ঢাকা: করোনার ভারতীয় ধরন (ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট) দেশজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্যবিদসহ সংশ্লিষ্টরা। তাই যে কোনো মূল্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিচ্ছেন তারা। এখনই কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আসন্ন কোরবানির ঈদকে ঘিরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এদিকে গতকাল শুরু হয়েছে রাজধানীর আশপাশের সাত জেলায় কঠোর লকডাউন। প্রশাসন ও পুলিশ কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করছে স্ব স্ব জেলার সাধারণ মানুষের চলাচল। ঢাকাকে সুরক্ষা দিতে চেকপোস্ট বসিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে রাজধানীমুখী যানবাহন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আগের সব ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে দ্রুত সংক্রমিত করার ক্ষমতা আছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে প্রাপ্ত করোনার তিনটি ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে ডেল্টায় আক্রান্তের হারই সবচে বেশি। স্বাস্থ্যবিধি না মানার পাশাপাশি ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে দেশে দ্রুত বাড়ছে করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মঙ্গলবারের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনাভাইরাসে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। শনাক্ত হয়েছে ৪ হাজার ৮৪৬ জনের দেহে। দেশে এ পর্যন্ত করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১৩ হাজার ৭০২ জনের। শনাক্ত হয়েছে ৮ লাখ ৬১ হাজার ১৫০ জনের দেহে। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের ৫২৮টি ল্যাবে ২৫ হাজার ২৮টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৯.৩৬ শতাংশ। সার্বিক শনাক্তের হার ১৩.৫০ শতাংশ। বিভাগ অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৭ জনের মৃত্যু হয়েছে খুলনা বিভাগে, রাজশাহী বিভাগ ১৪ জন, ঢাকা বিভাগে ১৪, চট্টগ্রামে ১০, বরিশালে ২, সিলেটে ৩ এবং রংপুরে ৬ জন।
এদিকে, ভারতে করোনা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তীব্র স্রোত বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোকে সংক্রমিত করে এখন ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) সূত্রে জানা যায়, ঢাকায় করোনা আক্রান্ত ৬০ ব্যক্তির নমুনা জিনোম সিকোয়েন্স করে ৬৮ শতাংশই ভারতীয় ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট, ২২ শতাংশ দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট এবং ১২ শতাংশ নাইজেরিয়ার ইটা ভ্যারিয়েন্টের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। দেশে এ তিন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি এবং মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানার প্রবণতায় করোনা সংক্রমণ বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণক্ষমতা আগের সব ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে দ্রুত। ফলে এটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।
জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই সংক্রমণ আরো বাড়বে এবং এটা করোনার প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। তিনি সবাইকে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন এবং সরকার সংশ্লিষ্টদেরও এবিষয়ে কঠোর হতে বলেন। তিনি শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, যদি কোরবানি ঈদ পর্যন্ত সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে হয়তো একটা পর্যায়ে যাবে, নয়তো ঈদের পর আরো বড় বিপর্যয় হবে। আইইডিসিআর জানিয়েছে, দেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সামাজিক সংক্রমণ হয়েছে। যার ফলে প্রথমে সীমান্তবর্তী জেলা এবং পরে সেসব জেলা থেকে সংক্রমণ ছড়িয়েছে পাশের জেলাগুলাতেও। যার কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংক্রমণ ও মৃত্যু গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাড়ছে।
আইইডিসিআর-এর উপদেষ্টা ও মহামারি বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, আগে শনাক্তে হার ছিল ধীরগতির কিন্তু এবারে বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ঢাকাতে এখনো শনাক্তের হার ১০ এর নিচে রয়েছে, কিন্তু যদি সেটা ২০ শতাংশের ওপরে উঠে যায় তাহলে সব বন্ধ করেও তখন লাভ হবে না।
রাজশাহী ব্যুরো প্রধান বিজয় ঘোষ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে করোনায় ১৩ জন মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে রামেক হাসপাতালের করোনা ইউনিট ও আইসিইউতে ৩৯৩ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। আমাদের খুলনা প্রতিনিধি এ কে হিরু জানান, খুলনার পৃথক তিনটি হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মারা গেছেন ১১ জন। খুলনার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, খুলনায় মঙ্গলবার করোনা শনাক্তের হার ছিল ৫০ শতাংশ।
এদিকে সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকার হাসপাতালগুলোতেও রোগীর চাপ উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা বিষয়ক এক নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রাজধানীর সরকারি চারটি বড় হাসপাতালেই আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ফাঁকা নেই। আর ঢাকার বাইরের কোনো কোনো হাসপাতালে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত রোগী ভর্তি রয়েছে।
গত ৬ জুন করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক ভার্চুয়াল বুলেটিনে বলা হয়, করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় চলতি জুন মাস গত মাসের মতো স্বস্তিকর যাবে না। একই মতামত স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদেরও।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মনে করেন, সামনের দিনগুলোতে আরো বিপর্যয় আসছে। তার মতে, সরকার ঘোষিত বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে না। সরকার এসব মানাতে পারবে বলেও মনে হচ্ছে না। সামনের দিনগুলোতে ঝুঁকি বাড়বে। জুলাই-আগস্ট নাগাদও এরকম বাড়তে থাকবে। তারপর হয়তো কমতে থাকবে।
সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং ফটিকছড়ি উপজেলাতেও আজ বুধবার থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে ৭টি জেলায় শুরু হয়েছে কঠোর লকডাউন। লকডাউন ঘোষিত ৭টি জেলাগুলোতে প্রবেশ ও বের হওয়ায় মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঢাকার প্রবেশ মুখগুলোতেও তৎপর ছিল আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে চেকপোস্ট স্থাপন করে পুলিশ। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব সদস্যরাও বিভিন্ন সড়কে টহল দেয়। সকাল থেকে ৭টি জেলার জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানে নামে। এছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাও লকডাউন পরিস্থিতি মনিটরিং করেন। সার্বিক পরিস্থিতি দেখভাল করছেন এসব জেলার প্রশাসকরা।
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি হায়দার হোসেন জানান, গোপালগঞ্জ জেলার সর্বত্র লকডাউন নিশ্চিতে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলা প্রশাসন মাঠে থেকে কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। জেলাসদরসহ সকল উপজেলার সকল দোকানপাট বন্ধ রাখা হয়। মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার জোবায়ের রহমান রাশেদ জানান, লকডাউন নিশ্চিতে সার্বক্ষণিক চেষ্টা করে যাচ্ছি।
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ রোধে রাজধানীর চারপাশের জেলা থেকে আসা কোনো গণপরিবহনকে রাজধানীতে প্রবেশ করতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বাসগুলোকে আমিন বাজার ব্রিজের আগ থেকেই ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। কোনো গাড়ি আমিন বাজার ব্রিজ পার হয়ে গাবতলী সিগন্যাল থেকে ইউটার্ন নিতে বাধ্য করা হয়। কাঁচপুর ও টঙ্গি ব্রিজের কাছেও বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। লকডাউন অমান্য করে আসা অনেক যানবাহনের বিরুদ্ধে মামলাও দেয় ট্রাফিক পুলিশ।
এদিকে ঢাকায় গণপরিবহন প্রবেশে বাধা দেওয়ার পাশপাশি ট্রেন চলাচলেও নেওয়া হয়েছে কঠোর পদক্ষপ। বাতিল করা হয়েছে বেশকিছু ট্রেন ও স্টপেজ। লকডাউনের মধ্যে থাকা কোনো জেলায় ট্রেন না থামার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
লকডাউন ঘোষিত সাত জেলার যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলও বন্ধ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলো এই জেলার অভ্যন্তরীণ কোনো লঞ্চ ঘাটে ভিড়তে পারবে না বলেও জানানো হয়েছে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ