একনজরে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২২, ০৮:৪৫ এএম

ঢাকা : সত্তর বছর ধরে যুক্তরাজ্য শাসন করে আসা ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ আর নেই।

বৃহস্পতিবার (৮ সেপ্টেম্বর) ৯৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান বলে বাকিংহ্যাম প্যালেস জানিয়েছে। 

এর মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় এলিজাবেথের ৭০ বছর রাজত্ব আর ৯৬ বছরের বর্ণাঢ্য এক জীবনের অবসান হলো। বাকিংহাম প্যালেস রানীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ১০ দিনের জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেছে।

বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছে, রানী এলিজাবেথ ছিলেন ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে অটল কর্র্তৃত্বের অধিকারিণী। দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে যখন ব্রিটেনের প্রভাব ক্রমেই কমেছে, সমাজে আমূল পরিবর্তন এসেছে, রাজতন্ত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তখনো অনেকের কাছে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের জনপ্রিয়তা কমেনি। ব্রিটেনের রাজসিংহাসনে নিজ কর্র্তৃত্বে তিনি অটল থেকেছেন। অথচ তার জন্মের সময়ও কেউ ভাবেননি তার ভাগ্যে রয়েছে ব্রিটেনের সিংহাসনে আরোহণ।

এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল। তার বাবা অ্যালবার্ট, ডিউক অব ইয়র্ক এবং মা সাবেক লেডি এলিজাবেথ বোওজ-লিওনের তিনি ছিলেন প্রথম সন্তান। অ্যালবার্ট ছিলেন পঞ্চম জর্জের দ্বিতীয় সন্তান। তবে তার বড় ভাই ডেভিড ১৯৩৬ সালে তৃতীয় এডওয়ার্ড উপাধি পেয়ে সিংহাসনে বসলেও দুবার বিবাহ বিচ্ছেদ হওয়া আমেরিকান এক ধনী রমণী ওয়ালিস সিম্পসনের সঙ্গে বিয়ের কারণে সিংহাসন ত্যাগ করতে হয়। এলিজাবেথের বাবা ডিউক অব ইয়র্ক অনিচ্ছার সঙ্গে সিংহাসনে বসেন রাজা ষষ্ঠ জর্জ হিসেবে এবং তার অভিষেক অনুষ্ঠান কিশোরী এলিজাবেথকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে।

রাজা ষষ্ঠ জর্জ, তার স্ত্রী ও দুই কিশোরী কন্যাকে নিয়ে যখন রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে ইউরোপে ঘুরছেন, তখন ১৯৩৯ সালে ইংল্যান্ডেই এলিজাবেথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে গ্রিসের যুবরাজ প্রিন্স ফিলিপের। এলিজাবেথের বয়স যখন ১৮, তখন ১৯৪৪ সালে ফিলিপের প্রতি তার প্রণয় গভীর হয়ে ওঠে। তিনি ঘরে ফিলিপের ছবি রাখতেন, দুজন দুজনকে চিঠি লিখতেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষদিকে তরুণী প্রিন্সেস এলিজাবেথ আধাসামরিক বাহিনীতে যোগ দিয়ে লরি চালানো ও লরির সার্ভিস করার শিক্ষা নেন। যুদ্ধ শেষে প্রিন্স ফিলিপকে তিনি বিয়ে করতে চাইলে তাকে বেশ বাধার মুখে পড়তে হয়। এলিজাবেথ ছিলেন রাজার অনেক আদরের কন্যা। ফিলিপের বিদেশি বংশপরিচয়ের কারণে রাজা তার হাতে মেয়েকে তুলে দিতে রাজি হননি। কিন্তু তাদের ইচ্ছারই জয় হয় শেষ পর্যন্ত। ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর এলিজাবেথ ও ফিলিপ ওয়েস্টমিনস্টার গির্জায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফিলিপের উপাধি হয় ডিউক অব এডিনবরা। তিনি নৌবাহিনীর কর্মকর্তা পদেই বহাল থাকেন। বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর তারা স্বাভাবিক বিবাহিত জীবন কাটান। এ সময়ই তাদের প্রথম পুত্র চার্লস ও কন্যা অ্যান জন্ম নেন।

১৯৫২ সালে যখন এলিজাবেথের বয়স ২৫, তখন রাজা ষষ্ঠ জর্জ ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে শয্যা নেন। এলিজাবেথ তার স্বামীকে নিয়ে বিদেশ সফরে যান বাবার হয়ে দায়িত্ব পালন করতে। চিকিৎসকের পরামর্শ উপেক্ষা করে রাজা তাকে বিমানবন্দরে বিদায় জানাতে গিয়েছিলেন। সেটাই ছিল পিতা ও কন্যার শেষ সাক্ষাৎ। এলিজাবেথ কেনিয়ায় বসে বাবার মৃত্যু সংবাদ পান। ১৯৫৩ সালের জুন মাসে তার আনুষ্ঠানিক অভিষেকে দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসন আরোহণ ও শপথগ্রহণ লাখ লাখ মানুষ দেখেন টেলিভিশনের পর্দায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটিশ উপনিবেশ তখন গুটিয়ে এসেছে। নতুন রানীর দায়িত্ব নিয়ে তিনি যখন ১৯৫৩ সালে কমনওয়েলথ দেশগুলোতে দীর্ঘ সফরে বের হলেন, তখন ভারতীয় উপমহাদেশসহ অনেক দেশে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। ক্রমেই রাজতন্ত্রের প্রতি সাধারণ মানুষের অবিচ্ছিন্ন আনুগত্যে বদল আসতে শুরু করে। সমাজের মধ্যে নানা ধ্যান-ধারণাও দ্রুত বদলাতে থাকে। রানীও যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলান। ক্রমেই ‘রাজতন্ত্র’র জায়গা নেয় ‘রাজপরিবার’। রানীর রাজত্বকালের মূল স্তম্ভ হয়ে ওঠে সাংবিধানিক সততা রক্ষা। তবে সরকারের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড থেকে দূরে চলে যান রানী। তার দায়িত্ব সীমিত থাকে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন, দেশের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত থাকা, সরকারকে পরামর্শ দেওয়ার মধ্যে। ষাটের দশকের শেষদিকে, বাকিংহাম প্রাসাদ সিদ্ধান্ত নেয় যে রাজপরিবারকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। রানী এবং তার পরিবারও যে আর পাঁচটা সাধারণ পরিবারের মতো ঘরকন্নার নানা কাজ করে তা দেখাতে বিবিসিকে ‘রয়্যাল ফ্যামিলি’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়।

রানীর দৈনন্দিন ঘর-সংসারের নানা ছবি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। অনেকে বলেন, ওই তথ্যচিত্র রাজপরিবারের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। রানী এলিজাবেথ তার দায়িত্ব পালনে নানা দেশে ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধের পর তিনি আমেরিকা সফরে যান। তিনিই ছিলেন প্রথম ব্রিটিশ রানী যিনি আমেরিকান কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দেন। এর এক বছরের মধ্যে তার পরিবারে নানা ধরনের কেলেঙ্কারি ও দুর্যোগের ঘটনা শুরু হয়। রানীর দ্বিতীয় ছেলে ডিউক অব ইয়র্ক এডওয়ার্ড ও স্ত্রী সারা আলাদা হয়ে যান। মেয়ে প্রিন্সেস অ্যান ও স্বামী মার্ক ফিলিপসের বিয়ে ভেঙে যায়। প্রিন্স ও প্রিন্সেস অব ওয়েলস, অর্থাৎ চালর্স ও ডায়ানা বিয়েতে যে গভীর অসুখী এ খবর জানাজানি হয়। তারাও আলাদা হয়ে যান। রানীর প্রিয় বাসভবন উইন্ডসর ক্যাসেলে ওই বছরই বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়। ওই ভবন মেরামতের খরচ সাধারণ মানুষ জোগাবে নাকি তা রানীর তহবিল থেকে ব্যয় করা উচিত তা নিয়ে চলে তুমুল বিতর্ক।

একদিকে ইউরোপের সঙ্গে নতুন জোট গঠনের মধ্যে দিয়ে কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে ব্রিটেনের যোগাযোগ কিছুটা শিথিল হয়ে আসা, অন্যদিকে ব্রিটেনে রাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে জনমনে অব্যাহত বিতর্ক এর মধ্যেও যখন রানী রাজপরিবারের উজ্জ্বল স্তম্ভ হিসেবে তার দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট, তখন প্রিন্সেস ডায়ানার আকস্মিক মৃত্যু ব্রিটেনের রাজপরিবারের জন্য বড় ধরনের ধাক্কা হয়ে আসে। ১৯৯৭ সালের আগস্টে প্যারিসে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানা মারা যাওয়ার পর রানীর বিরুদ্ধে ওঠে সমালোচনার ঝড়। যখন প্রাসাদের বাইরে বিশাল মানুষের ঢল ফুলের শ্রদ্ধার্ঘ্যে ভরে উঠেছে প্রাসাদের ফটকের বাইরের রাস্তাঘাট, তখন সেই শোকের মুহূর্তের সঙ্গে রানীর আপাতদৃষ্টিতে একাত্ম হতে না পারায় মানুষ সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।

মানুষের উত্তাল সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত রানীকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে হয় যে ভাষণে তিনি পুত্রবধূ ডায়ানার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং সময়ের সঙ্গে রাজপরিবারকে বদলানোর অঙ্গীকার দেন।

রাজপরিবারের প্রতি ব্রিটেনের মানুষের আগ্রহ, উদ্দীপনা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ২০০২ সালে মহাসমারোহে উদযাপিত হয় রানীর সিংহাসন আরোহণের সুবর্ণজয়ন্তী, এরপর রানীর ৮০ বছরের জন্মদিনে উইন্ডসরের রাস্তায় সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার বিশেষ সাক্ষাৎ-সফর, রানী ও প্রিন্স ফিলিপের বিয়ের ৬০তম বার্ষিকী উৎসব এবং ২০১১ সালে রানীর নাতি উইলিয়াম ও ক্যাথরিনের বিয়ে ও ২০১২ রানীর সিংহাসন আরোহণের হীরকজয়ন্তী। সবশেষ ২০২২-এর জুন মাসে মহাসমারোহে উদযাপিত হয়েছে রানীর সিংহাসন আরোহণের ৭০তম বার্ষিকী বা প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী।

সোনালীনিউজ/এমটিআই