বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারী

  • সেলিনা হোসেন | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০১৭, ০১:২৮ পিএম
ছবি: সংগৃহিত।

ঢাকা: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নারীর জীবন অধ্যয়নের একটি বড় দিক। এই যুদ্ধে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে।

পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ ছিল তার জীবনবাজি রাখার ঘটনা। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে মূলধারায় স্থাপন না করার ফলে নারীর প্রকৃত ইতিহাস যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। নারী মুক্তিযুদ্ধে যে গৌরবগাথা রচনা করেছিল তা ধর্ষিত এবং নির্যাতিত নারীর ভূমিকায় অদৃশ্য হয়ে আছে। প্রকৃত অবদান খুঁজে নারীকে মূলধারায় না আনার আরও একটি কারণ, নিম্নবর্গের নারীরাই ব্যাপকভাবে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। নিম্নবর্গ নারীর ইতিহাস ক্ষমতাশীল সুশীল সমাজের কাছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করে স্বাধীনতার তিন দশক পরে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ বিষয়ে গবেষণা পর্যায়ে খানিকটুকু কাজ হয়েছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষিতজন এবং নিরক্ষর অধিকাংশ মানুষের প্রচলিত ধারণায় মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেনি। নারীযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে গুটিকয় নারী। যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে নারীদের ধর্ষণের ঘটনা প্রচার লাভ করেছে অনেক বেশি। যে কারণে নেতা-নেত্রী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষিতজনরা অবলীলায় বলে যান, ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা...। ধর্ষণ, নারী নিপীড়নের ঘটনা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা। যুদ্ধের সময়ে নারী-ধর্ষণ শত্রুপক্ষের যুদ্ধ কৌশল। এর দ্বারা লড়াকু প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে, নৈতিকভাবে দুর্বল করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এখানে ইজ্জতের প্রশ্ন ওঠে না। যুদ্ধে নারীর মর্যাদা সমানভাবে যোদ্ধার ধর্ষিত নারী বলে তাকে অভিহিত করলে আজীবনের জন্য একটি চিহ্ন তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। ধর্ষণকে একটি দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য করলে সেটি একটি সাময়িক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। নারীর মর্যাদাহানিতে লেজুড়ের মতো আটকে থাকে না। এভাবে ভাষা ব্যবহারে পুরুষের আধিপত্য নারীকে বন্দী করে রাখে। কয়েকজনের কথা বললে বোঝা যাবে নারীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কত বড় সহায়ক শক্তি ছিল। সাধারণ মানুষ জানতে পারবেন যুদ্ধ নারীকে কত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়ার মতো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাননি। অদৃশ্য হয়ে গেছে এসব নারী। এগিয়ে আছে পুরুষরা। কারণ ক্ষমতা, রাজনীতি এবং পুরুষতন্ত্রের সুবাদে পুরুষরা সুযোগ গ্রহণের মুখ্য ভূমিকায় থাকে।

নারীযোদ্ধা করুণার কথা। বর্তমানে করুণা বেগম থাকেন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে দোয়ারিকা-শিকারপুর ফেরিঘাটের মাঝে অবস্থিত রাকুদিয়া গ্রামে। যুদ্ধ শুরু হলে তার স্বামী শহীদুল হাসান যুদ্ধে যোগদান করেন। একদিন রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন শহীদুল। তারা তাকে গুলি করে হত্যা করে। করুণা তিন বছরের শিশুকে মায়ের কাছে রেখে স্বামীর মৃত্যুর এক মাস পরে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন। বরিশালের মুলাদী থানার কুতুব বাহিনীতে তিনি আরও অনেকের সঙ্গে অস্ত্র-প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এই বাহিনীর ৫০ জন নারীযোদ্ধার তিনি কমান্ডার ছিলেন। তিনি গ্রেনেড, স্টেনগান এবং রাইফেল চালানো শেখার পাশাপাশি বিস্ফোরক দ্রব্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। তিনি ছদ্মবেশে, পাগলিনী সেজে শত্রুশিবিরে অপারেশন চালিয়েছেন। তার এ অসম সাহসের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনের দায়িত্ব পান। পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তঘাঁটি ছিল মাহিলাপাড়ায়। ৫ জন নারী এবং ১০ জন পুরুষের একটি দল করুণা বেগমের নেতৃত্বে এই ঘাঁটি আক্রমণ করেন। তিনি নিজেই পর পর পাঁচটি গ্রেনেড ছুড়ে আক্রমণের সূচনা করেন। চার ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যান তারা। ১০ জন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। তাদের দলের একজন আহত হন। পাকবাহিনীর এলোপাতাড়ি গুলি করুণা বেগমের ডান পায়ে বিদ্ধ হয়। বর্তমানে তিনি ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেন। পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা এই নারী এখন কেমন আছেন? ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি দুটি রাষ্ট্রীয় ভাতা পেয়েছিলেন। একটি স্বামী শহীদ হওয়ার কারণে, অন্যটি নিজে যুদ্ধাহত বলে। ছেলে ১৮ বছর হওয়া পর্যন্ত ভাতা পেয়েছিলেন। এখন তিনি আর কোনো ভাতা পান না। এখন তার পেট চালানো দায়। কোন রাজাকার তার স্বামীকে হত্যা করেছিল, এ কথা বলার সাহস তিনি হারিয়ে ফেলেছেন।

মিরাসি বেগম আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা। তার পৈতৃক বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা থানার পায়েরতল গ্রামে। তিনি স্বামীর মৃত্যুর পর চার ছেলেমেয়ে নিয়ে মদন থানায় রান্নার কাজ করে সংসার চালাতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী মদন থানার দিকে আসছে খবর পেয়ে থানার পুলিশরা ১২টা রাইফেল মিরাসি বেগমের কাছে রেখে চলে যায়। মিরাসি রাইফেলগুলো নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের কাছে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি স্টেনগান চালানো ও গ্রেনেড ছোড়ার প্রশিক্ষণ নেন। তিনি অল্প সময়ে আগ্নেয়াস্ত্র চালানোয় দক্ষ হয়ে ওঠেন। সেই সঙ্গে ছিল তার অকুতোভয় মনোভাব। মিরাসি ক্যাম্পে একদিকে রান্নার কাজ করতেন, অন্যদিকে ছদ্মবেশে অস্ত্র-গোলাবারুদ আনানেওয়া করতেন। তিনি মদন, কান্দাহার, বাজিতপুর ও কাপাসটিয়ায় সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। একাত্তরের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে যুদ্ধে যুক্ত রেখেছিলেন।

দক্ষতার সঙ্গে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেছিরেন। স্বাধীনতার পরে কমান্ডারের সঙ্গে নিজে গিয়ে অস্ত্র জমা দেন। এখন তিনি কেমন আছেন? মো. আবু সাঈদ লিখেছেন : ‘দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যে নারী দেশের মুক্তির জন্য নিজের ভিটেমাটি পর্যন্ত শেষ করেছিলেন, তিনি আজও সর্বহারা। দিনে দিনে তার স্মরণশক্তি লোপ পেয়েছে। নুয়ে পড়েছে শরীরের প্রতিটি পেশি। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জরাগ্রস্ত এই যোদ্ধাকে এখন লোকে বলে অর্ধপাগল। অর্থাভাবে চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত তিনি। ঘরহারা এই যোদ্ধা মাঝে মাঝে থাকেন মদন তানায় তার ভাইপোর কাছে। আবার চলে যান বিভিন্ন মাজারে। এখন মাজার, গাছতলা আর ক্ষুধা একাত্তরের এই বীর মুক্তিযোদ্ধার নিত্যসঙ্গী। ’

মুক্তিযোদ্ধা কাঞ্চনমালার বাড়ি লৌহজং থানার কমলা ইউনিয়নের ডহরি গ্রামে। মুক্তিযুদ্ধের দুই বছর আগে তার বিয়ে হয় নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর থানার বিরিশিরি গ্রামে। এই গ্রামেই তিনি ধরা পড়েন পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর জাহিদের হাতে। মেজর তাকে একটি ঘরে আটকে রেখে পাশবিক নির্যাতন চালায়। একদিন ঘর খোলা পেয়ে দৌড়ে পালাতে গেলে সিপাহিরা তার পিছু তাড়া করে। সোমেশ্বরী নদীর ধারে ওরা তাকে ধরে ফেলে। প্রচণ্ড প্রহারে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। মরে গেছে ভেবে তারা তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। জ্ঞান ফিরলে দেখতে পান বাড়ইকান্দি মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে শুয়ে আছেন তিনি। একজন মুক্তিযোদ্ধা ওই নদীর ধার দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে দেখতে পেয়ে ক্যাম্পে নিয়ে আসেন। তাকে চিকিৎসার জন্য ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরা হাসপাতালে পাঠানো হয়। সুস্থ হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন ভারতের তুরা ক্যাম্পে এবং স্থানীয়ভাবে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। যুদ্ধের বাকি সময় তিনি টাঙ্গাইল ও ঘাটাইলে অবস্থান করেন। মির্জাপুরের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে সাফল্য অর্জন করেন। নার্স হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তুরার হাসপাতালে। ফলে আহত যোদ্ধাদের শুশ্রূষায়ও তিনি ছিলেন একজন অপরিহার্য ব্যক্তি। তিনি এমন একজন নারীর উদাহরণ যিনি ধর্ষণের শিকার, সশস্ত্র যোদ্ধা এবং সেবিকা। এই নারীও রাষ্ট্রের কাছে থেকে কোনো স্বীকৃতি পাননি, বরং অদৃশ্য হয়ে গেছে তার বীরত্ব, সাহস আর শুশ্রূষার মতো মমতার কাজ। স্বাধীনতার পরে উপেক্ষিত হয়েছেন পরিবারে মূলত স্বামীর কাছে, সমর্থন পেয়েছেন শ্বশুরবাড়ির অন্যদের কাছে। তারপরও টেকেনি বিয়ে। তিনি বলেছেন, ‘আমি তো স্বেচ্ছায় পাকবাহিনীর কাছে যাইনি। আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। তখন কেন এ সমাজ উদ্ধার করল না? তখন কোথায় ছিল এ সমাজ, কোথায় ছিল আমার স্বামী? যখন যুদ্ধ শেষ করে দেশ স্বাধীন করলাম, তখন আমি নষ্ট হলাম না। দেশ স্বাধীনের পরে যখন মুক্তিযুদ্ধে আমার প্রয়োজন শেষ, এখন নষ্ট হয়ে গেলাম! নারী হয়ে জন্মেছি বলে সব দোষ আমার। ’ এ পর্যন্তই আপাতত শেষ করা যায়। আরও এমন অসংখ্য নারী আছেন যারা অসংখ্য প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছেন সমাজকে, রাষ্ট্রকে।

এ গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের যুদ্ধের দিক। আর কী করেছে নারীরা? প্রবাসী সরকার নূরজাহান মুরশিদকে ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দান করে। তার দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য ভারতের সর্বত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচার অভিযান পরিচালনা করা। তিনি ভারতের পার্লামেন্টের যুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য স্মরণীয় বক্তৃতা করেন। তার এই অপরাধের জন্য পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার দণ্ডাদেশ জারি করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বদরুন্নেসা আহমেদ। তাকে ‘মুজিবনগর মহিলা পুনর্বাসন কার্যকলাপ ও মহিলা সংগঠন’-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নির্দেশে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতেন। তার দায়িত্বের মধ্যে ছিল শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে রিপোর্ট প্রদান, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও নারী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। মুজিবনগর সরকার ভারত সরকারের সহযোগিতায় কলকাতার পদ্মপুকুর এলাকার গোবরাতে নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। এ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের মধ্যে ছিল ফার্স্ট এইড ও নার্সিং প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র চালনা শিক্ষা।

স্বাধীনতাকামী জনগণের মনোবল দৃঢ় রাখার উদ্দেশ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে নারীরা। খবর পাঠ করে, কথিকা পড়ে, গান গেয়ে বেতারে  অনবরত প্রচারের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা। শিল্পীরা গঠন করেছেন ‘মুক্তিযুদ্ধ শিল্পী সংস্থা’। ভারতের বিভিন্ন স্থানে সংগীত পরিবেশন করে তারা সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। এ ছাড়া সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, গেরিলা যুদ্ধে শত্রুর অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রেকির ভূমিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রন্ধনশালায়, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করে, হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রূষায়, গ্রামে শহরে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়দান করে, শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়ে আবার অস্ত্র হাতে লড়াই করে, বিভিন্ন দূতাবাসে প্রবাসী সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে, সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে জনযুদ্ধের সাফল্যকে নিশ্চিত করেছিল নারীরা। তাদের ব্যতিক্রমী অবদান হিসেবে দুজন নারীকে ‘বীরপ্রতীক’ খেতাবে ভূষিত করা হয়েছিল।

বীরত্বগাথার এমন অবদান সত্ত্বেও সাংগঠনিক প্রতিনিধিত্বের অভাবে অসংখ্য নারী মুক্তিযোদ্ধা আড়ালে পড়ে থাকেন। তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া তো দূরের কথা তাদের পরিচিতি সংরক্ষণ করার কাজটিও উপেক্ষিত হয়ে এসেছে। অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণে ব্যাপৃত অনুসন্ধানীদের কাছে প্রতিনিয়ত মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আমরা কি ভুলতে পারি বসবার কুল্লাপাথরের ৫১ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধিস্থল গড়ে ওঠার ইতিহাস! মুক্তিযোদ্ধা আবদুল করিমের মা মহীয়সী নারী আরজাতুন নেসা তার স্বামী আবদুল মান্নানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস এই এলাকায় এবং এলাকার আশপাশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করেন। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সেসব লাশ গোসল করিয়ে বীরের মর্যাদায় দাফন করার দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল এবং লাশ ধোয়ানোর চৌকিটি যার স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে। আরজাতুন নেসা ১৯৭৩ সালেই মৃত্যুবরণ করেন। স্বাধীনতার পর শহীদদের স্বজনরা লাশের খোঁজে আসতেন। কবরের ওপরে পড়ে আহাজারিতে ভরিয়ে তুলতেন তাদের বাড়ির চারপাশ। আরজাতুন নেসা সেসব নারীকে বুকে জড়িয়ে টেনে তুলতেন। গোসল করিয়ে ভাত খেতে দিতেন। তার ছেলে আবদুল করিম বলেন, ‘তাদের কান্নায় মায়ের বুকও ভেঙে যেত। সেই শোকে-দুঃখে মা আমার বেশি দিন বাঁচেননি। ’ পুরো দেশেই নারী মুক্তিযোদ্ধাদের এরকম বীরত্বগাথা রয়েছে, যা এখনো মুক্তিযুদ্ধের নির্মম অভিজ্ঞতার স্বাক্ষর বহন করছে।

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ এর একটি খণ্ডে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ডোম রাবেয়া খাতুন নারীদের ওপর নির্মম অত্যাচারের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার দায় নারীরা বহন করেছে স্বাধীনতার জন্য। তাদের অনেকে স্বাধীনতার পরে জন্ম দিয়েছে যুদ্ধশিশু। বেশিরভাগ নারী স্বাধীনতার পরে সমাজের পুরুষতন্ত্রের নির্মম আচরণে ভালোবাসা পায়নি, স্বামী-সন্তান পায়নি। অবজ্ঞায়, অবহেলায় পাগল হয়ে পথে পথে দিন কাটিয়েছে অনেকে। আর যারা ধর্ষণের শিকার হয়েও পরিবারে ঠাঁই পেয়েছে তাদের ঠেলে রাখা হয়েছে অন্ধকার কুঠরিতে, রাখা হয়েছে খুব সাবধানে, আড়াল করে। দিনের আলোয় বের হতে দিয়ে কেউ বলেনি, এসো এই নারীর বীরত্বগাথার জন্য তাকে সংবর্ধনা দিই। পরবর্তী প্রজন্মকে বলি এদের দেখ। এদের মূল্য তোমরা শোধ করতে পারবে না। তাই মুক্তিযুদ্ধে নারীর ইতিহাস নারী-অধ্যয়নে প্রতিফলিত হতে হবে।

আমি আমার ‘যুদ্ধ’ উপন্যাসটি শেষ করেছি এভাবে : যুদ্ধে একটি পা হারিয়ে প্রেমিক ফেলে এসেছে স্বাধীন দেশে। প্রেমিকা তখন পাকিস্তান সেনা কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার ফলে গর্ভবতী। দুজনের যখন দেখা হয় তখন প্রেমিকা প্রেমিককে বলে, ‘ভালো কইরে দেখো হামাক। তুমহি দেছো পা। হামি দিছি জরায়ু। তুহমার পায়ের ঘা শুকায়ে গেছে। কয়দিন পর হামারও জরায়ুর ঘা শুকায়ে যাবে। হামি ভালো হয়ে যাব। ’

নারীর জীবন এবং নারীর অধ্যয়নকে এভাবে মেলাতে হবে। নারীর জীবনে যে চিত্র প্রতিফলিত হয় তার পরস্পর সংযুক্তি সাহিত্যে ঘটবে। বাস্তবতার নির্মমতার ভিতর দিয়ে এগোবে সাহিত্য। আমাদের শিক্ষার্থী, গবেষক, শিক্ষকরা যদি অনবরত নারী জীবনের অনুপুঙ্খ বিবরণ এবং গভীর মাত্রা সামনে না নিয়ে আসেন তাহলে নারী-অধ্যয়নের বিষয়টি উপরি-অধ্যয়ন হবে, গভীরতম অন্তরালোকটি অদৃশ্য হয়েই থাকবে। যে কারণে সমালোচনা শুনতে হয় যে, নারী বিষয়ক লেখাগুলো বিদেশি অর্থে প্রভাবান্বিত বাইরের মানুষের দৃষ্টি দিয়ে দেখা। যেখানে বাংলাদেশের নারীর জীবন অস্পষ্ট ছায়ার মতো দেখা যায়, সে দেখায় আলো নেই। নারীর জীবন খুঁজে দেখার প্রকৃত চেষ্টা অনুপস্থিত। লেখক : কথাসাহিত্যিক।

সেনালীনিউজ/ঢাকা/এআই