ঢাকা : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং অন্যান্য পশ্চিমা নেতারা যতটা আশঙ্কা করেছিলেন ইরানে ইসরায়েলের হামলা ততটা ভয়ঙ্কর হয়নি।
যদিও ইসরায়েল প্রথমে ইরানকে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ারই পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা পিছু হটে। বড় ধরনের যুদ্ধ এড়াতে খুব সতর্কভাবে মাপজোখ করে সীমিত আকারে ইরানের হামলার জবাব দিয়েছে ইসরায়েল।
গত ১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইসরায়েলের বিমান হামলায় ইরানের এক ঊর্ধ্বতন জেনারেল নিহত হওয়ার পর ঘটনাপ্রবাহ যেভাবে বিপজ্জনক দিকে মোড় নিয়েছিল তার প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা নেতারা ইসরায়েলকে সংযত থেকে একটা সীমারেখা টানার আহ্বান জানাচ্ছিলেন।
[221692]
সেই আন্তর্জাতিক চাপ এবং তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল ইরানে হামলা চালানো নিয়ে ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে মতভেদ- দু’য়ে মিলেই ইসরায়েলের এমন সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়া।
শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোতে ইসরায়েল ইরানে হামলা করেছে বলে খবর প্রকাশ পায়। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরেও মধ্যাঞ্চলের নগরী ইস্ফাহানের বিমানঘাঁটির কাছে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করার কথা জানানো হয়।
তবে এটি বিদেশি হামলা নয় বলে দাবি করেন ইরানি কর্মকর্তারা। এ হামলা নিয়ে ইরান তেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। পাল্টা জবাবের পরিকল্পনা না থাকারও ইঙ্গিত দিয়েছে দেশটি।
গাজায় ইসরায়েলের ছয়মাসের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ লেবানন ও ইসরায়েলের দুপাশের সীমান্তে ছড়িয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য এখন সর্বাত্মক যুদ্ধের মুখে আছে এবং সেটি আঞ্চলিক ও বিশ্বের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা আছে।
[221690]
এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার ইসফাহানে ঘটে যাওয়া হামলার ঘটনাটিকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করছে ইরান। প্রথমে ইরান বলেছিল কোনও হামলা হয়নি। পরে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে অনুপ্রবেশকারীদের উৎক্ষেপণ করা ড্রোন ভূপাতিত করার কথা বলা হয়।
ইরানের বিভিন্ন গণমাধ্যম কৌতুক করে ড্রোনের ছোট আকারের ছবি পোস্ট করে। বলা হয়, গত শনিবার ইরান যে হামলা চালিয়েছিল, তার জবাব দিয়েছে ইসরায়েল।
দুই দেশের মধ্যে বহু বছর ধরে শত্রুতা থাকলেও এবারই প্রথম ইরান নিজেদের মাটি থেকে সরাসরি ইসরায়েলের মাটিতে হামলা করে। সে হামলায় ইরান ৩০০’র বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। প্রায় সবগুলোই ধ্বংস করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। তাদের সহায়তা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জর্ডান।
ইরান তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে তুলে ধরেছিল আগেই। তারা ইসরায়েল এবং তাদের মিত্রদের প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ দিয়েছে। পরে ইরান দ্রুতই জাতিসংঘে এক বিবৃতিতে বলে দেয় যে, তাদের পাল্টা জবাব দেওয়া শেষ হয়েছে।
[221675]
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইসরায়েলকে আহবান জানিয়েছিলেন, যাতে তারা বিষয়টি ‘তাদের বিজয়’ হিসেবে ধরে নেয়। কিন্তু ইসরায়েল জেদ করে বলেছিল যে, তারা পাল্টা আক্রমণ করবে।
শুরু থেকেই এ সংকট দেখিয়ে দিয়েছে যে, ইরান এবং ইসরায়েলের একে অপরকে বোঝার মাত্রা কতটা খারাপ। দু’পক্ষই একে অপরকে নিয়ে ভুল হিসাব-নিকাশ করেছে। সেকারণে সংকট আরও গভীর হয়েছে।
দামেস্কে ইরানের জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জায়েদিকে হত্যার পর ইসরায়েল হয়ত ভেবেছিল, ইরান কেবল চরম ক্ষোভ প্রকাশ করবে। এর বাইরে তারা কোনও শক্ত জবাব দেবে না।
দামেস্কে সেই হামলায় ইরানের কনস্যুলেট ভবন ধ্বংস হয়। আরেক জেনারেলসহ আরও ৬ জন নিহত হয়। ইরান বলেছিল কনস্যুলেটে এই হামলাকে তারা নিজের দেশের ওপর হামলা হিসেবেই গণ্য করছে।
ইসরায়েল দাবি করেছিল, কনস্যুলেট ভবনটি কূটনৈতিক কনভেনশন দিয়ে সুরক্ষিত ছিল না। কারণ, ইরানের ইসলামিক রেভ্যুলশনারি গার্ড সদস্যরা সেটিকে সামরিক ঘাঁটি বানিয়ে রেখেছিল।
কিন্তু ইসরায়েলের এমন কথা ইরান মেনে নেয়নি। তেহরান ভেবেছিল, তারা পাল্টা হামলা চালানোর পর ইসরায়েল একটি সীমারেখা টানতে রাজি হয়ে যাবে। আর সেটি ছিল ইরানের দিক থেকে আরেকটি গুরুতর ভুল হিসাব-নিকাশ।
ইসফাহানে হামলার জবাবে ইরান যদি পাল্টা হামলা না চালায়, তাহলে চলমান উত্তেজনা আপাতত প্রশমন হবে।
শুক্রবার যা ঘটেছে সেটি হতে পারে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর একটি এমন জবাব দেওয়ার চেষ্টা, যেখানে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের আহ্বান পাশ না কাটানোর বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করেছেন, যাতে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনটা বজায় থাকে।
বিষয়টি সেরকম কিছু হয়ে থাকলে আরও একটি প্রশ্ন এসে যায়। সেটি হচ্ছে – ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভায় যেসব সাবেক জেনারেল আছেন, তারা কি এই জবাব দেওয়াকে যথেষ্ট মনে করবেন? কারণ, তারা চান আরও কঠিন জবাব দিতে, যেটিকে তারা শত্রুকে নিবৃত্ত করতে ইসরায়েলের সক্ষমতা ফেরানোর পন্থা হিসাবেই দেখেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর উগ্র জাতীয়তাবাদী জোটশরিকরাও ইসরায়েলের দিক থেকে আরও ভয়ঙ্কর জবাব দেবার দাবি করেছেন।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইটামার বেন গাভির বলেন, ইরান যখন আক্রমণ করেছিল, তখন ইসরায়েলের ‘ক্ষিপ্ত জবাব দেওয়া’ দরকার ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ইসফাহানে যে হামলা হয়েছে সেটি দুর্বল হামলা।
পশ্চিমা দেশগুলোর মতে, এ অঞ্চলের জন্য সবচেয়ে ভালো হবে ইরান এবং ইসরায়েলের মধ্যে চলমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে একটি সীমারেখা টানা।
যা হোক, এটাই যদি চলমান সংকটের এখনকার পর্যায়ের শেষও হয়ে থাকে, তাহলেও এর মধ্য দিয়ে এক নতুন উদাহরণ তৈরি হল।
আর তা হচ্ছে, ইরান ইসরায়েলের মাটিতে সরাসরি আঘাত করেছে। আবার ইসরায়েলও ইরানের মাটিতে সরাসরি পাল্টা আঘাত করে জবাব দিয়েছে।
দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা গোপন যুদ্ধ এর মধ্য দিয়ে ছায়া ভেদ করে বেরিয়ে এসেছে। ইরান এবং ইসরায়েল দেখিয়েছে যে, তারা একে অপরকে অতিমাত্রায় মনোযোগ দিলেও এক পক্ষ আরেক পক্ষের অভিপ্রায় ঠিকমত বোঝে না।
বিশ্বের খুবই উত্তেজনাপ্রবণ এই অঞ্চলে এ বিষয়টি ইতিবাচক নয়।
এমটিআই