ঢাকা : বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আর মাত্র ৪ দিন বাকি। দিন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছেন ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস। অনেকেরই প্রশ্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে কমলার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী হবে?
প্রেসিডেন্ট হলে তার অবস্থান কেমন হবে সে সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া যায় গত আগস্টে ডেমোক্র্যাটিক ন্যাশনাল কনভেনশনে দেওয়া বক্তব্যে। পরবর্তীতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে টেলিভিশন বিতর্ক ও কিছু সাক্ষাত্কারে তা স্পষ্ট করেন তিনি। ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তার সাম্প্রতিক পূর্বসূরিদের, বিশেষ করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্য-ডানপন্থী নীতি বজায় রাখবেন।
এর অর্থ সম্ভবত আয়ের সমতা ও দারিদ্র্য মোকাবিলার প্রচেষ্টা, বিদেশে সহিংসতার জন্ম দেয় এমন নীতি পরিত্যাগ করা এবং বিভিন্ন বর্ণের আমেরিকানদের বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের প্রভাবিত করে এমন বৈষম্য দূরীকরণের প্রচেষ্টা সীমাবদ্ধ থাকবে।
কমলা হ্যারিস যদি এই নির্বাচনে জয়ী হন, তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয় নারী হিসেবে তার অবস্থান প্রান্তিক মানুষের কাছে খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ হবে না। কারণ তিনি আগের প্রেসিডেন্টদের মতোই বর্ণবাদী, লিঙ্গবাদী ও ইসলামবিদ্বেষী উপায়ে ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন।
[236085]
প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার প্রেসিডেন্সির সময় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের জন্য কিছু করার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন, ‘আমি কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের প্রেসিডেন্ট নই, আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।’ কমলা হ্যারিসও মূলত একই কাজ করবেন, যেমনটি ওবামার প্রেসিডেন্সির সময় হয়েছিল। যা কৃষ্ণাজ্ঞ আমেরিকান বা অন্য কোনো প্রান্তিক সম্প্রদায়ের জন্য ভালো খবর নয়।
আবাসনের কথাই ধরা যাক। প্রথমবার বাড়ি কিনতে আমেরিকানদের সহায়তার জন্য হ্যারিসের প্রস্তাবিত ২৫ হাজার ডলার অনুদান একটি ‘বৈষম্যমূলক অনুদান’। ঐতিহাসিকভাবে সাদা আমেরিকানদের জন্য সহায়ক হবে এই আবাসন বাজার। অপরদিকে কালো মানুষ এবং অন্যান্য বর্ণের লোকদের বিরুদ্ধে হবে বৈষম্যমূলক। হ্যারিসের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দেখে মনে হচ্ছে তিনি ‘সব আমেরিকানদের’ সহায়তার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে চান। তবে তার নীতিগুলো বেশিরভাগ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের জীবনযাপনে সহায়তা করবে। শ্রমিক শ্রেণি এবং শ্রমজীবী দরিদ্রদের জন্য হ্যারিস যে ত্রিশ লাখ বাড়িতে প্রবেশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়নের সুযোগ ক্ষীণ।
প্রজনন অধিকারের বিষয়েও হ্যারিসের অস্পষ্ট ও বিশাল প্রতিশ্রুতি কোনো নারীকে বিশেষত প্রান্তিক নারীদের খুব কমই সহায়তা করবে। অবশ্যই এটি ভালো হ্যারিস, কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদের এবং প্রয়াত অ্যাম্বার নিকোল থারম্যানের মতো নারীদের সম্পর্কে কথা বলেছেন। যারা জর্জিয়ার মতো রাজ্যে প্রজনন অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু সুস্পষ্ট কর্মপরিকল্পনা ছাড়া তার কথার কোনো অর্থ হয় না।
[236083]
হ্যারিস যেখানে সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ হয়েছেন তা হলো- যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন দেশের প্রান্তিক, কোণঠাসা ও অপরাধী জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে সহিংসতা মোকাবিলা। ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে নিজেকে ‘বন্দুকের মালিক’ বলে আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। তবে গত সেপ্টেম্বরে ধনকুবের অপরাহ উইনফ্রের সঙ্গে টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কমলা হ্যারিস বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন। হ্যারিস হাসতে হাসতে বলেন, ‘আমার বাড়িতে কেউ ঢুকে পড়লে তাকে গুলি করা হবে।’ ‘আমার সম্ভবত এটি বলা উচিত হয়নি,’ তিনি দ্রুত যোগ করেন। আমার কর্মীরা পরে বিষয়টি মোকাবিলা করবে।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস ‘মরণঘাতী অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ’-এর পক্ষে একজন হবেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। যখন তিনি মানুষকে গুলি করার বিষয়ে ধারাবাহিক কথা বলেন। ট্রাম্পের ঘৃণ্য দাবি সত্ত্বেও কমলা হ্যারিস একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী। অনেক আমেরিকান মনে করেন, তিনি তাদের রক্ষায় অন্য প্রেসিডেন্টদের চেয়ে বেশি কিছু করবেন। তবে, বন্দুক সহিংসতার প্রতি তার প্রত্যাখ্যানমূলক মনোভাব ও বর্ণবাদের বিষয়ে পূর্বসূরিদের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ নারীসহ প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলোকে বেশি সুরক্ষা দেবেন না।
আংশিক কৃষ্ণাঙ্গ ও আংশিক দক্ষিণ এশিয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস মার্কিন সহিংসতা কমিয়ে আনবেন এমন ধারণাও ভিত্তিহীন বলে মনে হয়। হ্যারিস বারবার বলেছেন, তিনি বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে লড়াকু বাহিনী হিসেবে আমেরিকাকে তৈরি করবেন। কোনো প্রকার অনুশোচনার ছাড়াই হ্যারিস স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তার ডেমোক্র্যাটিক ও রিপাবলিকান পূর্বসূরিদের মতো প্রাণঘাতী, বর্ণবাদী, সাম্রাজ্যবাদী নীতি চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা রয়েছে।
[236075]
গাজার হত্যাযজ্ঞ : গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য তিনি ও বাইডেন ‘চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করছেন’ বলে একাধিকবার বলা সত্ত্বেও সত্য হলো— চান না বলেই বাইডেন ও কমলা হ্যারিস যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করেননি। প্রেসিডেন্ট হিসেবে কমলা হ্যারিস তার ভবিষ্যৎ প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির হিসাব-নিকাশে কৃষ্ণাঙ্গ, বাদামি ও এশীয়দের জীবন নিয়ে ঠিক ততটাই ভালো থাকবেন, যেমনটা তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ও মার্কিন সিনেটর হিসেবে করেছেন।
ইতিহাসে প্রথমবার একজন কৃষ্ণাঙ্গ এবং দক্ষিণ এশীয় নারীকে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে পেয়ে উত্তেজনা রয়েছে। হ্যারিস-ওয়ালজকে সমর্থনের পেছনে অনেক আমেরিকান যুক্তি দাঁড় করাচ্ছেন, ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সিতে ‘আমরা ফিরে যাব না’ এবং অবশিষ্ট মার্কিন গণতন্ত্র রক্ষার মতো হ্যারিসের কিছু প্রতিশ্রুতি। এছাড়া কেউ কেউ কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করছেন এই ধারণা থেকে, তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ ও দক্ষিণ এশীয় নারী। তার মতো দেখতে মানুষদের জীবনকে মূল্য দেবেন এবং নির্বাচিত হওয়ার পর প্রান্তিক মানুষদের তার পূর্বসূরিদের চেয়ে অনেক বেশি সমর্থন করবেন।
এটা একটা বিভ্রম। ওবামার মতো কমলা হ্যারিসও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে চান। ‘কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান’ বা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রেসিডেন্ট হওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই। নির্বাচনী প্রচারণার সময় এবং জো বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে তিনি বারবার বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।
এই নির্বাচনে হ্যারিসকে ভোট দেওয়ার কারণের একটি দীর্ঘ তালিকা রয়েছে, তবে কেবল তার পরিচয়ের কারণে তিনি প্রান্তিকদের অধিকার ও সংগ্রামের পক্ষে সহায়ক হবে এমন ধারণা থাকা উচিত নয়।
লেখক: ডোনাল্ড আর্ল কলিন্স। অধ্যাপক, আমেরিকান ইউনিভার্সিটি, ওয়াশিংটন ডিসি।
সূত্র: আল জাজিরা