বাংলাদেশ হিটলারের পাশবিকতা মনে করিয়ে দেয়

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১১, ২০২০, ০৮:০৬ পিএম

ঢাকা : ডেইলি মিররের জন পিলজার একাত্তরের অন্যতম সাক্ষী: সাধারণত পাশ্চাত্যে আমরা যারা ধনী তারা দুর্ভিক্ষ, অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ, এমনকি গণমানুষের ধ্বংসযজ্ঞ উড়িয়ে দিই কিংবা যৌক্তিকতা দেখানোর চেষ্টা করি যে দরিদ্র মানুষ যাদের বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় তারা সংখ্যায় অগণ্য। সুতরাং তাদের ছেঁটে দেওয়া ভালো।

শুধু যদি আমরা বলি তারা তাদের নিজেদের সম্পদ সংগঠিত করতে পারবে এবং পাশ্চাত্যের পরিচ্ছন্ন রাজনীতিতে সমর্থন জোগাতে পারবে, তাদের নিশ্চয়ই ছেড়ে দেওয়া যায়। যেসব বিষয় আমাদের বোধগম্য নয় সেসবের বিরুদ্ধে চিৎকার করে আমরা এমন কি কখনো কখনো কোথাও চাপা হাসিও হেসে থাকি : কঙ্গো কিংবা আমেরিকার বিধ্বস্ত প্রজাতন্ত্রগুলো এর উদাহরণ। এদের কোনোটিই পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রে প্রজ্ঞাকে অনুসরণ করেনি। সুতরাং তাদের ভুগতেই হবে। করুণা হয়।

বাংলাদেশ আমাদের ধাপ্পা ধরে ফেলেছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যারা ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গণতন্ত্রের জন্য ভোট দিয়েছিল, পরিচালিত হতে চেয়েছিল মধ্যপন্থি পাশ্চাত্য ধাঁচের মধ্যবিত্ত রাজনীতিবিদদের হাতে। সম্ভবত বোকার মতোই তারা তাদের মুক্তির অনুসন্ধান করছিল, যদিও তাদের যেসব সমস্যা, সেরকম কিছুই আমাদের কখনো মোকাবিলা করতে হয়নি।

শুধু এ কারণেই তাদের হত্যা করা হচ্ছে, এমনভাবে দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ করা হচ্ছে, যা এডলফ হিটলারের স্মৃতিকে মনে করিয়ে দেয়, যার জন্য গোটা পৃথিবীকে যুদ্ধে নামতে হয়েছিল। হিটলারও অবশ্যই ইউরোপীয়দেরই শেষ করে দিতে চেয়েছে।

বাংলাদেশ প্রশ্নে পাশ্চাত্যে আমাদের কারোরই যুদ্ধ যাওয়ার ইচ্ছে নেই। তার বদলে আমাদের নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে আমরা সপ্তাহের পকেট খরচ বাঁচিয়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য দান করেছি। শরণার্থীরা এসে পুঞ্জীভূত হয়েছে ভারতে বাকি সহায়তাটুকু অবশ্যই ভারত করবে।

রাজনৈতিক ব্ল্যাকমেইলের জন্য আণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পৃথিবী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নের মুখোমুখি, তা হচ্ছে বাংলাদেশ বেঁচে থাকবে না মৃত্যুবরণ করবে। মানুষের অমানবিকতার এমন শক্তিশালী আয়না হাতে নিয়ে পৃথিবীর গরিব মানুষরা পৃথিবীর ধনীদের মুখোমুখি আর হয়নি সেজন্যই এটা গুরুত্বপূর্ণ।

বহুলচর্চিত সেই কথাটি আজও সত্য, সারা গ্রহজুড়েই শান্তি ও সভ্যতা এবং প্রগতি নিশ্চিত হবে যখন আমরা যারা ধনী সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্রের সঙ্গে আমাদের ব্যবধান কমিয়ে আনতে শুরু করব। বাংলাদেশ দিয়েই আমরা সেই সুযোগটির সূচনা করতে পারি। কারণ এটি এমন একটি বিষয়, যেখানে আমরা বিংশ শতাব্দীর হারানো আত্মাকে খুঁজে পেতে পারি। হ্যাঁ, অবশ্যই কিছুসংখ্যক মানুষকে অন্তত বাঁচান।

একাত্তরের সাক্ষী নরওয়েজিয়ান সাংবাদিক রলফ র‌্যাঞ্জ

আমরা একদল নরওয়েজীয়, শরণার্থী শিবিরের অবস্থা বোঝার জন্য ভারতের উত্তরভাগে কুচবিহারে আসি। একজন টেলিভিশন প্রতিবেদক, দুজন ক্যামেরাম্যান এবং আমি, সাবেক সাংবাদিক, বর্তমানে নরওয়েজিয়ান চার্চের তথ্য কর্মকর্তা।

আমাদের প্রথম ধারণা, সবাই অতিরিক্ত প্রচারণা। আমরা বহুসংখ্যক শরণার্থী এবং সাংবাদিক হিসেবে যেসব সংবাদপত্র আমি পেয়েছি, তার ওপর আমার আস্থা ছিল না। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ফেলা, হত্যাকা- ও ধর্ষণের গল্প আমার কাছে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা বলেই মনে হয়েছে।

যখন আমাদের মতামত অন্যদের জানালাম, তারা জবাব দিল, অপেক্ষা করুন, সীমান্তে গিয়ে নিজেরাই দেখে আসুন। মে মাসের এক সকালে আমরা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের দিকে এগোলাম। সূর্য মাত্র উদিত হয়েছে, শিশিরকণা চিকচিক করছে, প্রশান্ত ও মনোরম নিসর্গ। বিস্তীর্ণ সবুজ ধানক্ষেত, মাঝেমধ্যে অবিন্যস্ত তালগাছ। আধঘণ্টা অপেক্ষার পর দেখলাম, রাস্তা দিয়ে মানুষ আসছে।

এরা সব শরণার্থী মানুষের অন্তহীন এক স্রোত। আমরা ৫০০ গরুর গাড়ি গুনলাম। গাড়ির দুই পাশে পায়ে হাঁটা মানুষ, এক-একটা গাড়িতে সাত-আটজন। তরুণ ও বৃদ্ধ। তারা দ্রুত হাঁটতে চেষ্টা করছে। হাত ওপরে তুলছে এবং চিৎকার করতে শুরু করেছে। মনে হলো তাদের দুরবস্থার কথা আমাদের জানাতে তারা উদগ্রীব।

সামনের দিককার লোকজন দৌড়ে আমাদের কাছে এলো, চিৎকার করে যেদিকে থেকে এসেছে, সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করল। আমরা কেউই বাংলা বলি না, কিন্তু তাদের কথা বুঝতে আমাদের সমস্যা হলো না।

যে গ্রাম তারা ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছে, তা আগুনে পুড়ছে। সাদা চুলের একজন বুড়ো মানুষ আকাশের দিকে হাত তুলে ক্ষোভে কেঁদে উঠল। অঙ্গভঙ্গিতে আমাদের বলল, তার আটটি সন্তানের সবকটি নিহত হয়েছে।

গলা বরাবর একটি আঙুল তুলে লোকটি এ কাহিনী শোনাল। শরণার্থীরা তাদের গল্প শোনানোর জন্য এতই উদগ্রীব যে, আমরা যে তাদের ভাষা বুঝি না, এটাও তারা আবিষ্কার করতে পারেনি।

সবল মুঠিতে একজন লোক আমার বাহু চেপে ধরল। সে মেয়েটির দিকে আঙুল দেখাল। আমি বুঝলাম, এটি তার কন্যা এবং সে আমাকে এই মেয়েটির মা সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চায়। পূর্ব পাকিস্তান সীমানার ভেতরে তার ভয়াবহ কিছু একটা হয়েছে। দুই-দুইবার আমাকে তার গল্পটা বলতে চেষ্টা করে। প্রতিবারই সে ঢোক গিলে মুখে ফুটে বলতে চেষ্টা করছে এবং প্রতিবারই সে অসহায় কান্নায় ভেঙে পড়ছে। আমার হাত ধরে রেখে সে তার দুঃখের কান্না কেঁদে যায়।

কোনো কথা না বলে একজন মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার গাল বেয়ে অশ্রু নামে। এমন প্রকাশ্যে মা-বাবার কান্না দেখে সন্তানরা ভয় পেয়ে যায় এবং আর্তচিৎকার করতে থাকে। বয়স্কদের অনেকেই হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে একটি কথাও না বলে আমাদের পাশ দিয়ে চলে যায়। আমরা তখন শরণার্থী স্রোতের মাঝখানে, মানুষের এক ভয়ংকর নদীতে।

কান্নাভেজা চোখে দুই পাশের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। গরুর গাড়িতে হাত-পা ছড়ানো মানুষ, অনেকেই আহত। খালি হাতের মুঠিতে একজন গরুর গাড়িতে আঘাত করে যাচ্ছে। দুঃখে শক্ত হয়ে যাওয়া জমাট শীতল মুখাবয়বের অনেকেই সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি ক্যামেরাম্যানের দিকে দৃষ্টি ফেললাম। আবিষ্কার করলাম, ছবি তুলতে তার সমস্যা হচ্ছে। অশ্রু সংবরণ করতে গিয়ে সবসময়ই একটু পরপর চোখ মুছে তা শুকনো রাখছে। ক্যামেরাতে তাকাতে গিয়ে তাকে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কিন্তু তার কান্না আরও তীব্র হয়ে উঠছে। শেষ পর্যন্ত অসহায় পরিস্থিতিতে ক্যামেরা থেকে হাত সরিয়ে নেয়।

এ ছবি সে তুলতে পারবে না। নরওয়েজিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের টিভি প্রতিবেদক সারাক্ষণ কথা বলেই যাচ্ছে। আমি তাকে বলতে শুনলাম, ‘ভয়াবহ কিছু একটা ঘটেছে। এই মানুষগুলো আসছে আগুনে জ¦লছে এমন একটি গ্রাম থেকে। সেখানে গোলাগুলি হয়েছে এবং বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তারা আমাদের বলছে... আমি আপনাদের এর বেশি কিছু বলতে পারব না। যে ছবি আপনাদের সামনে উপস্থাপন করছি সে ছবিই কথা বলবে।’

আর তারপর আমি আবিষ্কার করলাম, সে আর কথা বলতে পারছে না। সেও কাঁদছে। আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। চোখ ফেটে অশ্রু নেমে এলো এবং আমরা রাস্তা ছেড়ে একপাশে চলে এলাম, যাতে শরণার্থীরা যেতে পারে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই