ঢাকা : বিশ্বব্যাপী বিদ্যুতের সংকট তীব্র হচ্ছে। এরই মধ্যে বিশ্বের বড় অর্থনীতি জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাবে প্রায় বন্ধের মুখে অর্থনীতির চাকা। জাপানে ইয়েনের ভয়াবহ দরপতন, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও টোকিওতে তীব্র দাবদাহের কারণে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশটি পড়তে যাচ্ছে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ সংকটের মাঝে।
দেশটির চাহিদার ৯০ শতাংশ বিদ্যুতের আমদানির মাধ্যমে মেটানো হয়। যার মূল্য পরিশোধ করা হয় ডলারে। বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল জ্বালানি তেল, গ্যাস ও কয়লার দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় বিশাল অঙ্কের অর্থ পরিশোধে বিপাকে পড়েছে গোটা দেশের অর্থনীতি।
ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অন্যতম অর্থনীতির দেশ জার্মানি জড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহ বিদ্যুৎ সংকটে। দেশটির অর্থমন্ত্রী রোবার্ট হাবেক এই সংকটকে স্মরণকালের অন্যতম আখ্যা দিয়ে বলেন, রাশিয়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল গ্যাস রপ্তানি কমিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। সেই সঙ্গে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ফের সচল করার উদ্যোগ নিয়েছে তারা। বার্লিনে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও জানিয়েছেন তিনি।
অস্ট্রেলিয়ার স্মরণকালের সবচেয়ে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট সামাল দিতে দেশটির জলবায়ু পরিবর্তন ও শক্তিবিষয়ক মন্ত্রী ক্রিস বাউন জনগণকে সাশ্রয়ী ও সংযমী হওয়ার অনুরোধ জানান। তিনি বলেন, সিডনি ও নিউ সাউথ ওয়েলসের বাসিন্দাদের প্রতিদিন সন্ধ্যায় দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। ১৬ জুন পর্যন্ত এই বিধি কার্যকর থাকবে।
বিশ্বে জ্বালানির ঊর্ধ্বগতিতে ইকুয়েড়রের জীবিকা-সামাজিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে। গত সপ্তাহে ইকুয়েডরের বিক্ষোভকারীরা এই বার্তাটি দেশটির প্রেসিডেন্টকে দিয়েছিলেন যখন তিনি আশ্বাস দেন, গ্যাস এবং ডিজেলের দাম ১০ সেন্ট কমিয়ে দেওয়া হবে। তবে আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, এটা যথেষ্ট নয়। জ্বালানি ও খাদ্যের দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশটিতে ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গার প্রতিক্রিয়ায় এই প্রতিশ্রুতি দেন প্রেসিডেন্ট।
ইকুয়েডরের মতোই জ্বালানির লাগামহীন দাম নিয়ে ক্ষোভ ও শঙ্কা ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের দাম গ্যালন প্রতি বেড়েছে ৫ ডলার। ভোক্তাদের জীবনযাত্রায় বাড়তি এই বোঝা মধ্যবর্তী কংগ্রেস নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দলের ওপর প্রভাব ফেলবে।
কিন্তু অনেক স্থানে জ্বালানির পেছনে জনগণের খরচ বৃদ্ধির ফলে জনদুর্ভোগ বাড়ার পাশাপাশি নেতিবাচক প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। পরিবারগুলো এখন শঙ্কায় রয়েছে, কীভাবে বাতি জ্বালানো নিশ্চিত করা যায়, গাড়িতে গ্যাস ও তেলের ট্যাংক ভর্তি করা যায়, তাদের বাসাবাড়ি গরম রাখা যায় এবং তাদের রান্না করার চুলা সচল রাখা যায়। ক্রমবর্ধমান পরিবহন খরচ ও ব্যবসা পরিচালন ব্যয় এবং কর্মীদের মজুরি বাড়ানোর দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।
যুক্তরাজ্যে মাঝারি আকারের একটি পরিবার গাড়ির জ্বালানির পেছনে খরচ করতে হচ্ছে ১২৫ ডলার। হাঙ্গেরিতে বেশিরভাগ জ্বালানির স্টেশনে দিনে ৫০ লিটারের বেশি তেল কিনতে দেওয়া হচ্ছে না গাড়িচালকদের।
পেট্রোলচালিত জেনারেটরের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যের জ্বালানি না পাওয়ায় নাইজেরিয়ায় অনেক নাপিত চুল কাটতে মোবাইল ফোনের আলো ব্যবহার করছেন। ঘানায় গ্যাসের দাম বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশে বিক্ষোভকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেট ছুড়েছে পুলিশ।
জ্বালানির দামের উল্লম্ফন বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ককে নতুন করে সাজাতে বাধ্য করছে। জ্বালানির এমন ঊর্ধ্বগতি সরাসরি প্রভাব ফেলছে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধিতে আর ব্যাংকগুলোকে বাধ্য হয়ে বাড়াতে হচ্ছে সুদের হার। এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধার মুখে পড়ছে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বিশ্ববাজারে তেল ও গ্যাসের অন্যতম রপ্তানিকারক ইউক্রেনে রুশ হামলা এবং এর পরে পশ্চিমা দেশসহ বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে গ্যাস ও তেলের দাম অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়ে গেছে। আর দুই বছর ধরে চলা কোভিড-১৯ মহামারির ধকল সামলে ওঠার আগেই এই যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে আবারো চেপে ধরেছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই