ঢাকা : আর কিছুক্ষণ পরই যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এবারে প্রধান দুই দল, রিপাবলিকান দলের প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী কমলা হ্যারিসের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের ধারণা করা হচ্ছে।
অন্যান্য বছরের মতো এবারও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিরা ঘরে বসে নেই। মূলধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্তরা প্রকাশ্যেই মাঠে নেমে কমলা হ্যারিস এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের হয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। ইতোমধ্যে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে নির্বাচনী সভা এবং ব্যানারযুক্ত গাড়ি প্রদর্শনীও করেছে প্রবাসীরা।
প্রবাসীরা কমলা ও ট্রাম্পের মধ্যে কাকে ভোট দেবেন এতদিন তা গোপনেই ছিলে। তবে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হচ্ছে এমন দাবি করে গত বৃহস্পতিবার এক্সে ট্রাম্পের পোস্টের পর থেকে প্রকাশ্যে তাকে সমর্থন করছেন অনেকে।
[236356]
বাংলাদেশে হিন্দু, খ্রিস্টান এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুরা হামলা ও লুটের শিকার হচ্ছেন, এমন মন্তব্যের পর প্রবাসের আওয়ামীলীগ পন্থীরা প্রকাশ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন জানিয়েছেন। তারা মনে করছেন ট্রাম্প নতুন প্রেসিডেন্ট হয়ে ক্ষমতার এলে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বেকায়দায় পড়বে। অপরদিকে বিএনপিপন্থী বেশিরভাগ প্রবাসী কমলা হ্যারিসকে সমর্থন জানিয়েছেন।
২০০০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বসবাস করছেন ২ লাখ ৭৭ হাজার বাংলাদেশি। যা আমেরিকার মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.৫ শতাংশ। অবৈধ অভিবাসীদের বাদ দিলেও গত ১৪ বছরে বৈধ অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। এছাড়াও প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক অবৈধ অভিবাসী রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
গত নির্বাচনে আমেরিকায় বসবাসরত অন্যান্য সমস্ত জাতিগুলোর তুলনায় বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সর্বাধিক ৫৫ শতাংশ ভোট পড়েছে। একটি সমীক্ষা অনুসারে, ৯০ শতাংশ বাংলাদেশি-আমেরিকান ভোটার এবারের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
২০২৪ সালের এই নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের। তারা রাজ্যগুলোর নির্বাচনে বিজয়ের ব্যবধানকে প্রভাবিত করতে পারে। তাদের অর্ধেকেরও বেশি (৪৫ শতাংশ) ডেমোক্র্যাটদের প্রতি ঝুঁকেছেন। অন্যদিকে, ৩৫ শতাংশ বাংলাদেশি-আমেরিকান রিপাবলিকান সমর্থক। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশিদের মধ্যে রিপাবলিকান সমর্থক কম থাকার শীর্ষ ৫টি কারণ হল-গর্ভপাত ইস্যু, সংখ্যালঘুদের অসহিষ্ণুতার উপলব্ধি, খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারের প্রতি আনুগত্য, অর্থনৈতিক নীতি ও বন্দুক বহন আইন।
তবে অধিকাংশ প্রবাসী বাংলাদেশিদের মতামত অভিবাসন নীতি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, এবং বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যে প্রার্থীদর অবস্থান রয়েছে তাকেই ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা দরকার।
বিগত নির্বাচনে দেখা গেছে, অভিবাসী সমাজের জন্য যেসব প্রার্থী ইতিবাচক নীতি এবং সহায়ক নীতি প্রয়োগ করেছেন, তারা আমেরিকান-বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়েছেন। এইবারে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অভিবাসন নীতি কেমন, তাঁদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনাগুলো আমেরিকান-বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের জন্য সহায়ক কিনা, তা মূল্যায়ন করা জরুরি। এছাড়াও, বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের উন্নতি ঘটানোর বিষয়ে প্রার্থীরা কী পরিকল্পনা করেছেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।
উদাহরণস্বরূপ, যদি কোনো প্রার্থী স্বাস্থ্যসেবায় আরও বেশি প্রবেশ যোগ্যতা নিশ্চিত করেন এবং ছাত্রদের জন্য শিক্ষাগত সুযোগ প্রসারিত করার অঙ্গীকার করেন, তাহলে তিনি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে জনপ্রিয় হতে পারেন। অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে, যিনি নতুন ব্যবসায় বিনিয়োগে উৎসাহিত করেন এবং ছোট ব্যবসাগুলোর জন্য সহায়ক পরিবেশ গড়ে তোলেন, তিনি প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সমর্থন পেতে পারেন। এই সকল দিক বিবেচনায় রেখে আমেরিকান-বাংলাদেশিদের জন্য উপযোগী প্রার্থী নির্বাচন করা হবে যুক্তিসংগত।
এ ব্যাপারে বিশ্বখ্যাত ইয়েলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী ড. গোলাম চৌধুরী ইকবাল বলেন, ‘একজন বাংলাদেশি হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে মত প্রকাশের সময় উভয় প্রার্থীর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলো বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ।‘
কিছু মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আচরণে 'প্যাথলজিক্যাল নার্সিসিজম' বা বিপজ্জনক ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের লক্ষণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সমালোচনা সহ্য করতে না পারা, নিজের দোষ স্বীকারে অক্ষমতা ও ব্যক্তিগত প্রয়োজনে জনকল্যাণকে উপেক্ষা করে। এ ধরনের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে, যা জনস্বার্থের পরিপন্থী। ট্রাম্প শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, গোটা বিশ্বের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারেন বলে মনে করেন ড. গোলাম চৌধুরী ইকবাল।
মূলধারার রাজনীতিবিদ ও নিউ ইয়র্ক প্রবাসী ব্যবসায়ী আক্তার হোসেন বাদল বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের নতুন রাষ্ট্রপতি চাই যিনি ভালো অর্থনৈতিক সাহায্য করতে পারেন। যিনি আমাদের আমেরিকান সীমান্তকে নিরাপদ করতে পারেন। এছাড়াও আমাদের সারা বিশ্বে ভালো ফরজেনপলিসি ও গণতন্ত্র দরকার।‘ তিনি মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প সঠিক ব্যক্তি হবেন যিনি আমেরিকাকে মহান করে তুলবেন। আর তাই ট্রাম্পকেই ভোট দেবেন তিনি।
নিউ ইয়র্ক প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট নাসির খান পল বলেন, একজন আমেরিকান বাংলাদেশি মুসলমান এবং সাধারণ নাগরিক হয়ে যদি আমরা সবকিছু বিবেচনা করি তবে অবশ্যই ট্রাম্পকে ভোট দিব। কারণ আমরা কোন যুদ্ধ চাই না, ৬০,০০০ নিরীহ মুসলমানকে বাইডেন অলরেডি মেরে ফেলেছে। তাদের হাত মুসলমানের রক্তে ভরা।
তিনি আরও বলেন, বাইডেন- কমলার আমলে সবকিছুতেই ট্যাক্স বেড়েছে। আমরা যুদ্ধ বন্ধ করতে চাই এবং জিনিস পত্রের দাম কমাতে চাই। সব কিছু একমাত্র ট্রাম্প ঠিক করতে পারবেন। তাই এবার প্রচুর বাংলাদেশি আমেরিকান ট্রাম্পকেই ভোট দিবেন।‘
আমেরিকান বাংলাদেশি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির চেয়ারম্যান, জ্যাকসন হাইটস বাংলাদেশি বিজনেস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি গিয়াস আহমেদ পুরোদস্তুর মূলধারার রাজনীতিক।
তিনি বলেন, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আর ২০২৪ সালের নির্বাচনে কিছু পার্থক্য আছে। গতবার আমি রিপাবলিকন হওয়া সত্ত্বেও ট্রাম্পকে ভোট দেইনি। এবার গাজা নীতি, লেবানন ইস্যুতে দুই পার্টির কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু এই দুটি ইস্যুর কারণে কমলা হ্যারিস বেশ কিছু মুসলিম ভোট হারাবেন। এমন কি নতুন এবং তরুণ ভোটারদেরও। এর মধ্যে কিছু তরুণ-তরুণী ভোট দেয়া থেকেই বিরত থাকবে বলে জানিয়েছে।
তিনি আরেকটি প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, এবারের নির্বাচনে থার্ড পার্টি অর্থাৎ গ্রিন পার্টি বড় ফ্যাক্টর। থার্ড পাটির প্রার্থীর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু গ্রিন পার্টি প্রার্থী জিল স্টেইন বেশি ভোট কাটবেন ডেমোক্রেটিক প্রার্থী কমলা হ্যারিসের। ফলে সুইং স্টেটগুলোতে মুসলমানদের ভোট ভাগ হয়ে যাবে। তাছাড়া আমেরিকার লিবারেল ইউনিভার্সিটির মুসলিম শিক্ষার্থীরা গাজা ইস্যুতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইসরায়েলের পক্ষ নেয়ায় সেখানেও কমলা হ্যারিস ভোট হারাবেন। গিয়াস আহমেদ মুসলিম ভোটারদের হিসাব নিকাশ করে বলেন, এবার ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা বেশি। কারণ মুসলিম ভোটের বিষয় প্রধান কারণ।
কমিউনিটি অ্যাকটিভিস্ট ও নিউ ইয়র্ক প্রবাসী ব্যবসায়ী সৈয়দ আল আমিন রাসেল বলেন, ইমিগ্র্যান্ট মুসলিমদের ডেমোক্র্যাট পছন্দ করার অনেক কারণ আছে। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মাইনোরিটির সিভিল রাইটস রক্ষা করা, নানান সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার, বড় লোকদের প্রগ্রেসিভ ট্যাক্স, গান কন্ট্রোল, ইমিগ্রেশন ল, বর্ডার ওয়াইডলি খুলে রাখা ইত্যাদি। কিন্তু ধর্ম কিভাবে তার একটা কারণ তার লজিকটা বুঝলাম না। কমলা বড় হয়েছেন ব্যাপ্তিস্ট চার্চ আর হিন্দু ট্যাম্পলে গিয়ে। উনার স্বামী একজন বিশিষ্ট 'ইহুদি' আইনজীবী ডোগলাস এমহফ। কমলার ভাষ্যমতে 'ইসরায়েল নিজেদের ডিফেন্ড করার জন্য যতটুকু সহায়তা দরকার উনি সেটা করবেন।'
তবে, শেষ পর্যন্ত কে জিতবে, তা ভবিষ্যদ্বাণী করা খুব কঠিন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদে যেই জিতুন না কেন, সামগ্রিকভাবে আমেরিকান রাজনৈতিক ভূখণ্ডে বাংলাদেশি ভোটারদের প্রভাব অবশ্যই বাড়ছে এবং আগামী বছরগুলোতেও বাংলাদেশি ভোটারদের উপেক্ষা করা উভয় পক্ষের জন্যই কঠিন হবে।
এমটিআই