ঢাকা : করোনা সংক্রমণের হার কয়েক দিন ধরে বেড়েই চলেছে। রোগীর সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।
গত ২১ ফেব্রুয়ারি ২৪ ঘণ্টায় করোনা সংক্রমণ ৩২৭ জনে নেমে এসেছিল; কিন্তু হঠাৎ করেই এর পর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সেইসঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়ছে। সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতির ফের বিপর্যয় হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় বাধ্য করতে সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ নেওয়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তারা।
গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে আরো ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে আট হাজার ৫২৭ জনের। নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ১৪ জন। সব মিলিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার ২৩৬ জন। গতকাল শনিবার বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা এ তথ্য জানান।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা। কিছুদিন সংক্রমণ কম হওয়ায় মানুষের মধ্যে ধারণা তৈরি হয়েছে, করোনা আর বাড়বে না বা করোনা নেই। এ কারণে মানুষের মধ্যে মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া করোনার টিকা নেওয়া অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়টি সর্বত্রই উপেক্ষিত।
জনসমাগম, বিভিন্ন ধরনের জমায়েত, সভা-সমাবেশে, সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বেড়েছে। মানুষ এসব অনুষ্ঠানে উন্মুক্তভাবে ঘোরাফেরা করছে। ভিড় বাড়ছে পর্যটন এলাকায়। এসব কারণে করোনা সংক্রমণ ফের দ্রুত বাড়ছে।
তাদের মতে, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। সংক্রমণ কমাতে হলে মানুষকে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে মানুষকে বাধ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
কারণ নতুন করে যে হারে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে তার রাশ টানতে হলে এই মুহূর্তেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেল্থ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, পর পর কয়েক সপ্তাহ সংক্রমণ কম থাকায় মানুষ ভেবে নিয়েছিল যে করোনা নেই। টিকা নেওয়ার পর মানুষ ভেবেছে স্বাস্থ্যবিধি না মানলেও চলবে। এসব কারণে মানুষ ব্যাপক অসচেতন হয়ে পড়েছে। মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রয়োজন মনে করছে না। ব্রিটেনে নতুন ধরনের করোনা ভাইরাসের যে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে আমাদের দেশেও সেটা পাওয়া গেছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের ভেরিয়েন্ট ধরা পড়েছে। আমাদের জিনোম সিকোয়েন্সিং করে দেখতে হবে এই ধরনগুলো ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে কি না। এখনই মানুষকে মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, উদ্বুদ্ধ না হলে বাধ্য করতে হবে। প্রয়োজনে এখনই সরকারকে এ জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোস্তাক আহমেদ বলেন, করোনা সংক্রমণ নতুন করে বাড়ছে এবং এটা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষ মাস্ক পরছে না, স্বাস্থ্যবিধি একেবারেই মানছে না। সামাজিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না। যারা টিকা নিচ্ছেন তারা টিকা নেওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। মাস্ক পরা অনেকেই কথা বলার সময় তা খুলে ফেলছেন।
বদ্ধ রুমে ফ্যান, এসি চালিয়ে সভা হচ্ছে, স্লোগান দিচ্ছে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ, কার মধ্যে করোনাভাইরাস আছে সেটার লক্ষণ না থাকলে তো বোঝা যায় না।
বলা হয় গরিব মানুষের করোনা হয় না। এটা ঠিক নয়। বরং তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। যারা মাস্ক কিনতে পারছে না তাদের মাস্ক দেওয়াসহ সমাজিক সহযোগিতা দিতে হবে। মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে তার ব্যবস্থা করতে হবে।
যারা আক্রান্ত হচ্ছেন তারা চিকিৎসা পাচ্ছেন কি না, আইসোলেসনে যাচ্ছেন কি না বা যারা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে যাচ্ছেন তারা আইসোলেশনে থাকছেন কি না- এ বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে। পর্যটন এলাকায় মানুষের ভিড় বাড়ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ২৪ ঘণ্টায় মৃত ১২ জনের মধ্যে নয়জন পুরুষ, তিনজন নারী। তাদের মধ্যে সবাই ঢাকা বিভাগের। ১২ জনই হাসপাতালে মারা গেছেন। মৃতদের বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ১১ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে একজন রয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় আইসোলেশনে এসেছেন ৮৩ জন ও আইসোলেশন থেকে ছাড় পেয়েছেন ২৭ জন। এ পর্যন্ত আইসোলেশনে এসেছেন এক লাখ এক হাজার ৩৪১ জন। আইসোলেশন থেকে ছাড়পত্র নিয়েছেন ৯১ হাজার ৬৯৩ জন। বর্তমানে আইসোলেশনে আছেন নয় হাজার ৬৪৮ জন।
ঢাকা সিটিসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল ও বাড়িতে উপসর্গবিহীন রোগীসহ গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন এক হাজার ১৩৮ জন। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছেন পাঁচ লাখ ১০ হাজার ৩১০ জন। সারাদেশে সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২১৯টি ল্যাবে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা হয়েছে।
এর মধ্যে আরটি-পিসিআর ল্যাব ১১৮টি, জিন-এক্সপার্ট ২৯টি, র্যাপিড অ্যান্টিজেন ৭২টি। এসব ল্যাবে ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ হয়েছে ১৬ হাজার ৭৯টি। মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১৬ হাজার ২০৬টি। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৪২ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪৫টি।
এতে আরো জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ছয় দশমিক ২৬ শতাংশ। এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ০৯ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯১ দশমিক ৭৪ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৫৩ শতাংশ।
মাস্ক পরা নিশ্চিতে সরকারের নতুন নির্দেশনা : সম্প্রতি মহামারি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে দেশব্যাপী নতুন করে নির্দেশনা জারি করেছে মন্ত্রীপরিষদ বিভাগ।
শনিবার (১৩ মার্চ) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) কাছে এ বিষয়ে চিঠি পাঠিয়েছে সরকার।
চিঠিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি করোনা সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর হার গত কয়েক মাসের তুলনায় কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। সংক্রমণের হার রোধের জন্য সর্বক্ষেত্রে সকলের মাস্ক পরিধানসহ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় সবার মাস্ক পরিধান নিশ্চিত করাসহ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের বিষয়টি মনিটরিং করার জন্য বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি ও ইউএনওদের অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।
এর আগে শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ২১৯টি ল্যাবে ১৬ হাজার ২০৬টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ১৪ জনের। এ সময়ে মারা গেছেন ১২ জন। তাদের মধ্যে নয়জন পুরুষ ও তিনজন নারী।
বিভাগভিত্তিক হিসাব অনুযায়ী, মৃত ১২ জনের সবাই ঢাকা বিভাগের। নতুন করে ১২ জনের মৃত্যুতে এ নিয়ে দেশে এই মহামারিতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৮ হাজার ৫২৭ জনে। মোট শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার ২৩৬ জনে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্তে নমুনা পরীক্ষা, নতুন রোগী শনাক্ত, মৃত্যু এবং সুস্থতা সবই বেড়েছে। এপিডেমিওলজিক্যাল নবম সপ্তাহের (২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ) সঙ্গে এপিডেমিওলজিক্যাল দশম সপ্তাহের (৭ মার্চ থেকে ১৩ মার্চ) তুলনামূলক বিশ্লেষণে এ চিত্র দেখা গেছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত সপ্তাহের তুলনায় চলতি সপ্তাহে ১৪ দশমিক ৫২ শতাংশ নমুনা পরীক্ষা, ৬৭ দশমিক ২৭ শতাংশ নতুন রোগী শনাক্ত, ৪২ দশমিক ৪১ শতাংশ সুস্থতা এবং ৪৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ মৃত্যু বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (৯ মার্চ) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে ক্রমবর্ধমান করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, আমরা যে যেখানে থাকি, ভ্যাকসিন নিই বা না নিই আমরা যেন অবশ্যই মাস্ক ব্যবহার করি, সতর্কতা অবলম্বন করি আর যেখানে পাবলিক গ্যাদারিং হচ্ছে সেখানে যারা যাবেন তারা যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন।
সোনালীনিউজ/এমটিআই