ঢাকা : রাজধানীর মগবাজারের রহস্যজনক ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা কি না তা খতিয়ে দেখছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী।
অবশ্য পুলিশ প্রধান ড. বেনজীর আহমেদ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সাংবাদিকদের জানান, আপাতত মনে হচ্ছে না এটি নাশকতা। তারপরও আমরা খতিয়ে দেখব।
সোমবার (২৮ জুন) সকালে ঘটনাস্থল থেকে সিআইডির ক্রাইম সিন আলামত সংগ্রহ করে। ফায়ার সার্ভিসের একটি দল পরিদর্শন শেষে ভবন ভেঙে ফেলার কথা জানিয়েছে। তবে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের উপ-সচিবের মতে, সাধারণ বিস্ফোরণে এত ক্ষতি হওয়ার কথা নয়।
এরআগে গত রোববার রাত থেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে। পাশাপাশি উৎসুক জনতার ভিড় ছিল গতকাল দিনজুড়েই। এ বিস্ফোরণে হাসপাতালে ২৭ জন গুরুতর অবস্থায়সহ মোট ৬০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আর এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৭ জন। ঘটনার তদন্তে ফায়ার সার্ভিস, সিআইডি, পুলিশ এবং বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সরেজমিনে পরিদর্শনে দেখা যায়, ভবনটির চারপাশে সাধারণ মানুষের ভিড়। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চারিদিকে ঘিরে রেখেছেন। ভেতরে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি দল কাজ করছিলেন। আলামত সংগ্রহ করছিলেন সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটও। ছিলেন কাউন্টার টেরোরিজম, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের কর্মকর্তারা। বিস্ফোরণের ভয়াবহতার চিহ্ন চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর বিপরীতে থাকা আড়ংয়ের শোরুম, মার্কেট, বাসাবাড়ি সবখানেই ক্ষত চিহ্ন দেখা যায়।
বিস্ফোরণের সময় পাশে দোকানে থাকা আবুল কাশেম বলেন, হঠাৎ করেই বিকট আওয়াজে আমি চেয়ার থেকে পড়ে যাই। পাশের ভবন হলেও মনে হচ্ছিল আমরা বার বার কেঁপে উঠছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে কোনোমতে বেঁচে গেছি। দ্রুত দোকান থেকে বেরিয়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে যাই।
তিনি বলেন, যারা রাস্তায় রিকশা বা বাসে ছিল তারাই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইলেকট্রনিক্স পণ্য ভিশন শোরুমের কর্মকর্তা রাসেল বলেন, আমাদের গেটের কাঁচের দরজা ভেঙে সামনে চলে আসে। আর পাশের গ্লাসগুলো ভেঙে যায়। শোরুমে থাকা কিছু পণ্যের ক্ষতি হয়েছে। আর আমাদের লোকজনের কোনো ক্ষতি হয়নি।
ঘটনাস্থলে আইজিপি : ভয়াবহ বিস্ফোরণে পর গতকাল সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।
পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এই বিস্ফোরণ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে না। গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হতে পারে। ভবনের ভেতরে এখনও মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। বোম্ব এক্সপ্লোশন ইউনিট নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিস্ফোরণের কারণ তলিয়ে দেখা হবে বলেও জানান আইজিপি।
আইজিপি বলেন, মারাত্মক বিস্ফোরণে প্রাণহানি হয়েছে। পথযাত্রী, দোকানের কাস্টমার কর্মচারী ও শিশুসহ ৭ জনকে হারিয়েছি। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। এবছর যদি খেয়াল করেন, অনেকগুলো দুর্ঘটনা ঘটেছে। নারায়ণগঞ্জে মসজিদে, শনিরআখড়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস তদন্ত কমিটি করেছে। তবে আমাদের ফায়ার এক্সপ্লোরেশন বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস মিলে পুলিশের পক্ষ থেকে একটা তদন্ত কমিটি করে তদন্ত করব। আমরা এক সঙ্গে কাজ করব। আমরা চাই এধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে।
এটা কোনো নাশকতা কিনা-সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, বড় ধরনের একটা শকড ওয়েভ তৈরি হয়েছিল, এখন পর্যন্ত এই বিস্ফোরণ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বলে মনে হচ্ছে না। গ্যাস জমে বিস্ফোরণ হতে পারে। এখনো ভবনের ভেতরে মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে।
একমুখী ধ্বংসযজ্ঞ, নাশকতা বা বিস্ফোরণ হলে চর্তুমুখী বিস্ফোরণ হতো। আমরা চারদিকে কাচের টুকরো দেখছি। ভেতরে গ্যাসের অস্তিত্ব ফায়ার সার্ভিস তদন্ত করছে। এখন পর্যন্ত শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। এখনো মনে হচ্ছে কোনো নাশকতা নয়।
আরেক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, আমরা আগে তদন্ত করি বিস্ফোরণটা কেন হলো। তারপর দেখবো, পেছনে কোনো কারণ আছে কিনা। আমাদের ও ফায়ার সার্ভিসের বিশেষজ্ঞরা দেখছেন। অনেক বিষয় আছে। সেসব দেখা হচ্ছে।
আলামত সংগ্রহ করেছে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট : বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা কিনা তা তদন্ত করছে পুলিশ। বিস্ফোরণের সম্ভাব্য কারণ অনুসন্ধানে ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ও ক্রাইম সিন ইউনিট।
ক্রাইম সিন ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান জানান, বিস্ফোরণটা মারাত্মক ছিল। প্রাথমিকভাবে নানা কারণ উঠে এলেও বিস্ফোরণের সঠিক কারণ এখনো নিশ্চিত না। বিস্ফোরণের আলামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেগুলো ফরেনসিক পরীক্ষা করে দেখা হবে। আমাদের দল ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এরিয়া কর্ডন করে আলামত সংগ্রহ করছেন।
ঘটনাস্থলে কথা হয় ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য সহকারী পরিচালক (ঢাকা) ছালেহ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি জমে থাকা গ্যাসে ভবনটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়েছিল। কোনো স্পার্ক হয়ে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের তদন্ত দল আলামত সংগ্রহ করছে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও সংগৃহীত আলামত বিশ্লেষণ শেষে এব্যাপারে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
সাধারণ বিস্ফোরণে এত ক্ষয়ক্ষতি হয় না : ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসা বিস্ফোরক পরিদপ্তরের এনার্জি অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস বিভাগের উপসচিব ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ‘শুধু গ্যাস লিকেজ কিংবা সিলিন্ডার বিস্ফোরণের মতো সাধারণ বিস্ফোরণে এতো এক্সপ্লোসন বা ক্ষয়ক্ষতি হয় না। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে এটা ডিফারেন্ট। এর পেছনে আরো কোনো কারণ থাকতে পারে। সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
ইঞ্জিনিয়ার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘আজ আমরা বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। গতকাল সন্ধ্যায় আমাদের তিন পরিদর্শক পরিদর্শন করে গেছেন। আজ আমরা গ্যাস ডিটেক্টরের মাধ্যমে পরীক্ষা করে বিস্ফোরণের ক্ষতিগ্রস্ত ভবনে ঘটনাস্থলে হাইড্রোকার্বনের অস্তিত্ব পেয়েছি। যা ন্যাচারাল গ্যাস অর্থাৎ সরকারিভাবে পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরবরাহ ও কানেকশন করা হয়ে থাকে। এতো বড় বিস্ফোরণের কারণ কী, সেটা নিয়ে আমরাও দুশ্চিন্তায় আছি।’
‘বিস্ফোরক পরিদপ্তর থেকে আমরা তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আগামী সাত কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বলেছি।’
এক প্রশ্নের জবাবে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিভিন্ন ধরনের গ্যাস জমে এই বিস্ফোরণ হতে পারে বলে ধারণা করছে পরিদপ্তর। অনেকে অনেক ধরনের ধারণা ও মত পোষণ করছেন। আমরা অধিকতর তদন্তসাপেক্ষে সুস্পষ্ট কারণ বলতে পারব।’
লিকেজ বলতে কী অনুমান করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিস্ফোরক এককভাবে এমনি এমনি হয় না। আশপাশে যদি আগুন থাকে, সিগারেট বা কোনো স্পার্ক থেকে হতে পারে। ইলেকট্রিক্যাল এক্সপ্লোরেশন হতে পারে, গ্যাস লাইনে লিকেজ বা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এ ঘটনা ঘটতে পারে। আমাদের আরো তদন্ত করতে হবে।’
ভেঙে ফেলতে হবে সেই ভবন : বিস্ফোরণের ব্যাপকতার কারণে ভবনটি সংস্কারের কোনো সুযোগ নেই। একেবারে ভেঙে ফেলতে হবে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশাসন) এবং বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে তাদের গঠিত ৪ সদস্যের কমিটির প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
জিল্লুর রহমান বলেন, ভবনটি এখন ব্যবহারের অনুপযোগী। তিনতলা ভবনটির একতলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ওপরে দুটি ফ্লোর থাকায় যে কোনো সময় ধসে পড়তে পারে। এলাকাবাসীসহ সবার প্রতি আহ্বান থাকবে, ভবনটিতে কেউ যেন না ঢোকে। ভবনটি আর ব্যবহার করা যাবে না।
দুর্ঘটনাস্থলে গ্যাসের উপস্থিতি কি পরিমাণ পাওয়া গেছে-এমন প্রশ্নের জবাবে জিল্লুর রহমান বলেন, তদন্তের পর ঘটনার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জানা যাবে। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। আজ তদন্তের প্রথম দিন। ঘটনাস্থল থেকে আলামত সংগ্রহ করছি। ভবনের মালিক থেকে শুরু করে ভবনে থাকা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় যে বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ঘটেছিল সেগুলোও গ্যাস বা সমপর্যায়ের জিনিস থেকে হয়েছিল। এখানে যেহেতু বিস্ফোরণের সাথে আলামতের মিল রয়েছে, আমরা সেরকমই কিছুটা অনুমান করছি, কিন্তু এখনই বলা সম্ভব না এখানে কি থেকে এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ভাগে ভাগে আলামত সংগ্রহ করছেন। আলামতগুলো এক করে সবার মতামত নিয়ে পরবর্তী সময়ে প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জানা সম্ভব হবে।
গত রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় মগবাজারের ওয়্যারলেস গেট এলাকায় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্র্যান্ড আড়ংয়ের শোরুম লাগোয়া ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
এছাড়া আহত হয়েছেন ৬০ জনেরও বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে ১৭ জনকে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিদের আশপাশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২০ হাজার টাকা ও আহতদের ১০ হাজার টাকা করে সহায়তা দিয়েছে জেলা প্রশাসন।
সোনালীনিউজ/এমটিআই