ঢাকা : দেশে সমকামী পুরুষের মধ্যে এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্তের হার বেড়েছে। এইচআইভি-এইডসে আক্রান্তদের ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ সমকামী।
এদিকে, এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত ২৭ শতাংশের বেশি এখনো শনাক্তের বাইরে। শনাক্তের বাইরের রোগীরা সংক্রমণ বেশি ছড়ায় বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচি সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, দেশে এইচআইভি-এইডসে আক্রান্তদের শনাক্ত, তাদের চিকিৎসার আওতায় আনা, সংক্রমণ প্রতিরোধ ও এ সংক্রমণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচি। সরকারের চতুর্থ হেলথ নিউট্রিশন অ্যান্ড পপুলেশন সেক্টর প্রোগ্রামের (এইচএনপিএসপি) আওতায় এ কর্মসূচি চলছে। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৩০ জুন। প্রকল্প মেয়াদের শেষপর্যায়ে এ খাতে অর্থ বরাদ্দ কমে গেছে। ফলে এইচআইভি-এইডস নিয়ন্ত্রণের কাজ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি কর্মসূচির তথ্য বলছে, দেশে এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত সম্ভাব্য রোগীর সংখ্যা ১৫ হাজার ১৪৩ জন। এর মধ্যে শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ৯৮৪ জন। এখনো শনাক্তের বাইরে রয়েছে ৪ হাজার ১৫৯ জন। শনাক্তের বাইরে থাকা এইচআইভি-এইডসের সংক্রমণ বেশি ছড়াচ্ছে।
এইডস/এসটিডি কর্মসূচির তথ্যমতে, দেশে এই ভাইরাসের আক্রান্তদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ পুরুষ, ২৪ শতাংশ নারী ও এবং ১ শতাংশ হিজড়া/ট্রান্সজেন্ডার। এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত তাদের মধ্যে সবচেয়ে হচ্ছে সমকামী। এ সংখ্যা আক্রান্তদের ২৭ দশমিক ৭০ শতাংশ।
[221215]
এরপরের অবস্থানে রয়েছে সাধারণ মানুষ ২৭ শতাংশ, প্রবাসী ১৭ দশমিক ৬০ শতাংশ, ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারী ১৩ দশমিক ১০ শতাংশ, রোহিঙ্গা শরণার্থী ১২ দশমিক ৪০ শতাংশ, ট্রান্সজেন্ডার ১ দশমিক ৩০ শতাংশ, নারী যৌনকর্মী শূন্য দশমিক ৪০ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোজাহারুল হক বলেন, সমকামীদের মধ্যে এর এইচআইভি-এইডসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগের বিষয়। সমকামীদের মধ্যে এই ভাইরাসের সংক্রমণ কমাতে হলে এইডস কীভাবে ছড়ায় তার নিয়ে প্রচার-প্রচারণা ও কাউন্সেলিং করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মোজাহারুল হক আরও বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালে বিশ্বে থেকে এইডস নির্মূলে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দ্বিতীয় ট্র্যাক স্ট্র্যাটেজি ৯৫-৯৫-৯৫ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। এ স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী এইচআইভিতে আক্রান্তদের শতকরা ৯৫ জনকে শনাক্ত করতে হবে। শনাক্তকৃতদের ৯৫ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে এবং চিকিৎসাধীন ৯৫ শতাংশের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিন্তু দেশে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। এটি অর্জন করতে হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও বেশি যত্নবান হয়ে কাজ করতে হবে।
এইচআইভি-এইডস সংক্রমণ প্রতিরোধে সংক্রমিতদের শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় আনা এবং বিদেশ ফেরত প্রবাসীদের বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে সংক্রমণ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি জানান।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশের ২৩টি জেলায় এইচআইভি পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। যারা শনাক্ত হয় তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে ১৩টি কেন্দ্রে।
এ ছাড়া এইচআইভি-এইডস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি কর্মসূচির সহযোগী হিসেবে সেভ দ্যা চিলড্রেন, আইসিডিডিআরবি, আইইডিসিআর ও ঢাকা বাংলাদেশ কাজ করছে। তারা এইচআইভি-এইডসে আক্রান্তদের খুঁজে বের করা, তাদের পরীক্ষার আওতায় আনা, ঝুঁকি হ্রাসে কনডম বিতরণ করাসহ অন্যান্য কাজগুলো করে থাকে। আক্রান্তদের চিকিৎসার ওষুধসহ যাবতীয় কাজে মাসে ১০০ কোটি টাকার বেশি খরচ হয়। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদের শেষপর্যায়ে অর্থের বরাদ্দ কমে যাওয়ায় এইচআইভি-এইডস কর্মসূচি কাজে কিছুটা ধীরগতি নেমে এসেছে।
[221207]
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, বাংলাদেশ এইচআইভি সংক্রমণের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। তারপরও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সংক্রমণ ঝুঁকিতে রয়েছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী প্রতিটি দেশে সংক্রমণ অনেক বেশি। এসব দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের অবাধ যাতায়াত রয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে দেশে ফেরত আসা লোকদের একটি অংশ এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত। আবার আমাদের দেশের প্রায় ৪ হাজারের বেশি এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত মানুষ শনাক্তের বাইরে রয়ে গেছে।
এ সংখ্যাও কম নয়। যারা আক্রান্ত তারা নিজেরা জানেন না যে তাদের এইচআইভি-এইডসের জীবাণু শরীরে রয়েছে। ফলে তারা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনসহ সকলের সঙ্গে অন্য সবার মতো চলাফেরা করে। এইচআইভির সংক্রমণ যেসব মাধ্যম দ্বারা ছড়ায় তারা সেগুলোর দ্বারা অন্যদের সংক্রমিত করছে।
তারা আরও বলেছেন, এইডসে আক্রান্ত অনেকে সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে সংক্রমণের বিষয়টি গোপন রাখেন। তাদের দ্বারাও অন্যরা আক্রান্ত হয়। এইচআইভি-এইডস বেশি ছড়ায় শনাক্তের বাইরে থাকা আক্রান্তদের দ্বারা। যারা এইচআইভি-এইডসে আক্রান্ত তাদের শনাক্ত করে চিকিৎসার আওতায় আনা, এইচআইভি সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি ও কুসংস্কার দূর করার মাধ্যমে এ রোগের সংক্রমণ কমানো সম্ভব।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এইডস/এসটিডি কর্মসূচির সিনিয়র ম্যানেজার মো. আক্তারুজ্জামান জানান, এইডস একটি বৈশ্বিক রোগ। মানুষ এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলাচলের সঙ্গে সঙ্গে এই রোগের বিস্তার বিশ্বব্যাপী। বিশ্বের প্রায় ৩৯ মিলিয়ন মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভিতে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। বর্তমানে বাংলাদেশে আক্রান্তের আনুমানিক সংখ্যা ১৫ হাজার ১৪৩ জন। এখন পর্যন্ত দেশে ১০ হাজার ৯৮৪ জন শনাক্ত হয়েছে। যারা শনাক্ত হয়েছে তাদের ৭৫ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় এসেছে।
তিনি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালে বিশ্বে থেকে এইডস নির্মূলে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের দ্বিতীয় ট্র্যাক স্ট্র্যাটেজি ৯৫-৯৫-৯৫ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ। এ স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী এইচআইভিতে আক্রান্তদের শতকরা ৯৫ জনকে শনাক্ত করতে হবে। শনাক্তকৃতদের ৯৫ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে এবং চিকিৎসাধীন ৯৫ শতাংশের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। কিন্তু দেশে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। এইচআইভিতে আক্রান্ত ৯৫ জনের মধ্যে ৭৩ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্তকৃতদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে আর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশের ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে দেশের প্রতিটি জেলায় এইচআইভি পরীক্ষার সুযোগ না থাকা।
আক্তারুজ্জামান জানান, বাংলাদেশের ২৩টি জেলায় এইচআইভি পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে দেশের প্রতিটি জেলায় পরীক্ষা কেন্দ্র স্থাপন; দেশের সরকারি হাসপাতালে শিরায় মাদক গ্রহণকারী, যৌনকর্মী, তৃতীয় লিঙ্গ এবং সমকামীদের মধ্যে এইচআইভি-এইডসের চিকিৎসা নিশ্চিত করা; এইচআইভি এইডস আক্রান্ত জনগোষ্ঠী নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে কুসংস্কার, ভ্রান্ত ধারণা ও বৈষম্য রয়েছে তা দূর করাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, এইচআইভি-এইডস প্রতিরোধে এইডস/এসটিডি কর্মসূচির সহযোগী হিসেবে সেভ দ্যা চিলড্রেন, আইসিডিডিআরবি, আইইডিসিআর ও ঢাকা বাংলাদেশ কাজ করছে। তারা এইচআইভি-এইডসে আক্রান্তদের খোঁজে বের করা, তাদের পরীক্ষার আওতায় আনা ও ঝুঁকি হ্রাসে কনডম বিতরণ করাসহ অন্যান্য কাজগুলো করছে। তবে প্রকল্পের বরাদ্দ কম হওয়ায় কিছু কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।
জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল কর্মসূচির তথ্য বলছে, প্রতিবছর দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে এইচআইভি আক্রান্তের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। যেখানে দেখা গেছে, মধ্যপ্রাচ্য ফেরত অভিবাসী ও কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গারা এতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য যাওয়ার আগে সবার এইচআইভি পরীক্ষার বিধান রয়েছে। কিন্তু কেউ দেশে ফেরত আসার পর এইচআইভি পরীক্ষা বাধ্যতামূলক নয়। ফলে ফেরত আসা কেউ এইচআইভি আক্রান্ত কিনা তা শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
বাংলাদেশে এইডস নিয়ন্ত্রণে নানামুখী চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে জানান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুসারে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে এইচআইভি বা এইডস রোগ নির্মূলের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এসডিজির প্রথম শর্ত অনুসারে, এ সময়ের মধ্যে ৯৫ শতাংশ এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করার বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু এ পর্যন্ত মাত্র ৭৩ শতাংশ রোগী শনাক্ত করা গেছে। বিশেষ করে দেশের সব সরকারি হাসপাতালে এইচআইভি পরীক্ষা এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। এতে সঠিক সময় চিকিৎসার আওতায় আনা যাচ্ছে না এইডস রোগী। প্রান্তিক অঞ্চলে এই সংকট আরও বেশি।
এ ছাড়া বাংলাদেশে এইডস আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল নেই। সারা দেশে মাত্র ১৩টি প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র রয়েছে।
যেভাবে সংক্রমণ ছড়ায় : চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলেছেন, মানবদেহে বিভিন্নভাবে এইডস রোগের সংক্রমণ ঘটতে পারে। এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা বীর্য বা জরায়ু রসের সঙ্গে যদি সুস্থ কোনো ব্যক্তির রক্ত, শরীর রস বা মিউকাস আবরণের সংস্পর্শ ঘটে, তবে এইচআইভি তথা এইডস রোগের বিস্তার ঘটে। এসব সংস্পর্শ নানাভাবে ঘটতে পারে, যেমন- অবাধ যৌনাচার, এইডস আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত শরীরে ধারণ বা গ্রহণ, অঙ্গ প্রতিস্থাপন বা দাঁতের চিকিৎসা বা অপারেশনসহ আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সিরিঞ্জ ব্যবহার।
সংক্রমণ থেকে বাঁচার উপায় : জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলে এইচআইভির সংক্রমণ থেকে মানুষ মুক্ত থাকতে পারে। যেমন- অবাধ যৌনাচার বন্ধ করা, কনডমের ব্যবহার নিশ্চিত করা, রক্ত সংগ্রহের আগে রক্তদাতার রক্ত পরীক্ষা করা, গর্ভাবস্থায় মায়ের এইডস ছিল কিনা তা পরীক্ষা করা, সুচ-সিরিঞ্জ জীবাণুমুক্ত করে ব্যবহার করা, মাদকদ্রব্য সেবন থেকে বিরত থাকা, এইডস থেকে নিজেকে ও সমাজকে রক্ষা রাখতে হলে সামাজিক আন্দোলন জোরদার করতে হবে।
এমটিআই