ঢাকা : রেলের উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও কমছে না দুর্ঘটনার সংখ্যা। একইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লেভেলক্রসিংয়ে মৃত্যুহার। যেন মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে লেভেলক্রসিং।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত পাঁচ বছরে লেভেলক্রসিংয়ে কাটা পড়ে মারা গেছে ১২০ জন। যদিও বেসরকারি হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি।
লেভেলক্রসিংয়ে এমন মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা অবৈধ লেভেল ক্রসিংকেই প্রধানত দায়ী করে থাকেন। কিন্তু বৈধ ও প্রহরী নিযুক্ত লেভেলক্রসিংয়েও দুর্ঘটনা কম নয়। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা অনেক।
অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের বেশকিছু আছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার তৈরি। গত ১৯ ডিসেম্বর জয়পুরহাট সদরের পুরানপৈল রেলগেটটিও তেমনি একটি। বাধাহীন রেলক্রসিংয়ের ওপর উঠে পড়া একটি বাসে ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ হারান বাসের ১২ যাত্রী। আহত হয়েছেন আরো তিনজন।
এই দুর্ঘটনার সময় রেলক্রসিংয়ের গেট খোলা ছিল, গেটম্যান ঘুমিয়েছিলেন বলে জানায় পুলিশ। পরিসংখ্যান বলছে, বৈধ-অবৈধ সব রেলক্রসিংই অসতর্কতা আর দায়িত্বহীনতার কারণে মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনের পর দিন ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
সাধারণত অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান থাকে না। নেই কোনো সতর্কতার ব্যবস্থাও। ফলে হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটে। আবার অনেক বৈধ লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যান থাকে না। সেখানে পথচারী ও চালকদের সতর্ক করে সাইনবোর্ড বসানো থাকে।
সুবিধামতো এমন অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা এড়াতে কোথাও কোথাও রেলের গতি কমিয়ে দিতে হয়। এতে রেলযাত্রায় বাড়ে সময়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের কারণে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, কিন্তু এ ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি সচেতন নয়। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। সবার আগে জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ করতে হবে। আর বৈধ ক্রসিংয়ে সার্বক্ষণিক তদারক করতে হবে।
তবে রেল কর্তৃপক্ষ পুরোপুরি সচেতন নয়, এমন অভিযোগ মানতে নারাজ বাংলাদেশ রেলের পরিচালক (ট্রাফিক) শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে এসব দুর্ঘটনা রোধ করা যায়।’
জানা গেছে, দেশে রেলের মোট লেভেলক্রসিং ২ হাজার ৬১২টি। এর মধ্যে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত লেভেলক্রসিং ১ হাজার ৪১২টি। বাকি ১ হাজার ২০০টি অবৈধ।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে রেলপথ ছিল ২ হাজার ৮৫৮ কিলোমিটার। গত বছরে রেলপথ বেড়েছে ২০০ কিলোমিটার। বর্তমানে মোট রেলপথ ৩ হাজার ১৮ কিলোমিটার। অনেক জায়গায় ঘন ঘন লেভেলক্রসিং রয়েছে। এমন ক্রসিংয়ের কারণে সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও দুর্ঘটনা এড়াতে দ্রুতগতিতে চলতে পারে না ট্রেন। ফলে সময় বেশি লাগায় কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। আবার বৈধ ক্রসিংয়ের মধ্যে বড় অংশ চলে গেটম্যান ছাড়া।
এ ছাড়া এসব ক্রসিংয়ের অনেকগুলো অবৈধ হওয়ায় দেখভালের কেউ থাকে না। আবার স্থানীয় অযৌক্তিক চাহিদাতেও গড়ে উঠেছে লেভেলক্রসিং। ফলে দুর্ঘটনায়ও বেড়েছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি ছাড়াই অবৈধ লেভেলক্রসিং তৈরি হয় বলে অভিযোগ আছে।
বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও স্থানীয়রা নিজেদের প্রয়োজনে ইচ্ছেমতো রেললাইনের ওপর দিয়ে যাওয়া রাস্তায় গড়ে তুলেছে। এসব অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ে কোনো গেটম্যান কিংবা সতর্কবার্তা থাকে না। ফলে ট্রেন আসার সময়ই অবাধে রেলক্রসিং পারাপার করে পথচারী ও যানবাহন।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, গত পাঁচ বছরে লেভেলক্রসিংয়ে কাটা পড়ে মারা গেছে ১২০ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরো বেশি।
বছরওয়ারি হিসাবে ২০১৪ সালে লেভেলক্রসিংয়ে কাটা পড়ে মারা গেছে ৫৪ জন। ২০১৫ সালে মারা গেছে ১৩ জন। ২০১৬ সালে ১৩ জন। ২০১৮ সালে মারা গেছে ১৭ জন। আর ২০১৯ সালে মারা গেছে ২০ জন।
চলতি বছর এ ধরনের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সবশেষ গতকাল জয়পুরহাটে লেভেলক্রসিংয়ে কাটা পড়ে মারা যায় ১২ জন।
বেশিরভাগ সময়ই এ ধরনের দুর্ঘটনার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ অবৈধ লেভেলক্রসিংকেই দায়ী করে থাকে। কিন্তু অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব লেভেলক্রসিংয়ের বিরুদ্ধে কখনোই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি রেল কর্তৃপক্ষ।
রেলের একটি তথ্য থেকে জানা যায়, সারাদেশে অবৈধ লেভেলক্রসিং সবচেয়ে বেশি বানিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। তাদের লেভেলক্রসিংয়ের সংখ্যা ৫১৬টি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) অবৈধ লেভেলক্রসিং ১১টি। ইউনিয়ন পরিষদের অবৈধ লেভেলক্রসিং সংখ্যা ৩৬৩টি। পৌরসভা অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে ৮০টি। সিটি কর্পোরেশনের অবৈধ লেভেল ক্রসিং সংখ্যা ৩৪টি। জেলা পরিষদ অবৈধ লেভেলক্রসিং বানিয়েছে ১৩টি। চট্টগ্রাম বন্দর অবৈধ লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে ৩টি। বেনাপোল বন্দরেরও ১টি অবৈধ ক্রসিং রয়েছে।
গত ১৯ ডিসেম্বর দুর্ঘটনায় ১২ জনের প্রাণ গেছে যেখানে, সেখানে জয়পুরহাটের চিনিকল কর্তৃপক্ষের তিনটি অবৈধ লেভেলক্রসিং রয়েছে বলে জানা গেছে।
একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটলেও এসব নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কিন্তু তা খুব একটা আলোর মুখ দেখে না। গত বছরের ১৫ জুলাই সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী আন্তঃনগর পদ্মা ট্রেনের সঙ্গে ১০ জনের মৃত্যু হয়।
ওই দুর্ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয় ‘অরক্ষিত রেলওয়ের লেভেলক্রসিংয়ের কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে। লেভেলক্রসিংয়ে কোনো ব্যারিয়ার ছিল না। এমনকি সেখানে রেলক্রসিংয়ে কোনো পাহারাদারও ছিল না।’ এমন অনেক প্রতিবেদনে অবৈধ লেভেল ক্রসিংকে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করা হলেও পরে তা আগের অবস্থায় রয়ে যায়।
রেল দুর্ঘটনার বিষয়ে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ‘রেলক্রসিংয়ে দিনে দিনে যে মানুষ মারা যাচ্ছে, সেদিকে কারো খুব একটা নজর নেই বলেই মনে হয়। এখান থেকে সরে আসতে হবে। রেলে জনবল বাড়াতে হবে। অবৈধ ক্রসিং কমিয়ে আনতে হবে।
পথের গুরুত্ব অনুযায়ী যেসব রেলক্রসিং বৈধতা দেওয়া দরকার, প্রয়োজনে তা দিয়ে সেখানে প্রহরী নিয়োগ দিতে হবে।’ তাহলে দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই