ঢাকা : করোনা মহামারীর কারণে গত বছর স্থবির হয়ে পড়ে বিশ্ব। থেমে যায় কলকারখানার চাকা। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষকে ঘর বের হতে নিষেধ করা হয়। বাংলাদেশে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে ৩১ মে পর্যন্ত লকডাউন চলে। সে সময় বন্ধ থাকে সব অফিস-আদালত, কল-কারখানা। এতে বেকার হয়ে পড়ে অসংখ্য মানুষ। দিনমজুরদের অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়।
মহামারীতে জীবন ও জীবিকার ওপর আঘাতের যে চিত্র বছরজুড়ে মানুষ দেখেছে, গত ১০০ বছরেও তা দেখা যায়নি। দেশে দারিদ্র্য ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩০ শতাংশ হয়েছে। নতুন করে গরিব হয়েছেন ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। তারপরও সরকার বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা দিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করার কাজ শুরু করে। এতে সুফল আসা শুরুর সময়ে বিশ্বজুড়ে ফের বাড়তে শুরু করে করোনা সংক্রমণ, যা দ্বিতীয় ঢেউ নামে পরিচিত। ফের করোনার আঘাতে নতুন করে দারিদ্র্য বাড়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
করোনার কারণে ব্যাপকসংখ্যক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের অনেক উদ্যোক্তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও অনেক উদ্যোক্তা ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। অনেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। বেকার ও চাকরিচ্যুতদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকগুলো এখনো বেশ খানিকটা ভঙ্গুর। এ অবস্থায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ঝুঁকি নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন বছর। বিশেষ করে, রপ্তানি-আমদানির চিত্র অনেকটা স্থবির অবস্থায় রয়েছে। রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ১ শতাংশ। আমদানি কমে গেছে ১৩ শতাংশের বেশি। বেসরকারি বিনিয়োগেও ভাটা পড়েছে। রাজস্ব আয় ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন চিত্রও বেশ হতাশাব্যঞ্জক। অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে কিছুটা আলো দেখিয়েছে রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ। তা সত্ত্বেও করোনার কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় চলতি বছরেও অব্যাহত থাকার শঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) বলছে, গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত দারিদ্র্যের হার ১৯ থেকে বেড়ে ৩০ হয়েছে। নতুন করে গরিব হয়েছে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। আগে থেকেই সাড়ে ৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচেই বসবাস করত। জুলাইয়ে মোট দরিদ্রের সংখ্যা ৫ কোটি ওপরে ছিল।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনায় দারিদ্র্য ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। গত জুনে পিপিআরসি ও বিআইজিডির যৌথ গবেষণায় এসেছে, দারিদ্র্য দ্বিগুণের বেশি হয়ে ৪৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে করোনায় মানুষের আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে যাদের আয় ছিল প্রতিদিন ১০০ টাকা তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮০ টাকায়।
বাংলাদেশ ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের (বিইএ) মতে, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ঘোষিত ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটিতে প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছিলেন। কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতের চাকরিজীবীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। বিইএর সভাপতি ড. আবুল বারকাতের মতে, ওই সময়ে বাংলাদেশির আর্থসামাজিক অবস্থানের অবনমন ঘটেছে প্রায় ৫৫.৫ মিলিয়ন। তবে কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। এ খাতে ঊর্ধ্বগতি করোনাকালেও অটুট রয়েছে। আমদানি কম হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো অবস্থায় রয়েছে, ৪৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এরপরও নতুন বছরে ক্ষয়ে যাওয়া অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করাই সরকারের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মনে রাখতে হবে ২০২০ সালের করোনার কারণে সৃষ্ট বিপর্যয় এ বছরেও অব্যাহত থাকবে। নতুন বছরটি আমাদের জন্য কম বৈরী হবে এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। নানা ধরনের অভিঘাত মহামারীর পরও অব্যাহত থাকবে। ২০২১ সালেও আমাদের করোনার অভিঘাত মোকাবিলা করতে হবে। সেটা কর আদায়ের ক্ষেত্রে হোক, ব্যক্তি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে হোক আর রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেই হোক, সব খাতেই অভিঘাত পরিলক্ষিত হবে।
জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নতুন বছরের অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ বিষয়ে তিনি মোটা দাগে কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো- কর্মসংস্থান বাড়িয়ে বেকারত্ব কমানো ও প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। বলেন, করোনার কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধির হার অনেক কমে গেছে। তবে অনেক দেশের প্রবৃদ্ধি আমাদের চেয়ে কমে গেছে। আমরা তাদের চেয়ে ভালো থাকলেও জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমাদের অনেক কমে গেছে। সেটি পুনরুদ্ধার করতে হবে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি যেখানে প্রাক্কলন করা ছিল ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ, সেখানে গত অর্থবছর শেষে অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। একইভাবে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২০ শতাংশ নির্ধারিত রয়েছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে কো-অর্ডিন্যান্স কাউন্সিলের বৈঠকে অর্থসচিবের পক্ষ থেকে জানানো হয়, চলতি অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হতে পারে বড়জোর ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর আগামী অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবি বলেছে, এবার প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে নেমে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, করোনায় বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। ক্ষুদ্র, মাঝারি খাতের অনেক উদ্যোক্তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন বছরের প্রথম কাজ হবে ছোট ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন এবং চাকরিচ্যুতদের মধ্যে যারা সক্ষম তাদের কাজের ব্যবস্থা করা। ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ লাখ প্রবাসী ফেরত এসেছেন। এরা বিদেশে ফিরতে পারছেন না। দেশেও তাদের কাজের ব্যবস্থা নেই। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কূটনীতি জোরদার করে, তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। এ জন্য আমাদের ফরেন সার্ভিসকে ঢেলে সাজাতে হবে। পাশাপাশি কর্মীদেরও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বাড়াতে হবে। কেউ কেউ করোনার দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ঢেউয়ের কথা বলছেন। এটি হলে অর্থনীতি সামাল দেওয়া যাবে না।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে করোনা সংক্রান্ত যেসব তথ্য আছে, তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা প্রতিবেদন। এর অনেক কিছুই বাংলাদেশের সঙ্গে মিল নেই। ফলে বাংলাদেশের আথর্-সামাজিক অবস্থার আলোকে গবেষণা জরুরি। যারা মারা গেছেন, তাদের অধিকাংশই ধনী লোক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধিনিষেধ মেনে চলেছেন। যেসব নিম্ন আয়ের মানুষ ওই নির্দেশনা মানেননি, তারা কিন্তু মারা যাননি।
বিশ্বব্যাংকের ‘লুজিং লাইভলিহুড : দ্য লেবার মার্কেট ইমপ্যাক্টস অব কোভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনায় ঢাকায় ৬৬ শতাংশ এবং গ্রামে ৪১ শতাংশ চাকরিজীবী কাজ হারিয়েছে। বস্তিবাসীর মধ্যে চাকরি হারিয়েছে ৭১ শতাংশ। আর অন্য এলাকায় হারিয়েছে ৬১ শতাংশ। করোনায় মানুষের আয়-ব্যয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা জানতে গত সেপ্টেম্বরে একটি জরিপ করে বিবিএস। দেখা গেছে, করোনায় আয় কমেছে ২০ শতাংশ। করোনার আগে গত মার্চে প্রতি পরিবারে মাসিক গড় আয় ছিল ১৯ হাজার ৪২৫ টাকা। আগস্টে তা কমে দাঁড়ায় ১৫ হাজার ৪৯২ টাকা। পাঁচ মাসের ব্যবধানে পরিবারপ্রতি আয় কমেছে প্রায় ৪ হাজার টাকা।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি ও বিআইজিডির গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনার প্রথমদিকে ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে দীর্ঘ মেয়াদে ছুটি ও লকডাউনের প্রভাবে গত এপ্রিল মাসে গরিব মানুষের আয় কমেছে ৭৫ শতাংশ। আর গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের আয় কমেছে ৬৫ শতাংশ। অর্থনীতিতে গতি ফিরিয়ে আনতে সরকার বাস্তবায়ন করছে সোয়া লাখ কোটি টাকার ২১টি প্রণোদনা প্যাকেজ। এতে বড় ব্যবসায়ীরা সুবিধা পেলেও ছোটরা বঞ্চিত হচ্ছে।
অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার গত ৩ ডিসেম্বর বলেছেন, যেমনটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্পে (সিএমএসএমই) তেমন ঋণ বিতরণ হয়নি। এমনকি, ক্ষুদ্রঋণের ঝুঁকির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংক নেওয়ার পরও এ খাতে বিতরণ বাড়েনি, এটা খুবই দুঃখজনক। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো সহযোগিতা করছে না বলেও তিনি অভিযোগ করেন। এর বাইরে ছোট উদ্যোক্তাদের অন্য পাঁচটি প্যাকেজের ঋণ বিতরণের চিত্রও হতাশাজনক। কোনো কোনো প্যাকেজের একশ-দেড়শ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র। তবু আশাবাদী অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল। গত বুধবার বলেছেন, নতুন বছরেও অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকবে।
করোনায় বেকারত্ব ২৪ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ নেতিবাচক হয়ে যায়। শহরে কাজের সুযোগ কমে যায়। বেকার মানুষ গ্রামে ফিরে যেতে শুরু করে। গ্রামে ফেরার এমন বিপরীতমুখী প্রবণতা আগে কখনো দেখা যায়নি। গৃহকর্মীরা কাজ হারিয়েছে। ঘরভাড়া ও খাবারের খরচ মেটাতে না পেরে গ্রামে ফিরে গেছে। অনেক নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত গ্রামে ফিরে গেছে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ