ঢাকা : প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে করোনায়। আক্রান্ত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ। হাসপাতালগুলোতে কোনো শয্যা খালি নেই। গেটে বহু রোগী ভর্তি হওয়ার আশায় অপেক্ষা করছে। রোগীর সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকরা। কাকে আগে চিকিৎসা দেবে তা নিয়ে দ্বিধান্বিত তারা। কিন্তু তারপরও তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। অক্সিজেনের মজুত যখন ফুরিয়ে আসে, তখন তাদের বেছে নিতে হয়-মুমূর্ষু রোগীদের মধ্যে কে পাবেন ওই অমূল্য সম্পদ। চাপ সামলাতে গিয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং করতে হচ্ছে। এটা এখন নিত্য চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতে। খবর : নিউইয়র্ক টাইমস
মহামারীর কঠিন এই লড়াইয়ে অনেক রোগীর প্রাণ বাঁচানো যাচ্ছে না চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাবে। এতে চিকিৎসায় নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মনের বোঝা কেবলই বাড়ছে। সেই ভার যে কতটা অসহনীয়, তা বোঝা যায় নয়াদিল্লির সবচেয়ে বড় কোভিড-১৯ হাসপাতালে মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. ম্রাদুল কুমার দাগার কথায়। বলেন, সারা জীবন ধরে নিজেকে প্রস্তুত করলেন শুধু একটা লক্ষ্যের জন্য-যেভাবে হোক রোগীকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু এখন যদি আপনাকে বেছে নিতে হয়- কাকে আগে বাঁচাবেন, এই অবস্থাটা একবার শুধু কল্পনা করুন। একজন চিকিৎসককে যখন এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, তার চেয়ে হূদয়বিদারক আর কিছু হতে পারে না। গত তিন সপ্তাহ ধরে আমাদেরকে সেই কাজটাই করতে হচ্ছে।
মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভারতজুড়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। মৃত্যুর এই তালিকায় থাকছেন সামনের সারিতে থাকা চিকিৎসাকর্মীরাও। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো রোগীতে ভর্তি, স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিদিন দীর্ঘসময় কাজ করেও কুলাতে পারছেন না। ডাক পড়ছে শিক্ষানবিশ আর মেডিকেল শিক্ষার্থীদের। যারা হাসপাতালে রোগীর সেবায় ছোটাছুটি করছেন, তাদের অনেকের পরিবারের সদস্যরাই করোনায় আক্রান্ত।
মহামারীর কারণে ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতের স্বাস্থ্যখাতের দুর্বলতাগুলো ফুটে বেরোচ্ছে বিকট চেহারা নিয়ে। যেখানে লোকবলের তীব্র সঙ্কট ও অপ্রতুল বরাদ্দের মধ্যে স্বাস্থ্যকর্মীরা লড়াই করে যাচ্ছেন করোনা আক্রান্ত রোগীকে বাঁচানোর জন্য। মহামারীর ভয়াবহ বিস্তার আর সরকারের অব্যবস্থাপনা তাদের অসহায় পরিস্থিতিতে প্রতিদিন নিদারুণ শ্রম দিয়ে যেতে বাধ্য করছে। দিনের পর দিন তাদের এমন সব নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, যার ওপর নির্ভর করছে কোন রোগী বাঁচবে, আর কে মরবে।
ইন্ডিয়ান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জা জয়লাল জানান, গত বছর মহামারী শুরুর পর থেকে এক হাজারের বেশি চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে এ রোগে। এর এক-চতুর্থাংশেরই মৃত্যু হয়েছে চলতি বছরের এপ্রিলের শুরু থেকে গত দেড় মাসের মধ্যে। ধারণা করা হচ্ছে, ভারতের চিকিৎসকদের মধ্যে অন্তত ৪০ শতাংশ ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের বিষয়ে সাম্প্রতিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
যারা হাসপাতালে রোগী নিয়ে আসেন, তাদের সবাই উত্তেজিত থাকেন। খুব সামান্য বিষয়ও বড় মারামারিতে গড়ায় এবং লোকজন পরিস্থিতি বুঝতে চায় না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাস্থ্যকর্মীদের সবকিছু মানিয়ে নিতে বলা হয়। স্থানীয় প্রভাবশালীদের চোটপাট, এমনকি হামলার মুখেও স্বাস্থ্যকর্মীদের পড়তে হয় অনেক সময়। একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, রোগীর পরিবারের ক্ষুব্ধ সদস্যরা একজন স্বাস্থ্যকর্মীকে হাসপাতালের হলে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলেছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যকর্মীদের যখন নিজের চোখের সামনে তার সহকর্মীর মৃত্যু দেখতে হয়, যে মৃত্যু হয়ত এড়ানো যেত, এর চেয়ে অসহায় পরিস্থিতি আর হতে পারে না।
মে মাসের শুরুতে একদিন দিল্লির বাত্রা হাসপাতালে অক্সিজেন ফুরিয়ে যায়, নতুন সরবরাহ পেতে পেতে লেগে যায় ৮০ মিনিট। ওই সময়ের মধ্যে মৃত্যু হয় ১২ জন রোগীর। তাদের মধ্যে ছিলেন ওই হাসপাতালের গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি বিভাগের প্রধান ডা. আর কে হিমথানি। স্ত্রীসহ নিজে আক্রান্ত হওয়ার আগে ১৪ মাস এই চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে গেছেন। ওই হাসপাতালের পরিচালক ডা. শিব চরণ লাল গুপ্তের সঙ্গে ডা. হিমথানির ৩০ বছরের বন্ধুত্ব।
হাসপাতালের অক্সিজেন যখন ফুরিয়ে আসছিল, ডা. গুপ্ত তখন হলওয়ে ধরে ছোটাছুটি করছিলেন, আর সরকারি কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম কর্মীদের কাছে সহায়তার আবেদন জানাচ্ছিলেন। ডা. হিমানথির মরদেহ যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তার দীর্ঘদিনের সহকর্মীরা মাস্ক আর অ্যাপ্রন পরা অবস্থায় জড়ো হন হাসপাতাল গেটে। বুকে হাত বেঁধে, অশ্রুসজল চোখে তারা শেষ বিদায় জানিয়ে তারা ফিরে যান কাজে। ডা. গুপ্ত বলেন, অক্সিজেন পরে এল, কিন্তু আমার বন্ধুসহ ১২ জনকে আর বাঁচানো গেল না। সেদিন থেকে ভেতরটা খুব খালি খালি লাগে, খুব অসহায় মনে হয়। আমি অনেকদিন ঘুমাতে পারিনি।
ভারতে স্বাস্থ্যখাতের লোকবল সঙ্কট নতুন কিছু নয়। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুয়ায়ী দেশটিতে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রীসহ মাত্র ১৭ জন স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, যেখানে ৪৪.৫ জন দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী থাকা দরকার। আর এলাকাভেদে স্বাস্থ্যকর্মীর সংখ্যাতেও আছে বৈষম্য। মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ গ্রামে থাকে। অথচ স্বাস্থ্যকর্মীদের ৬০ শতাংশই কাজ করেন শহরে।
ভারতের সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্যগুলোর একটি হলো বিহার। সেখানে প্রতি হাজার মানুষের জন্য হাসপাতালে শয্যা আছে ০.২৪টি, যা বিশ্বের গড় হিসাবের ১০ ভাগের এক ভাগ। এ রাজ্যের রোহতাস জেলার একটি সরকারি হাসপাতালে কাজ করেন নার্স লাচমি কুমারী। ৮০ শয্যার এই হাসপাতাল কোভিড-১৯ আক্রান্ত জটিল রোগীতে ভর্তি। লাচমি বলেন, আমি চোখ বন্ধ করলেও মনে হয় কেউ আমাকে সাহায্যের জন্য ডাকছে। যখন একটু ঘুমানোর সুযোগ পাই, তখনও দেখি চারপাশে শুধু মানুষ, সবাই সাহায্য চাইছে। ওই তাগিদই এখনো আমাকে সচল রেখেছে।
বিহারের রাজধানী পাটনার একটি সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. লোকেশ তিওয়ারি জানান, কোভিড রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের অর্ধেকই পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে হারিয়েছেন এ রোগে। এ হাসপাতালের ৪০০ সাধারণ শয্যা আর নিবিড় পরিচর্যার ৮০টি শয্যায় সবসময়ই রোগী থাকছে। চাপ সামলাতে গিয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন। তাদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের কাউন্সেলিং করতে হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কেউ স্বাভাবিকভাবেই হাঁটাচলা করছিল, অথচ ধপ করে পড়ে যাচ্ছে এবং ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মারা যাচ্ছে-এর প্রভাব অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পড়বে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই