ঢাকা : বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়ানোর কৌশল হিসাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে নমনীয় আওয়ামী লীগ। ফলে বিএনপিবিহীন নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি আসনেই দলীয় প্রার্থীর বাইরে দলেরই আরও এক বা একাধিক নেতা নেমেছেন ভোটের লড়াইয়ে। এতে বিপাকে আওয়ামী লীগের তৃণমূল।
বেশিরভাগ আসনেই দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী এবং দলেরই স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে থাকায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছেন নেতাকর্র্মীরা। এতে তৃণমূলে বাড়ছে অভ্যন্তরীণ সংকট। পাশাপাশি প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পর গত কয়েক দিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা-ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
বিষয়টি এখনই সমাধান করা না গেলে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে-এমন আশঙ্কা তৃণমূল নেতাকর্মীদের। তাদের মতে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আসা জরুরি। সুস্পষ্ট নির্দেশনা না এলে নির্বাচনের পরও এর নেতিবাচক প্রভাব স্থানীয় রাজনীতিতে পড়বে।
যদিও আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, কৌশলগত কারণেই তাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তৃণমূলের করণীয় কী হবে তা ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আমরা চাই অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন। তাছাড়া আইনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচনের বিধান রয়েছে। তাছাড়া কৌশলগত কারণে দলকে অনেক সময় অনেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আবার সুনির্দিষ্ট রূপরেখাও দেওয়া হয়। সময়ের ব্যবধানে কৌশল ও সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট করেই নির্দেশনা দেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সেটা মেনেই নির্বাচন করবেন।
এদিকে রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে স্বার্থে আওয়ামী লীগের এই সিদ্ধান্ত বা কৌশল ঠিক আছে। কিন্তু দলের শৃঙ্খলা যেন কোনোভাবেই বিঘ্নিত বা লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকেও দলের নেতাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
[213070]
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, নির্বাচন যেন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়, সেই জায়গা থেকেই আওয়ামী লীগ স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনুমোদন দিচ্ছে। আমি আশা করি ১৭ তারিখের মধ্যে সুনির্দিষ্ট একটা চিত্র পাওয়া যাবে। কোথায় স্বতন্ত্র দাঁড়ানোর জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে, কোথায় নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। দলও তার নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে খবর নেবে সার্বিক অবস্থা কী। সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানোর জন্য কী করা দরকার, সে ব্যবস্থাও নেবে।
তিনি আরও বলেন, কিন্তু প্রার্থীদেরও মনে রাখতে হচ্ছে, নির্বাচন যেন স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ হয়। দলের প্রার্থীর সঙ্গে তার (দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী) প্রতিযোগিতা হবে। সেখান থেকে এলাকার জনপ্রিয় মানুষটিই জনপ্রতিনিধি হয়ে সংসদে আসবেন। কিন্তু দলের শৃঙ্খলা যেন কোনোভাবেই বিঘ্নিত না হয়, লঙ্ঘিত না হয় সেদিকে দলের নেতাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। নির্বাচন কমিশনও সার্বিকভাবে এ বিষয়গুলো মনিটরিংয়ে রাখবে বলেও আমি বিশ্বাস করি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ বলেন, বিএনপি যেহেতু নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, তাই বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা এড়াতে এই ভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা তারা গ্রহণ করেছে। এখন দুটো দিক রয়েছে-একটা হলো নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হতে হবে। এটা সরকার ও ক্ষমতাসীন দলেক নিশ্চিত করতে হবে। এটা তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এখানে দলের প্রার্থীর বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়িয়েছে এবং সেটা দলের সম্মতিতেই দাঁড়িয়েছে। এখন এই বিষয়টাকে দল কতটা ছন্দময় করে অর্থাৎ তালগোল পাকিয়ে না ফেলে সেটা দেখার বিষয়। আমি মনে করি সেখানে দলের বড় ধরনের দায়িত্ব রয়েছে। কারণ এই ধরনের কাজ বিগত দিনে হয়নি। এবারই প্রথম এটা হলো।
তিনি আরও বলেন, এবারের নির্বাচন শুধু আওয়ামী লীগ বা নির্বাচন কমিশনের জন্য নয়, জাতির জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জটা হলো এই- বিদেশিরা আজকে আমাদের নির্বাচন নিয়ে নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছে, নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বৈরী পরিবেশ ছিল। কিন্তু আমরা জাতি হিসাবে যুদ্ধ করেই দেশ স্বাধীন করেছি। এখন আমরা জাতি হিসাবেও উন্নত সংস্কৃতির অধিকারী। বিশেষ প্রয়োজনে যে আমরা উদাহরণ তৈরি করতে পারি, সেটা এই নির্বাচনেও দেখাতে হবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশ আসনের বিপরীতে ৩৩৬২টি দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছিল আওয়ামী লীগ। প্রতিটি আসনে গড়ে প্রার্থী ছিল ১১ জনের বেশি। তাদের মধ্যে ২৯৮ আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছে দলটি। ফলে প্রতি আসনে গড়ে ১০ জন করে মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বিএনপির না আসা ও প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার ওপর ভরসা রেখে তাদের অনেকেই প্রার্থী হয়েছেন। আবার টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে অনেক এমপির স্বজনপ্রীতির কারণে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বেড়েছে দূরত্ব। সেই ক্ষোভ থেকে মনোনয়নবঞ্চিত, নির্যাতিত ও নিপীড়িতরা একাট্টা হচ্ছেন বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে।
আবার অনেক স্থানে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন, তাদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে দল করেন। এমন নেতারা দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ায় নেতাকর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। আবার অনেকে কোন পক্ষে অবস্থান নেবেন, তা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় রয়েছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগের জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা বলেন, এটা (দলের প্রার্থী ও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী) নিয়ে তো বিভিন্ন জায়গায় সমস্যা হচ্ছে, আমরাও শুনছি। কিন্তু আমরা কিছু বলতেও পারছি না। আশা করছি শিগগিরই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা আসবে। এখন সেটার অপেক্ষাতেই আছি।
রাজশাহী বিভাগের এক জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, আমাদের কাছে দলের প্রার্থীই শেষ কথা। কিন্তু দ্বিধাবিভক্তি তো আছেই। কারণ নৌকার প্রার্থীর বাইরে আমাদেরই আরও অনেকে প্রার্থী হয়েছেন। দলের মধ্যকারই একটা অংশ তাদের সঙ্গেও আছে। আমরা তো চাইলেও এবার এর সমাধান করতে পারছি না।
ময়মনসিংহ-১ আসনে বর্তমান সংসদ-সদস্য জুয়েল আরেং নৌকা প্রতীক নিয়ে মাঠে রয়েছেন। তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হালুয়াঘাট উপজেলা পরিষদের সদ্য পদত্যাগ করা চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক সায়েম।
বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় মূলত লড়াইটা হবে নৌকার প্রার্থী বর্তমান সংসদ-সদস্য জুয়েল আরেং বনাম স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহমুদুল হক সায়েমের মধ্যে-এমনটাই ধারণা করছেন সাধারণ ভোটাররা। শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং ধোবাউড়া উপজেলায় বিভক্ত আওয়ামী লীগ সব মিলে কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে নৌকা।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হোসাইন এবং উপজেলা চেয়ারম্যান ডেভিড রানা চিসিমের নেতৃত্বে নৌকাকে বিজয়ী করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন নেতাকর্মীরা।
অপরদিকে সম্পাদক প্রিয়তোষ বিশ্বাস বাবুলের নেতৃত্বে পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহমুদুল হক সায়েমের পক্ষে কাজ করছেন একটা অংশ। তারা জুয়েল আরেংয়ের পরিবর্তন চায়।
কুমিল্লা-৬ সদর সংসদীয় আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে আওয়ামী লীগের পরিবার দুটি। এই আসনে নৌকার মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান সংসদ-সদস্য এবং কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ. ক. ম বাহাউদ্দীন বাহার। তার বিপরীতে স্বতন্ত্র থেকে প্রার্থী হয়েছেন প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আফজল খানের মেয়ে সংরক্ষিত আসনের সংসদ-সদস্য আঞ্জুম সুলতানা সীমা। নির্বাচন ঘিরে এই পরিবার ও তাদের কর্মী-সমর্থকরা ফের বিভক্ত ও মুখোমুখি হন।
শুধু ময়মনসিংহ-১ বা কুমিল্লা-৬ আসন নয়। এমন চিত্র আরও অনেক জায়গাতেই। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন স্থানে দলের নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যেও এসেছে। কয়েকটি জায়গায় এসব দ্বন্দ্ব সংঘর্ষের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কোথাও নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকরা হামলা করছে। আবার কোথাও স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করছে নৌকার প্রার্থীর সমর্থকরা। এই হামলা ও হামলার শিকার দুই পক্ষই আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। এছাড়া কোথাও নৌকার প্রার্থীর মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করছে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী। আবার কোথাও দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর মনোনয়ন বাতিল চেয়ে ইসিতে আবেদন করছে নৌকার প্রার্থী।
গত ২৯ নভেম্বর কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমদের সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ১২ জন আহত হন। সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নবী হোছাইনের নেতৃত্বে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সালাহ উদ্দিন আহমদ। নবী হোছাইন বর্তমান সংসদ-সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলমের অনুসারী।
গত ৩০ নভেম্বর গাইবান্ধার-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফারহানা রাব্বি বুবলি ও তার সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময়ের ৮টি মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও আটজন আহত হয়। বুবলির অভিযোগ নৌকার প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকরা এ হামলা করে।
তৃণমূল নেতাদের আশঙ্কা-১৭ ডিসেম্বরের (প্রার্থীরা প্রত্যাহারের শেষ দিন) আগেই এ বিষয়ে দলকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে হবে। তা না হলে নির্বাচনি মাঠে এ দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করতে পারে। বিষয়টি নিয়ে দলের আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকেও ভাবা হচ্ছে।
দলটির নেতারা বলছেন, দলের প্রার্থীদের অসুবিধার বিষয়টিও তারা গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন। ডামি প্রার্থীর সুযোগ নিয়ে কাউকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ তারা দেবেন না। এখনো তো সময় আছে। সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনা করেই নেওয়া হবে। সে নির্দেশনা মেনেই সবাইকে ভোটের মাঠে কাজ করতে হবে। সূত্র : যুগান্তর
এমটিআই