ঢাকা: শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েছেন বামপন্থি নেতা অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে। রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরদিনই দেশ পরিচালনার ভার গ্রহণ করেছেন তিনি।
এর মাধ্যমে অনন্য এক রেকর্ডের মালিক হলেন দিশানায়েকে। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে তিনিই প্রথম বামপন্থি নেতা, যিনি প্রেসিডেন্টের চেয়ারে বসলেন।
২০২২ সালে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ার পর এটি ছিল শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে ৫৫ বছর বয়সী এই নেতার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাজিথ প্রেমাদাসা। আর নির্বাচনে তৃতীয় হয়েছেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে।
২০১৯ সালের নির্বাচনে মাত্র ৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন অনূঢ়া। তবে এবারের নির্বাচনে তিনি চমক তৈরি করেন। ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোটের প্রার্থী ছিলেন এ নেতা। অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশটিতে নিজের দুর্নীতিবিরোধী প্ল্যাটফর্ম ও দরিদ্রবান্ধব নীতির কারণে গত কয়েক বছরে অনূঢ়ার প্রতি সমর্থন বেড়েছে। অর্থনৈতিক দুর্দশা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টায় থাকা শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইতিমধ্যে শপথ নিয়েছেন এ নেতা।
‘ভিন্ন’ নেতা
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারকালে অনূঢ়া দিশানায়েকে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ইতিহাসের আরেকটি ভয়াবহ ঘটনা নিয়েও কথা বলতেন। সেটি হলো, ২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে বোমা হামলার ঘটনা।
২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোজুড়ে গির্জা ও আন্তর্জাতিক হোটেলগুলোয় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় ২৯০ জন নিহত এবং শত শত মানুষ আহত হন। এটি শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলার ঘটনা। কীভাবে এসব হামলা চালানো হলো, কীভাবে নিরাপত্তাব্যবস্থা ব্যর্থ হলো, তা নিয়ে গত পাঁচ বছরে তদন্ত হলেও সদুত্তর মেলেনি। কেউ কেউ অভিযোগ করেন, গোতাবায়া রাজাপক্ষের নেতৃত্বাধীন সাবেক সরকার তদন্তকাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছিল।
সম্প্রতি বিবিসি সিংহলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অনূঢ়া দিশানায়েকে অঙ্গীকার করেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি এ ব্যাপারে তদন্ত করবেন। তিনি তখন ইঙ্গিত করেছিলেন, নিজেদের দায় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে কর্তৃপক্ষ তদন্তে বাধা দিয়েছে। অনূঢ়া মনে করেন, শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দলের যে প্রতিশ্রুতিগুলো অপূর্ণ থেকে গেছে, তার একটি এটি।
সিংহলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অনূঢ়া আরও বলেছিলেন, ‘শুধু এ তদন্তের বিষয়ই নয়, রাজনীতিবিদদের যারা দুর্নীতি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তারাই দুর্নীতিতে জড়িয়েছেন। যারা ঋণমুক্ত শ্রীলঙ্কা গড়ার কথা বলেছিলেন, তাঁরা ঋণের বোঝা বাড়িয়েছেন। যেসব মানুষ আইন জোরালো করার কথা বলেছেন, তারাই আইন ভঙ্গ করেছেন। ঠিক এ কারণে দেশটির জনগণ ভিন্ন নেতৃত্ব চায়। আমরা তা দিতে পারি।’
পরিবর্তনের পক্ষে
এবারের নির্বাচনে আগে থেকেই অনূঢ়া দিশানায়েকেকে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। প্রচারকালে তিনি নিজেকে পরিবর্তনের পক্ষের প্রার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন।
অর্থনৈতিক দুর্দশাকে কেন্দ্র করে ২০২২ সালে গণবিক্ষোভের মুখে শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে চলে যান। করোনা মহামারি পরিস্থিতির পাশাপাশি দুর্বল রপ্তানি ও বড় নীতিগত ত্রুটি দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ফাঁকা করে দিয়েছিল। দেশটির সরকারি ঋণের পরিমাণ ৮৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৭০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এসব সংকটের জন্য রাজাপক্ষে এবং তাঁর সরকারকে দায়ী করা হয়।
রাজাপক্ষের উত্তরসূরি, প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংহে অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেন। এ কারণে মূল্যস্ফীতি কমেছে এবং শ্রীলঙ্কার রুপি শক্তিশালী হয়েছে। তবে মানুষের দুর্দশা এখনো কাটেনি।
২০২২ সালে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি কাঠামোগত দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক দায়মুক্তির বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে শ্রীলঙ্কার জনগণ এখন ভিন্নধারার রাজনৈতিক নেতৃত্ব চায়। আর জনগণের সে চাওয়াকেই সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়েছেন অনূঢ়া। সমালোচকদের মতে, দীর্ঘদিন রাজনৈতিক নেতারা যেসব দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি করে এসেছেন, সেখান থেকে সম্ভাব্য উত্তরণকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন তিনি।
অনূঢ়া দিশানায়েকে বারবারই বলেছেন, ক্ষমতায় এলে পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে তাঁর। বিবিসি সিংহলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও অনূঢ়া ইঙ্গিত করেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হওয়ার কয়েক দিনের ভেতরই কাজটি করবেন।
তিনি তখন বলেন, ‘জনগণ যা চায় তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হলে এমন পার্লামেন্ট চালিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।’
দরিদ্রদের প্রতিনিধি
অনূঢ়া যেসব রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার মধ্যে আছে কঠোর দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ, বড় ধরনের কল্যাণ প্রকল্প এবং কর কমানোর অঙ্গীকার।
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে বর্তমান সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে কর বাড়ানো এবং কল্যাণ ব্যয় কমানোর মতো কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে এতে অনেক মানুষই তাদের মৌলিক চাহিদাটুকু পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছে।
[232670]
অনূঢ়া দিশানায়েকে এসব সমস্যার সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। আর এ কারণে ভোটারদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। বিশ্লেষকেরাও আভাস দিয়েছিলেন, এবারের নির্বাচনে অর্থনৈতিক উদ্বেগগুলোই মুখ্য বিষয় হয়ে উঠবে।
নির্বাচনের আগে ভারতভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের অ্যাসোসিয়েট ফেলো সৌম্য ভৌমিক বিবিসিকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। তিনি তখন বলেন, ‘দেশটির (শ্রীলঙ্কা) ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি, জীবনযাত্রার আকাশচুম্বী ব্যয় ও দারিদ্র্য ভোটারদের মরিয়া করে তুলেছে। তারা দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল করতে এবং জীবনযাত্রার মান বাড়াতে সমাধান চান।’
সৌম্য ভৌমিক আরও বলেন, ‘দেশটি তার অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। শ্রীলঙ্কার পুনরুদ্ধারের গতিপথ ঠিক করতে এবং এর শাসনব্যবস্থার প্রতি দেশের এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য এ নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে কাজ করছে।’
নতুন প্রেসিডেন্টের কাজ কী হবে
বিনিয়োগকারী ও বাজারব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কেউ কেউ উদ্বেগ জানিয়েছেন, অনূঢ়া দিশানায়েকের অর্থনৈতিক নীতিগুলো শ্রীলঙ্কার পুনরুদ্ধারের পথকে ব্যাহত করতে পারে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় দেওয়া বক্তৃতায় অনূঢ়া বলেছিলেন, তিনি শ্রীলঙ্কার ঋণ পরিশোধ নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি আরও বলেছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে পরামর্শ করে যেকোনো পরিবর্তন আনা হবে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য সংস্থাটি ত্রাণকর্তা হিসেবে কাজ করছে।
বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, শ্রীলঙ্কার পরবর্তী প্রেসিডেন্টের প্রধান কাজ হবে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক অবস্থা তৈরি করা।
শ্রীলঙ্কার ওপেন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও আন্তর্জাতিক অধ্যয়নের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক অতুলাসিরি সামারাকুন বিবিসিকে বলেন, কীভাবে এ অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করা হবে, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।’ তিনি আরও বলেছেন, যেকোনো ভবিষ্যৎ সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে কাজ করতে হবে।
সাবেক বামপন্থী
১৯৬৮ সালের ২৪ নভেম্বর শ্রীলঙ্কার মধ্যাঞ্চলীয় গালেওয়ালা শহরে অনূঢ়া দিশানায়েকের জন্ম। শহরটি সংস্কৃতি ও ধর্মীয়ভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল।
মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা অনূঢ়া সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। পরে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৮৭ সালে ইন্দো-শ্রীলঙ্কা সমঝোতা চুক্তির সময়কালে অনূঢ়া প্রথম রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি তখন ছাত্র ছিলেন। ইন্দো-শ্রীলঙ্কা সমঝোতা চুক্তিটি কেন্দ্র করে শ্রীলঙ্কার অন্যতম রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষগুলোর একটি শুরু হয়েছিল।
১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত বামপন্থী রাজনৈতিক দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) শ্রীলঙ্কা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালায়। অনূঢ়া পরে এ জেভিপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির গ্রামীণ তরুণদের মধ্যে অসন্তোষকে কেন্দ্র করে ওই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। ওই বিদ্রোহ পরে সংঘাতে রূপ নেয় এবং তখন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ও বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অভিযান, তাদের হত্যা ও হামলার ঘটনা ঘটে। এ কারণে হাজারো মানুষের প্রাণহানি হয়।
১৯৯৭ সালে জেভিপির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন অনূঢ়া দিশানায়েকে। ২০০৮ সালে তিনি এর নেতা নির্বাচিত হন। তখন থেকে তিনি তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের মৌসুম’ চলাকালে তার রাজনৈতিক দলের সহিংস কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন। ২০১৪ সালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘সশস্ত্র সংঘাতের সময় এমন অনেক কিছু ঘটেছে, যা ঘটা উচিত হয়নি।’
বর্তমানে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টে জেভিপির মাত্র তিনটি আসন আছে। এনপিপি জোটের অংশ হিসেবে তারা পার্লামেন্টে আছে। অনূঢ়া দিশানায়েকে এখন এ জোটের নেতৃত্বে আছেন।
এআর