মুক্তি বাহিনীর সর্বাত্মক হামলায় দিশেহারা হানাদাররা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২০, ১২:৩২ এএম

ঢাকা : ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর দিনটি ছিল শুক্রবার। এই দিন মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বের ইতিহাস শুরু হয় এবং মুক্তি সংগ্রাম নতুন মাত্রা পায় । মুক্তি বাহিনীর সর্বাত্মক হামলায় পাকিস্তানি হানাদাররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের বেশে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তারা একের পর এক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত করে পাক সেনাদের ফাঁদে ফেলেন। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হয় সম্মুখযুদ্ধ।

মিত্রবাহিনীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে সম্মুখযুদ্ধে এগিয়ে যায় বীর বাঙালী। কুমিল্লায় মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মিয়াবাজারে পাকসেনাদের ওপর হামলা চালায়। ভারতীয় আর্টিলারি বাহিনীর সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধারা মিয়াবাজার দখল করে নেন। আখাউড়ার আজমপুর স্টেশনে দুই পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে দিনভর যুদ্ধ চালিয়ে যায়।

সিলেটের ভানুগাছায় পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত হন। নোয়াখালীতে সুবেদার মেজর লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল সোনাইমুড়ি মুক্ত করে।

এরপর তারা চৌমুহনীতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী মাইজদীতে পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। রংপুরের পলাশবাড়ীতে ১২ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। সাতক্ষীরা থেকে পিছু হটে দৌলতপুরের দিকে যায় পাকবাহিনী। পাকিস্তান এয়ারলাইন্স পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সব ফ্লাইট বাতিল করে। সামরিক কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারি ও নিষ্প্রদীপ ব্যবস্থা পালনের নির্দেশ দেয়।

এদিন ১১নং সেক্টরের মুক্তিবাহিনী কামালপুর বিওপি আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। জুমার নামাজের পর ভারতীয় হামলার প্রতিবাদে একটি মিছিল চট্টগ্রাম শহর প্রদক্ষিণ করে লালদীঘি ময়দানে জড়ো হয়।

জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আল-মাদানীর সভাপতিত্বে এ সভায় বক্তব্য রাখেন কনভেনশন লীগ প্রধান ফজলুল কাদের চৌধুরী, পিডিপির মাহমুদুন্নবী চৌধুরী, ছাত্রনেতা আবু তাহের প্রমুখ।

এইদিন বিকেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার এক জনসভায় ভাষণদানকালে পাকিস্তান বিমানবাহিনী পৌনে ৬টার সময় ভারতের বিমানবাহিনীর স্থাপনাসমূহ ও রাডার স্টেশনসহ অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর ও আগ্রার বিমানবন্দরগুলোতে আকস্মিক বোমাবর্ষণ করে সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা করে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রাক্কালে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে যুদ্ধ ঘোষণা বিলম্বিত করার জন্য অনুরোধ করা হয়।

কারণ তাকে বলা হয় বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঢাকা এবং চট্টগ্রাম আক্রমণ করবে এবং ভারত, পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অপ্রস্তুত পরিস্থিতিতে নিয়ে যাবে। এরপর শুরু হবে ভারতের যুদ্ধ ঘোষণা। এ ব্যাপারে ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল প্রতাপ চন্দ্র লাল ভূমিকা পালন করেন ।

ভারতীয় বিমানবাহিনী কর্তৃক ইতোপূর্বে মুক্তিবাহিনীকে প্রদত্ত অটার এয়ারক্রাফট, হেলিকপ্টার এবং ডাকোটা বিমান দিয়ে ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর বিমান ঘাঁটিতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠিত হয়। ডাকোটা বিমান যেটা ছিল যোধপুরের মহারাজার ব্যক্তিগত বিমান। বিমানটি তিনি ভারতীয় বিমানবাহিনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ মুক্তিফৌজকে উপহার দেন।
দ্বিতীয় বিমানটি ছিল কানাডীয় অটার বিমান, তৃতীয় বিমানটি ছিল ফরাসী হেলিকপ্টার নাম-এলুয়েট ৩। এই দুইটি বিমান ভারতীয় বিমানবাহিনী বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের বিমানসেনা ইউনিটকে উপহার দিয়েছিল। এই বিমানগুলো নিয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে মুক্তিফৌজের নিজস্ব পাইলট ও টেকনিশিয়ানদের নিয়ে গঠিত বিমানবাহিনী দীর্ঘদিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে।

সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিফৌজের ক্ষুদ্র এই বিমানবাহিনী পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে মধ্যরাত ১২:০১ মিনিটে ঢাকার নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে এবং ১২:১০ মিনিটে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় গুপ্তখালি এলাকার বিমানের তৈল সংরক্ষণাগারে আকস্মিক আক্রমণের মাধ্যমে মধ্যরাতে বিমান যুদ্ধের সূচনা করে। এ আক্রমণের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ঐতিহাসিক অধ্যায়ে পদার্পণ করেন এবং পাক বাহিনীর মারাত্মক ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয়।

এর পরপরই বিবিসির সংবাদে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী কর্তৃক আক্রমণের সংবাদটি প্রচার করা হয় এবং সমগ্র পৃথিবী এই যুদ্ধের খবর সম্পর্কে অবহিত হয়। রাতে যশোর, চট্টগ্রাম, তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলায় বিমান হামলা শুরু হয়।

আক্রমণ শুরুর কৃতিত্ব নবগঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে (কিলোফ্লাইট) দেয়া হয়। ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরোরার অধিনায়কত্বে ঘোষিত হয় বাংলাদেশের ভারত যৌথ কমান্ড। ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী হলো মিত্রবাহিনী। গভীর রাতেই মিত্রবাহিনী অবরুদ্ধ বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্ত এলাকায় অবস্থিত মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেয়।

দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ যুদ্ধরত বাংলাদেশের সশস্ত্র ও মুক্তি বাহিনীর সহায়তায় মিত্র বাহিনীর নবম ডিভিশন গরিবপুর-জগন্নাথপুর হয়ে যশোর ঢাকা মহাসড়কসহ চতুর্থ ডিভিশন ষষ্ঠ ডিভিশনের বেশ কয়েকটি এলাকার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। যশোর কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, জেলার আরও কয়েকটি থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। ভারতে জারি হয় জরুরী আইন। সে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্তপর্ব। ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনী সম্মিলিভাবে পূর্ব সীমান্তে অভিযান শুরু করে।

ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের পাক অবস্থানগুলোকে ঘিরে ফেলার প্রচেষ্টায় সীমান্তের ৭টি এলাকা দিয়ে প্রচ- আক্রমণ পরিচালনা করে। ৪র্থ ও দশম বেঙ্গল ফেনী থেকে অগ্রসর হয়ে রেজুমিয়া সেতুতে উপস্থিত হয়। ১নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজ তাঁর বাহিনী নিয়ে অপর বাহিনীর সঙ্গে একত্র হয়।

ফেনী-চট্টগ্রাম সড়ক দিয়ে এই যৌথবাহিনীর একটি কলাম ডান দিকে মুহুরি নদী ধরে এবং অপর কলাম বাঁ দিকে সড়ক ধরে চট্টগ্রামের দিকে এগুতে থাকে। পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে পিআইএর সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়। ভারত ভূখন্ডে পাকিস্তানের আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানালো বাংলাদেশ সরকার। রাতারাতি গড়ে উঠল দুই রাষ্ট্রের যৌথ সামরিক কমান্ড। শুরু হলো মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযান।

মার্কিন সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি রাওয়ালপিন্ডিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে বলেন, তিনি বেআইনী ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাত করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পারেননি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার আলোচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা হয়। তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য পুনরায় পাকিস্তান আসতে রাজি হয়েছেন।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং নয়াদিল্লীতে পার্লামেন্টে বলেন, বাংলদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নির্যাতন বন্ধ করার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চালানোর জন্য ভারত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সরকারকে পরামর্শ দিয়ে আসছে। কিন্তু সে প্রচেষ্টা কোন সুফল বয়ে আনেনি। বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমনে ও ভারত সীমান্তে পাকিস্তানী গোলাবর্ষণে ভারতের নিরাপত্তা বিপদসঙ্কুল হয়ে পড়েছে।

টাইম ম্যাগাজিন জানাচ্ছে, নয়াদিলীতে সহসা অন্ধকার নেমে এলো। সন্ধ্যা ৬টায় ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোতে সাংবাদিকরা একত্র হয়েছিলেন বাংলাদেশের যুদ্ধের খবর সংগ্রহের নিয়মিত কাজে।

তখন বিদ্যুত চলে গেলে প্রেস ব্রিফিংয়ে আসা কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন, এটা ব্লাক আউটের মহড়া নয়, আসল ঘটনা। এই মাত্র আমরা জানলাম, পাকিস্তানী বিমানবাহিনী অমৃতসর, পাঠানকোট ও শ্রীনগরে হামলা করেছে।

বিবিসির বিশেষ সংবাদদাতার রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধ অব্যাহত আছে। পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক গবর্নর ড. আব্দুল মালেক একটি সতর্কবার্তা দেন যে পাকিস্তান একটি বিধ্বংসী যুদ্ধের মুখোমুখি আছে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই