ঢাকা : ৩১ ডিসেম্বর, শনিবার ২০২২ সালের শেষ দিন। সারা বিশ্বের মানুষ যখন নতুন বছরের অপেক্ষায়, তখন বিগত বছরটি কেমন কেটেছে, বিভিন্ন জগতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে তা জেনে নিতেও ভুল করছেন না কেউ কেউ। তাদের অনেকেরেই হয়তো এটা জানা যে, ২০২২ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিতে ঘটে গেছে বহু নাটকীয় ঘটনা, এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এ বছর বেশ কয়েকটি দেশের সরকারকে মেয়াদ পূর্ণ করার আগেই বিদায় নিতে হয়েছে।
আগ্রহী পাঠকদের সেগুলো স্মরণ করিয়ে দিতেই এই আয়োজন:
পাকিস্তানঃ নানা নাটকীয়তার পর ২০২২ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটে হেরে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান খান। এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করার রেকর্ড গড়তেও ব্যর্থ হন ২০১৮ সালে পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া ইমরান খান (১৮ আগস্ট ২০১৮ থেকে ১০ এপ্রিল ২০২২)। ইমরানের পতনের নেপথ্য কারণ হিসেবে- একসময় তাকে 'ক্ষমতায় বসানো' দেশটির সেনাবাহিনীর তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, পাকিস্তানকে ধর্ম সহিষ্ণু রাষ্ট্রে পরিণত করতে বেশকিছু প্রায়োগিক উদ্যোগের কারণে ‘ইসলামপন্থি’দের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়া, রাশিয়ার সাথে দেশের সম্পর্ক জোরদার করাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের সাথে দূরত্ব তৈরি হওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।
শ্রীলঙ্কাঃ দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা এবং গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে লাগাতার প্রতিবাদ চলছিল। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ রাজাপাকসের সমর্থকরা সরকারি বিরোধী বিক্ষোভকারীদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে চড়াও হয়ে তাদের মারধর করার পর দুই পক্ষের মধ্যে সহিংসতা শুরু হয় এবং এর জেরে বিক্ষুদ্ধ প্রতিবাদকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে হামলা চালায়। গণবিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাসভবন ছেড়ে মাহিন্দ পালিয়ে বাঁচেন। মাহিন্দা পদত্যাগ করলে ষষ্ঠবারের মতো শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে (১২ মে) শপথ নেন রণিল বিক্রমাসিংহে।
কিন্তু, প্রতিবাদ থেমে থাকে নি। কারফিউ ভেঙ্গে রাজধানী কলম্বোর রাস্তায় নেমে প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসেরও পদত্যাগ দাবি করতে থাকেন বিক্ষোভকারীরা। গণরোষের মুখে গোটাবাইয়া দেশ ছেড়ে পালালে ১৫ জুলাই ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন রণিল বিক্রমাসিংহে। ২০ জুলাই পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসা রণিল। লক্ষণীয় যে, মাহিন্দ রাজাপাকসে এবং গোটাবাইয়া রাজাপাকসে (২০১৯ সালের শেষের দিকে) যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও উভয়ই মাত্র আড়াই বছরের মতো ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন।
যুক্তরাজ্যঃ প্রথম কোনো অশ্বেতাঙ্গ এবং অভিবাসী পরিবারের সন্তান হিসেবে গত ২৫ অক্টোবর ঋষি সুনাককে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন বৃটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস। এর আগের দিন সুনাক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বৃটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারও আগে (২০ অক্টোবর) সংসদ সদস্যদের অনাস্থার মুখে পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস পদত্যাগ করার ঘোষণা করেছিলেন। বেশকিছুদিন ধরেই লিজ ট্রাসের সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে তার প্রশাসন ও কনজারভেটিভ পার্টির মধ্যে নজিরবিহীন তোলপাড় চলছিল। দুজন মন্ত্রীর পাশাপাশি এক ডজনেরও বেশি এমপি প্রকাশ্যেই অনাস্থা প্রকাশ করে তার পদত্যাগ দাবি করছিলেন। আর, পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বৃটেনের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে স্বল্পস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর রেকর্ড গড়েন লিজ।
তিনি মাত্র ৪৫ দিন (০৬ সেপ্টেম্বর থেকে ২৫ অক্টোবর) ক্ষমতায় ছিলেন। লিজ ট্রাসের আগে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বরিস জনসন। বরিসকেও বিদায় নিতে হয়েছিল মেয়াদ শেষের আগেই, তিন বছর ৪৫ দিনের মাথায় (২৪ জুলাই ২০১৯ থেকে ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২)। বৃটেনের অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ার পাশাপাশি তার সাথে যোগ হয়েছে সরকারের অস্থিতিশীলতা। লেবার পার্টি ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিসহ দেশটির বিরোধীদলগুলো বলছে, কেবল প্রধানমন্ত্রী বদল করে সমস্যার সমাধান হবে না। তারা নতুন সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন।
লেবাননঃ গত ৩০ অক্টোবর মেয়াদ শেষ হওয়ার একদিন আগেই প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ত্যাগ করেন মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার এবং হিজবুল্লাহ’র মতো সশস্ত্র বাহিনীকে মদদ দেওয়ার অভিযোগ ছিল। ক্ষমতা ছাড়ার দিন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মিশেল আউন স্বীকার করেছিলেন যে, দেশটির অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা তার ছিল না।
নেপালঃ ২০০৮ সালে ২৩৯ বছর পুরোনো রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে হিমালয়কন্যা নেপালে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি এরপর থেকে ১০টি সরকার পেলেও দরিদ্র দেশটির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। গত ২৫ ডিসেম্বর নেপালের মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহল বা প্রচণ্ড তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। যদিও, তার প্রধানমন্ত্রী হওয়াটা ছিল যথেষ্ট নাটকীয়। তিনি ছিলেন নেপালি কংগ্রেসের প্রধান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার নেতৃত্বে পাঁচ দলের জোটের অন্যতম শরিক। কিন্তু প্রচণ্ড সেই জোট থেকে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণ পরেই কে পি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপালের সঙ্গে হাত মেলান। আরো কিছু ছোট পার্টির সমর্থনও তিনি জোগাড় করেন। নতুন বছরের শুরুতেই (০২ জানুয়ারি) তার দায়িত্ব নেয়ার কথা। কিন্তু, তার নেতৃত্ব বা সরকার পূর্ণ মেয়াদ পূরণ করতে পারবে কিনা তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ