ঢাকা : কোভিড মহামারির মধ্যে এক বছর কেটে গেলেও জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলো কোভিড চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি। জেলার হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত শয্যার ব্যবস্থা করার কথা বলা হলেও আইসিইউ সুবিধা খুবই অপ্রতুল।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে ৩৭টিতেই কোভিড চিকিৎসার জন্য আইসিইউ নেই।
এর মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৫টি, চট্টগ্রামের ৮টি, রংপুরের ৬টি, সিলেটের ২টি, বরিশালের ৪টি, খুলনার ৪টি, রাজশাহীর ৬টি ও ময়মনসিংহের ২টি জেলা রয়েছে। সারা দেশে মোট আইসিইউ শয্যা সংখ্যা ২৪২০টি। এর মধ্যে ১২১৮টি ঢাকা মহানগরে এবং ৫৯টি চট্টগ্রাম মহানগরে। বাকি ১১৪৩টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে ২৫টি জেলায়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বাদে বিভিন্ন জেলায় ‘হাই ফ্লো নেইজল ক্যানুলা’ সংবলিত আইসিইউ সমতুল্য শয্যা আছে ১৬০৩টি। ১১টি জেলায় সেরকম শয্যাও নেই।
এদিকে দেশের সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার উদ্বেগের থাকার কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। রাজশাহী বিভাগে আইসিইউ বেড রয়েছে ৪৬টি। এর মধ্যে ২০টি আইসিইউ বেড রয়েছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। গত বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত সবকটিতে রোগী ছিলেন। তাদের মধ্যে ১২ জনের করোনাভাইরাস পজিটিভ, বাকিদের উপসর্গ রয়েছে।
এ হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী জানান, আইসিইউ বেড পেতে তখন আরো ৭০ জন রোগী অপেক্ষায় ছিলেন।
তিনি বলেন, আইসিইউতে থাকা রোগীদের কারো একটু উন্নতি হলেই তাকে বের করে সাধারণ ওয়ার্ডে দেওয়া হচ্ছে। আবার কেউ মারা গেলে বেড খালি হচ্ছে। তারপর ক্রমিক অনুযায়ী ফোন করে আইসিইউতে রোগী ডাকা হচ্ছে।
প্রতিদিন ৭ থেকে ১০ জন পর্যন্ত রোগীকে আইসিইউতে নেওয়া হয় জানিয়ে তিনি বলেন, সেই হিসেবে ক্রমিকের ৭০ নম্বর রোগীকে আইসিইউ পেতে অপেক্ষা করতে হবে এক সপ্তাহের বেশি। এ হাসপাতালে প্রথমে ১০টি কোভিড ‘ডেডিকেটেড’ আইসিইউ বেড ছিল। তা যথেষ্ট না হওয়ায় বাড়াতে বাড়াতে ২০টি বেড করা হয়েছে।
রাজশাহী ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর এবং চুয়াডাঙ্গার রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন বিভাগের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালে। কোভিড পরিস্থিতির কারণে গত মাস থেকেই রোগীর ভিড় বেড়েছে।
রাজশাহী মেডিকেল ছাড়া এ বিভাগের মধ্যে বগুড়ার মোহাম্মাদ আলী হাসপাতালে আটটি, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আটটি, বগুড়া টিএমএসএসে দশটি মিলিয়ে মোট ৪৬টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে।
রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে আইসিইউ বেড আছে ২৫টি। এর মধ্যে রংপুরের কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১০টি ও দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে ১৫টি।
সরকারি হিসাব বলছে, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত ওই ২৫টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে চারটি খালি ছিল। তবে স্থানীয় চিকিৎসকেরা বলছেন, কোথাও কোনো আইসিইউ বেড খালি নেই। অনেক রোগীর স্বজনেরা বেডের জন্য অপেক্ষা করছেন। একটা বেড পেতে চলছে নানা স্তর থেকে তদবির।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রংপুর বিভাগীয় উপপরিচালক জাকিরুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত কোভিড রোগীদের যে চাপ আছে, তাতে সাধারণ বিছানার সংকট নেই। আরো যদি চাপ বেড়ে যায়, তবে বিছানা বা ইউনিট বাড়ানো হবে, সেই প্রস্তুতি চলছে। অক্সিজেনেরও কোনো সংকট এখন পর্যন্ত বোধ হচ্ছে না।
করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. আওলিয়ার রহমান জানান, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জন্য আইসিইউ বেডের অনুমোদন হয়নি।
প্রথমে আটটি বেড চাওয়া হয়েছিল। পরে তা কমিয়ে চারটি চাওয়া হয়েছে। কিন্তু কবে পাওয়া যাবে তা বলা যাচ্ছে না। আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন এমন রোগীদের রাজশাহী কিংবা ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকার দূরত্ব ২৪০ কিলোমিটার, রাজশাহী ১৬৫ কিলোমিটার ও খুলনা ১২৮ কিলোমিটার। এতো দূরের পথ যাত্রা করার মতো অবস্থা অনেক রোগীরই থাকে না। তা ছাড়া কোভিড রোগী পরিবহনে অক্সিজেন সুবিধাসহ অ্যাম্বুলেন্স লাগে, তাতে খরচও বেশি পড়ে।
জীবননগর উপজেলার উথলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ কোভিড আক্রান্ত হয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি জানান, তাকে অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে হয়েছিল। আইসিইউ বেড যে কত জরুরি তখন তিনি টের পেয়েছেন।
ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালেও আইসিইউ নেই বলে জানান সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম। তিনি বলেন, আইসিইউ স্থাপনের জন্য প্রস্তাব ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। এখনো পাস হয়নি। করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর আইসিইউর প্রয়োজন হলে ৫০ কিলোমটির দূরে যশোর বা ১০০ কিলোমিটার দূরে ফরিদপুর নিয়ে যেতে হয়।
মহামারি শুরুর পর জনবল ছাড়াই ঘটা করে ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ প্রকল্প অনুমোদন করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগ। অবকাঠামো থাকলেও পর্যাপ্ত যন্ত্রপতি ও জনবলের অভাবে বছর ঘুরলেও পুরোপুরি চালু করা যায়নি আইসিইউ ইউনিট। রোগীর চাপে মে মাস থেকে ১০ বেডের আইসিইউ ইউনিট চালু হলেও মাত্র দুটি বেডে রোগীদের সেবা দেওয়া যাচ্ছে।
ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রিপন নাথ বলেন, জেনারেল হাসপাতালে ১০ বেডের আইসিইউ ইউনিট রয়েছে, যার মধ্যে দুটি বেডে ভেন্টিলেটর সাপোর্ট রয়েছে। তবে জনবল স্বল্পতায় হাসপাতাল থেকে পুরোপুরি আইসিইউ সেবা নিতে পারছে না রোগীরা।
তিনি বলেন, আইসিইউ ইউনিট চালাতে ২ জন কনসালট্যান্ট চিকিৎসক, ১০ জন মেডিকেল অফিসার ও ২০ জন প্রশিক্ষিত নার্স প্রয়োজন। কিন্তু এখানে দুইজন চিকিৎসক, ৭/৮ জন নার্স দিয়ে কোনোমতে চালিয়ে নিতে হচ্ছে। অক্সিজেন লিকুইড ট্যাংক স্থাপন হলে পর্যায়ক্রমে ১০ শয্যার আইসিইউ পুরো ইউনিট চালু করা যাবে বলে তিনি জানান।
গত বছরের ২ জুন একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রত্যেকটা হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন, প্রত্যেকটি হাসপাতালে যেন ভেনটিলেটর স্থাপন, যথেষ্ট পরিমাণ উচ্চমাত্রার পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা যেন আরো বৃদ্ধি করা হয়। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার নির্দেশও প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন।
ওইদিনে একনেক সভায় দুটি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস’ প্রকল্পটির আওতায় কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত ও পরীক্ষার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সক্ষমতা বাড়ানো হবে।
প্রকল্পটির মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের তিন হাজার ৫০০ জন কর্মীকে আধুনিক দক্ষতা এবং জ্ঞানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে পিসিআর মেশিন, পিসিআর ল্যাব, আইসিইউ, পিপিই ও মাস্ক কেনার কাজে এই প্রকল্পের অর্থ ব্যয় করা হবে।
তবে প্রকল্পের সুফল এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। কয়েকটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ তৈরির কাজ শেষ হলেও এখনো শেষ হয়নি। আর কিছু জেলার হাসপাতালে কাজ শুরুই হয়নি।
সাত বছর আগে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন হচ্ছে বলে সংসদে জানিয়েছিলেন। তবে পরে দৃশ্যমাণ কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই