ঢাকা : চলতি জাতীয় সংসদে বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদের তৃতীয় বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। বিশ্লেষকরা বলছেন, অন্যবারের তুলনায় এবারের বাজেট সরকারের জন্য কিছুটা ভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। অন্য বছরে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে প্রাধান্য দিয়ে বেশিরভাগ বাজেট প্রণয়ন করেছে সরকার। কিন্তু করোনা মহামারী আগের সেই হিসাবনিকাশ অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং অক্সফাম পরিচালিত এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের মহামারীর আগে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকলেও গেল বছর মার্চ-এপ্রিলের লকডাউনের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ৬১ ভাগের বেশি মানুষ তাদের কাজ হারিয়েছেন।
সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এদের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ এক মাসের মধ্যে তাদের কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে পেরেছেন। আর ৮৫ ভাগই দীর্ঘ সময় ধরে কর্মহীন রয়েছেন। এ অবস্থায় বেকারত্ব বরণ করে অনেকের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।
অর্থনীতিবিদরা তাই বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির দিকে না তাকিয়ে মানুষের খাদ্য ও কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। কারণ গত বছর করোনা মহামারী শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ নতুন করে দারিদ্র্যে নিপতিত এবং কর্মহীন হয়ে পড়েছে। তাই এসব মানুষের খাদ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিই হবে সরকারের এবারের বাজেটের মূল লক্ষ্য ও চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের চার কোটি মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে। অনেকের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের আয়ের একটি বড় অংশ করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব মানুষের রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারকে পরামর্শ দেন তারা। যারা একেবারেই দরিদ্র তাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয়-রোজগার বাড়ানোর পাশাপাশি দারিদ্র্য যাতে আর না বাড়ে সেই প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে।
সবার মতামতকে বিচার বিশ্লেষণ করে সরকারও এবার সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এবার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আকার আরো বাড়ছে। এ খাতে বরাদ্দ রাখা হতে পারে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া মহামারী কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল রাখা হবে, যা ২০২১-২২ অর্থবছরের বরাদ্দের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এরই মধ্যে জানিয়েছেন, ‘মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য বাজেটে জায়গা করে দেব। সরকারের আগামী বাজেট দরিদ্রদের জন্য নিবেদিত থাকবে।’
অন্যদিকে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় চিকিৎসাসামগ্রী এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি টিকাকার্যক্রম শক্তিশালীকরণেরও পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা। কারণ সবার টিকা নিশ্চিত করা গেলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সার্বিক জীবনযাত্রায় গতি সঞ্চারের পাশাপাশি কর্মসংস্থানও ত্বরান্বিত হবে।
এজন্য বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ৩২ হাজার ৭৩১ কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে সরকারের অর্থ বিভাগ। চলতি অর্থবছরে (২০২০-২০২১) বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকার বরাদ্দ রয়েছে। সে হিসাবে আসন্ন বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ছে ৩ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এর বাইরে টিকা কেনার জন্য আরো অতিরিক্ত ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হবে।
তবে বাজেট নির্ধারণ কিংবা বিপুল বরাদ্দই মূল কথা নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বাজেটের সফল বাস্তবায়নের ওপরই নির্ভর করবে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি। সরকারের অর্থ সহায়তা সাধারণ মানুষের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অনেকে। কারণ গতবছর দারিদ্র্য মানুষের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ আড়াই হাজার করে টাকা প্রদানের সময় ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। সহায়তার তালিকায় ৩ হাজারের মতো সরকারি কর্মচারী, সাত হাজারের মতো পেনশনভোগী এবং প্রায় সাড়ে পাঁচশোরও বেশি মানুষের নাম ছিল যাদের সঞ্চয়পত্র কেনা আছে পাঁচ লাখ টাকারও বেশি। এ ছাড়া এক লাখেরও বেশি মানুষ ছিলেন যারা অন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি থেকে ইতোমধ্যে সুবিধা পেয়েছেন এবং প্রায় তিন লাখ ব্যক্তির নাম ছিল যাদের একাধিকবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর বাইরে আরো ২২ লাখ ৮৬ হাজার ৫২৮ জনের তথ্য নানা ধরনের অসঙ্গতি ছিল। এ নিয়ে সরকারকে বেশ বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়।
এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের কোন প্রক্রিয়ায় অর্থসহায়তা প্রদান করা হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট কাঠামো ঠিক করা হয়নি। শহরের মুদি দোকানি, পরিবহন শ্রমিক, হোটেল ও দোকান কর্মচারী এবং হকারসহ নিম্নআয়ের মানুষ ও বস্তিবাসী করোনাকালীন কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন না। তাদের সহায়তা প্রদানের চিন্তা করছে সরকার। কিন্তু কীভাবে কোনো প্রক্রিয়ায় সহায়তা পৌঁছানো হবে তা এখনো অনির্ধারিত। কারণ এসব মানুষের সংখ্যা কত কিংবা কতটা খারাপ অবস্থায় তারা আছে তার কোনো জরিপ কিংবা ডেটাবেইজ নেই।
সাবেক সিনিয়র অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদের মতে, গ্রামের গরিব মানুষ নানা ধরনের সহায়তা পাচ্ছে। কিন্তু ডেটাবেজ না থাকায় শহরের মুদি দোকানি, পরিবহন শ্রমিক, হকারসহ নিম্নআয়ের মানুষ ও বস্তিবাসী করোনাকালীন কোনো ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন না। তাই ডেটাবেজ তৈরি করে শহুরে গরিব মানুষের জন্য নতুন বাজেটে বিশেষ কর্মসূচি চালু করতে হবে। কারণ পরিবহন শ্রমিক, মুদি দোকানদার, হকার, হোটেল ও দোকান কর্মচারী-এসব মানুষ দিন দিন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু তাদের কোনো ডেটাবেজ না থাকায় সহায়তা দেওয়া যাচ্ছে না।
যদিও সরকারের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ নিয়ে কোনো সমস্যায় পড়তে হবে না। এজন্য ২০১৫ সালে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলই যথেষ্ট। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব ড. শামসুল আলম বলেন, ‘নতুন করে আলাদা কৌশলপত্রের প্রয়োজন হবে না। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল-২০১৫ অনুযায়ী করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কারণ ১৫ সালের কৌশলপত্রে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া আছে।’
সোনালীনিউজ/এমএএইচ