করছে না। ফলে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে ওই সিন্ডিকেট।
সূত্র জানায়, প্রভাবশালী একটি দেশের পক্ষ থেকে বিএনপির হাইকমান্ডকে বলা হয়েছে, কূটনৈতিক উইংয়ের শীর্ষ এক নেতার সম্পর্কে তাদের অবজারভেশন রয়েছে। তার ডাকে তারা সাড়া দেবে না। সম্প্রতি জার্মানির পক্ষ থেকেও একই কথা বলা হয়েছে। অথচ এসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে অন্য কাউকে দায়িত্বও দেওয়া হচ্ছে না।
কূটনৈতিক উইংয়ের মূল ভূমিকা পালনকারী বেশির ভাগ সদস্যেরই প্রতিবেশী একটি দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রায় প্রতিদিন তারা ওই দেশটির সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। কিন্তু ওই দেশটিকে এখনো বিএনপি সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা দিতে পারেনি।
জানা যায়, সিন্ডিকেটটি নিজেরা কাজ করতে না পারলেও অন্যকেও কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে না। বাংলাদেশে নিযুক্ত প্রতিটি দেশের দূতাবাসে ওই সিন্ডিকেট একটি চিঠি দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দলের পক্ষ থেকে তিনজন আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ রাখবে। এর বাইরে কারও সঙ্গে যোগাযোগ না রাখতে বলা হয়েছে। ফলে কমিটির অন্য সদস্যদের অনেকের সঙ্গে কয়েকটি দেশের প্রতিনিধির নিয়মিত যোগাযোগ হলেও তারা সেটাকে ব্যক্তিগত বলে এড়িয়ে যাচ্ছেন।
এফআরসির এক সিনিয়র সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কোনো দেশের দূতাবাসে গিয়ে নোংরামি করার নাম ডিপ্লোমেসি নয়। ডিপ্লোমেসি জানতে হলে ভূরাজনীতি সম্পর্কে জানতে হয়। বিশ্বের কোথায় কী ঘটছে সে সম্পর্কে আপডেট থাকতে হয়।
কিন্তু যারা কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছে, তারা এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এমনকি আমাদের সিনিয়র নেতাদের সুযোগও দিচ্ছেন না।
হাতেগোনা কয়েকজন যারা কাজ করছেন, তারাই নিজেদের হাইপ্রোফাইল ভাবেন। বাকিরা তাদের কাছে কোনো নেতাই মনে হয় না। ফলে সুযোগ থাকার পরও আমরা প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনে ব্যর্থ হচ্ছি। এখনো সময় আছে হাইকমান্ডকে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। সূত্র : যুগান্তর
এমটিআই