ঢাকা : হিমেল বরকত। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। তিনি একজন কবি, প্রাবন্ধিক, গীতিকার, গবেষক, ছিলেন দক্ষ সংগঠক। শিশুদের জন্যও লিখেছেন। ২০২০ সনের ২২ নভেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছেন আকাশের ঠিকানায়। আজ (২৭ জুলাই) তার ৪৪তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনকে সামনে রেখে স্যারকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতায়।
১
২০০৯ সনের শুরুর দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তির মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে গিয়ে দেখি, একজন শিক্ষকের নাম ‘হিমেল বরকত’। এ কেমন নাম রে বাবা! নাম দেখেই মনে হয়েছিলো এই বিভাগে এবং ওই অদ্ভুত স্যারের নামের মানুষটার মধ্যে ভিন্ন রকম একটা জগত আছে।
যাইহোক, ২৬ এপ্রিল ক্লাস শুরু হলো। ২৭ এপ্রিল পরিচয় হলো আরও একজন অদ্ভুত দুনিয়ার মানুষের সাথে। সে আমার সহপাঠী বন্ধু রাইয়ান-সুহান-আল-রাজী। চোখ টানটান করে রাইয়ান রাজী আমাকে কইলো- সাইফুল, জানো, হিমেল বরকত কে? আমি বলি- না। আরে, সে হলো কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ছোটো ভাই।
আমি ততদিন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে চিনি ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতা ও ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’ গানের রচয়িতা হিসেবে। এরপর কেমনে কেমনে জানি ওই সময়কার শিমুল সালাহ্ উদ্দিন ও সাদিকা রুমনের পরিচর্যায় চালিত ক্যাম্পাসের আবৃত্তি সংগঠন ‘ধ্বনি’র সাথে যুক্ত হয়ে যাই। এই সংগঠনে আমাকে বন্ধু রাইয়ান রাজী টেনে নিয়ে গিয়েছিলো। ধ্বনিতে প্রথম নাকি দ্বিতীয় দিন গিয়েই দেখি হিমেল বরকত স্যার সপ্তম ছায়ামঞ্চের বট গাছের তলায় ক্লাস নিচ্ছেন।
ন্যাটা দিয়ে বসে পড়লাম। গ্রাম থেকে ক্যাম্পাসে হঠাৎ অবতরণ হওয়া আমি চোখ বড় বড় করে স্যারকে দেখছি। উনি মুখ দিয়ে ম্যাজিক ছড়াচ্ছেন। পড়াচ্ছেন ছন্দ। স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, পয়ার, মুক্তাক্ষর, বদ্ধাক্ষর, তাল, লয়, মাত্রা এইসব নিয়া তার পাঠের আসর। একের পর এক ভেঙ্গে যাচ্ছেন শব্দ-
অ বি মৃশ্ শো কা রি
কিং কর্ তোব্ বো বি মূঢ়্ হো
চিন্ হো
ব্রাম্ হোন
ব্রম্ হো পুত্ ত্রো
এভাবে নাকি শব্দ ভাংতে হয়। উচ্চারণও নাকি এসবের এই রকমই। আমার সারা জীবনের শেখা উচ্চারণ- ‘চিন্নো, ব্রাম্মন আর ব্রক্ষপুত্র’ ওই দিন থেকে ভেস্তে চলে গেলো।
উনি বলতে ছিলেন-
‘ছিপখান তিন দাঁড় তিনজন মাল্লা
চৌপর দিনভোর দ্যায় দূর- পাল্লা’
এসব যে ৪/৪/৪ মাত্রার আয়োজন ওইসব তিনি কেটেকুটে পর্বকে আলাদা করে দাগ দিয়ে দেখাচ্ছিলেন।
আবার বলছিলেন -
‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান
কাশীরাম দাশ ভনে শুনে পূণ্যবান’
এইটা নাকি ৮/৬ মাত্রার সংযোজনা। একে নাকি বলে পয়ার ছন্দ।
আমি ওইদিন এতকিছু বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম ষাটের দশকের কবিতার দুর্বল অনুকরণে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে অতি আবেগে লেখা আমার কবিতাগুলো, যেসব আমি অহংকারের বশে ডাইরি ভর্তি করে ক্যাম্পাসে নিয়া আসছি তার সকলই স্যারের ক্লাসের পর থেকে বাতিল মাল বলে গণ্য হলো। ওইদিন বুঝলাম কবিতা লেখা এত সোজা না, প্রতিটা শব্দ খুবই হিসেব করে বসাতে হয়, অক্ষর মাত্রায় মেপে মেপে সাজাতে হয় অনেক অনেক শব্দ।
যাহোক, ক্লাস শেষে সবাইকে নিয়া হিমেল স্যার ডেইরি গেটের দোকানপাড়ে গেলেন। সবাইকে চা-নাস্তা করতে বললেন। চা, সমুচা, সিঙ্গারা খাওয়ার পাশাপাশি চললো ভরপুর সাহিত্য আলোচনা। বহুমুখী আলোচনার সাথে বিড়ির ধোঁয়াও উড়লো বিস্তর। আড্ডা শেষে চা-নাস্তার বিল স্যারই দিয়ে দিলেন এবং অনেকের সাথে করমর্দন করে বিদায় নিলেন। এইসব দেখে ওই নগরে তখন আমার এক ধরণের ঘোরের বাস্তবতা নেমে আসে। জানা ও জানানোর এই ঘোর তৈরির পেছনের প্রধান কুশীলব অধ্যাপক হিমেল বরকত।
এই ঘোর থেকে গোটা ক্যাম্পাস জীবনে খুব কমই বের হতে পেরেছি। তার শেখানো শব্দ ভাঙার মতন করেই ভাঙতে আর গড়তে গড়তেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ হইছে।
২
২০১১ সনে বাংলা বিভাগ রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উদযাপন করে। সম্ভবত হিমেল স্যার ওই আয়োজনের আহ্বায়ক ছিলেন। বিভাগের সকল শিক্ষক এবং অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা এই মহাযজ্ঞ সফল করতে দিন রাত কাজ করে যাচ্ছে। তখন হিমেল স্যারকে ভিন্নভাবে আবিষ্কার করি। প্রতিটা কাজ তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন প্রখর দৃষ্টিতে, যুক্ত হচ্ছেন সরাসরি কখনও হেঁটে হেঁটে আবার দৌঁড়িয়ে দৌঁড়িয়ে। এখানে ওখানে ফোনে কথা বলে সমন্বয় করছেন অনেক কিছু।
যে সব শিক্ষার্থীরা কাজ করছে তারা যেন ওইসময় অন্তত একবেলা দু’মুঠো খেতে পারে অথবা তাদের যেন চা অথবা টা-এর ব্যবস্থা হয় এবং কাজ শেষে শিক্ষার্থীদের হলে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারগুলোও তিনি খুব দায়িত্বের সাথে খেয়াল করতেন।
আমিও ওই আয়োজনের কিছু কাজে যুক্ত ছিলাম। কাজ করতে করতে আবার আড্ডাও হয় বহুক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়ে। একবার স্যারকে বললাম-
আচ্ছা স্যার এই ‘সার্ধশত’ শব্দটা এমন খিটিমিটি কেন? প্রশ্ন শুনে স্যার হাসলেন। তারপর শব্দটা ভেঙ্গে বুঝিয়ে দিলেন।
স+অর্ধ = সার্ধ, ‘স’ এখানে উপসর্গ, এটা ‘সহ’ অর্থে ব্যবহৃত। অর্ধ সহ শত = সার্ধশত। এর মানে দেড়শো বছর।
মানুষের তৈরি শব্দকে ভাঙার অথবা বিশ্লেষণের ক্ষমতা যাদের আছে তারা মানুষ সম্পর্কিত নানা বিষয়ের নাড়িনক্ষত্র সম্পর্কেও ভালো ধারণা রাখেন বলেই আমার বিশ্বাস। হিমেল স্যারও সব কিছু জেনেও হয়ত চুপচাপ থাকেন। তাকে বেশিরভাগ সময় চুপচাপ থাকতেই দেখতাম। চুপচাপ থেকেও তিনি তার নবীন শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতশত কবি গল্পকার গীতিকারদের নতুন লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে লাইন বাই লাইন দাঁড়িকমা সহ পড়তেন। ভুল ধরিয়ে দিতেন অসীম আন্তরিকতায় আর বিভাগে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ মত প্রকাশের স্বাধীনতা দিতেন সবসময়। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন এই বিভাগ, এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রধানত শিক্ষার্থীদের। তারাই এখানকার প্রাণ।
৩
বিভাগের শিক্ষার্থীরা একবার সভা আহ্বান করলো। ওই সভায় বিভাগের শিক্ষকদের পাঠদান পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা, মূল্যায়ন পদ্ধতিসহ বিভাগের সামগ্রিক কর্মযজ্ঞ নিয়ে জ্বালাময়ী আলোচনা হবে। শিক্ষার্থীদের এমন সভা আয়োজনে অধিকাংশ শিক্ষকগণ দ্বিমত পোষণ করলেও হিমেল স্যার সম্মতি দিলেন। সভায় তিনি উপস্থিত থাকলেন।
উপস্থিত শিক্ষার্থীরা ইচ্ছেমতন বিভাগ নিয়ে তাদের ক্ষোভ, হতাশা, প্রত্যাশা ব্যক্ত করলো। স্যার চুপচাপ সব শুনলেন, শোনার ক্ষমতা তার সবসময়ই সর্বোচ্চ, নোটও করলেন। সেসব সমস্যার অনেক কিছুরই বাস্তবায়ন পরে কিছুটা হলেও ঘটেছিলো। ওই সময় বিদায় অনুষ্ঠানসহ নানান ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে কথা বলার একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিলো। সত্যিই মনে হচ্ছিল বিভাগটি শিক্ষার্থীদের।
৪
চতুর্থ বর্ষে যখন পড়ি তখন বাংলা সংসদ, বাংলা বিভাগের নির্বাচন হয়। ওই আয়োজনে ‘সাধারণ সম্পাদক’ পদে আমি জয় লাভ করি। তখনও আমাকে শিক্ষকগণ চিনেন না বললেই চলে। নির্বাচনের দিন যখন ফলাফল ঘোষণা করা হলো তখন হিমেল স্যার আমার নাম ঘোষণা করলেন। আমি সামনে এগিয়ে গেলাম।
স্যার ফুলেল শুভেচ্ছা জানালেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। আমিও আমার হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাতটি নরম করে রাখলাম। স্যার আমার হাত বেশি নরম দেখে জোরে এক চাপ দিলেন, আমিও শক্ত করে ধরলাম তার হাত। কিছুক্ষণ আন্তরিক ঝাঁকুনি দিলেন তিনি। স্যারের এই অনাবিল আন্তরিকতা এখন পর্যন্ত আমাকে উষ্ণতা দেয়, ইতিবাচক যে-কোনও কাজের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করে।
৫
ক্যাম্পাসের নানান যৌক্তিক ও ন্যায্য আন্দোলনে স্যারকে সবসময় পাশে পেয়েছি। বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছেন, আন্দোলনের খরচ জোগাতেও খুবই আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতেন।
শুধু আন্দোলনই না, যে-কোনও বুদ্ধিবৃত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের পথ চলায় তার মতন করে উৎসাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনও শিক্ষককে দিতে দেখি নি। আমিসহ বাংলা বিভাগেরই কয়েকজন সতীর্থকে নিয়ে গঠিত বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন ‘বাংলা’কে তিনি যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছিলেন। একবার ‘ছন্দ ও উচ্চারণ’ বিষয়ক আমরা একটি সেমিনারের আয়োজন করতে চাই। স্যারকে ক্লাসটি নেয়ার অনুরোধ জানাই আমরা। উনি সানন্দে রাজী হন। শুধু রাজীই হন নি, আমাকে ডেকে তার রুমে নিয়ে গিয়ে ক্লাসের রূপরেখা ও বর্ণনা সম্বলিত সমৃদ্ধ কাগজপত্র দিলেন।
ওই পত্র ফটোকপি করে ক্লাসে উপস্থিত সকলকে দিতে বললেন। আমি রুম থেকে চলে আসার সময় ফটোকপি এবং চা-নাস্তার টাকাও দিয়ে দিলেন। এই হলেন একজন ‘হিমেল বরকত’। এভাবে ক্যাম্পাসের কত সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠনকে যে তিনি আগলে রাখতেন মমতায় তার লেখাজোখা নাই।
৬
বিভাগের পড়াশোনা চুকিয়ে ফেলেছি তখন। জাহাঙ্গীরনগরের পাশেই ইসলামনগরে বাসা নিয়ে আমরা বন্ধুরা থাকি। চাকরির পড়াশোনা করি। যে আমি প্রায় সারাদিন বিভাগে থাকতাম সেই আমি আর যাই না বিভাগে, গত আট বছরে একবার গেছি মাত্র। যাহোক, বিভাগে না গেলেও ক্যাম্পাসে কারণে অকারণে যেতে হতো। ২০১৪ সালে বেকারত্বের দিনগুলোতে ক্যাম্পাসে একবার হাঁটছিলাম, হাঁটতে হাঁটতে হিমেল স্যারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্যার হাত বাড়িয়ে দিলেন, হ্যান্ডশেখ করলেন। বললেন কোথায় থাকো? কি করো? কেমনে চলে দিন? পড়াশোনা ঠিকমতন করো কিনা? বললেন- খুব দ্রুতই তোমার চাকরি হয়ে যাবে। তারপর চা খেতে খেতে নানা কথার পর যাওয়ার আগে বললেন- আসলে তোমাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হলেও ভালো লাগে সাইফুল।
২০১৪ সালের পর আর দেখা হয় নাই আপনার সঙ্গে। দেখা না হলেও আমিসহ আপনার অগণিত শিক্ষার্থীরা আমরা সবসময় ভাবতাম- জাহাঙ্গীরনগরের বাংলা বিভাগে শত সীমাবদ্ধতা, দলাদলি, অসঙ্গতির পরেও একজন ‘হিমেল বরকত’ আছেন। যিনি ছিলেন শতভাগ সৎ- উদার, আন্তরিক, মানবিক এবং সৃজনশীল; সেই আপনার তীব্র আন্তরিকতার আকর্ষণে বিভাগে বারবার যাবো আমরা।
কিন্তু সেই আপনি এভাবে, হঠাৎ, একদমই আর না ফিরে আসার জগতে চলে গেলেন! যা কখনোই মানতে পারি না আমরা। আমরা খুবই অনুভব করি আপনার নির্মেদ চেতনা, সততা ও নিষ্ঠাকে।
সোনালীনিউজ/এসএন