ঢাকা : দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুহার এখন শুধু শঙ্কাই নয়, বাড়াচ্ছে আতঙ্কও। সেইসাথে জানান দিচ্ছে, আরো আগ্রাসী হচ্ছে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট (নতুন ধরন)। এরআগে, প্রতিবেশী দেশ ভারতে বিপর্যয় ঘটিয়েছে এই ভ্যারিয়েন্ট। এবার থাবা বসিয়েছে বাংলাদেশে। তাই প্রতিদিনই আসছে ঊর্ধ্বমুখী মৃত্যুহারের দুঃসংবাদ। এরইমধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে এখন ভারতে দেখা দিয়েছে ডেল্টা প্লাস ভ্যারিয়েন্ট। একের পর এক নতুন ধরন আসায় করোনার এই চক্র থেকে বের হওয়া যাবে কি-না তা নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
সম্প্রতি আগামী কয়েক মাস করোনা ভাইরাসের ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট বিশ্বেজুড়ে সংক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এরই মধ্যে প্রায় ১০০টি দেশে ধরনটির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংস্থা। ভারতে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনার অতি সংক্রামক এই ধরনটি ভারতীয় ধরন হিসেবেও পরিচিত।
স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট মূল করোনাভাইরাসের চাইতে দ্বিগুণ সংক্রামক। তাছাড়া, টিকা পাওয়া ব্যক্তিদেরও এটি আক্রান্ত করার শক্তি রাখে, যা জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। ফলে শঙ্কার সঙ্গে আতঙ্কিত হওয়ারও কারণ উঠে আসছে। গত ২৫ মে থেকে ৭ জুন নাগাদ রাজধানী ঢাকায় সংগৃহীত ৭০ শতাংশ নমুনায় পাওয়া গেছে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট। চলতি সপ্তাহজুড়ে (সোমবার থেকে রোববার) ২৫ শতাংশের ঘরে অবস্থান করেছে সংক্রমণ হার। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ভ্যারিয়েন্টের কারণেই এখন বাংলাদেশে সংক্রমণের হার বেড়েছে।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা বিষয়ক নিয়মিত তথ্যে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় (শুক্রবার) করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আরো ১৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা এক দিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এ পর্যন্ত করোনায় দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ১৪ হাজার ৭৭৮ জনের। আর গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে করোনা আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ৮ হাজার ৪৮৩ জন। এ নিয়ে মোট শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৯ লাখ ৩০ হাজার ৪২ জনে।
এর আগে বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) ২৪ ঘণ্টায় ১৪৩ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। আর গত বুধবার ১১৫ জনের জীবনপ্রদীপ নেভায় কোভিড-১৯। তার আগে রোববার ১১৯ জন মারা যান। দেশের ৫০টির বেশি জেলাতে সংক্রমণ পরিস্থিতি নাজুক বলে ইতঃপূর্বে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান হারে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে-তা নিয়েও শঙ্কার অন্ত নেই বিশেষজ্ঞদের।
অন্যদিকে বৈশ্বিক চিত্রও বেদনাদায়ক। ডেল্টা ধরনের বিস্তারই যার জন্য দায়ী। ফলে নতুন করে শক্তিশালী প্রাদুর্ভাবের কবলে পড়েছে বিশ্বের অনেক দেশ। ডব্লিউএইচও-এর সাপ্তাহিক হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়েছে, ২৯ জুন পর্যন্ত বিশ্বের ৯৬টি দেশে ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। তবে নতুন ধরন শনাক্তে সিকোয়েন্সিং ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে হয়তো অনেক দেশে ছড়ালেও তা জানা যায়নি। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার উদীয়মান বাজার অর্থনীতি ইন্দোনেশিয়ার অবস্থাও শোচনীয়। গোরখননকারীরা সেখানে রাত জেগে নতুন কবর খুঁড়ে চলেছেন। ইউরোপের দেশগুলো আবারো উচ্চ সংক্রমণ হার থাকা অঞ্চল থেকে ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসরাইলের মতো রাষ্ট্র এর আগে সংক্রমণ হার বহুলাংশে কমিয়ে আনতে পারলেও, এখন নতুন করে শনাক্ত হচ্ছে গুচ্ছ সংক্রমণ। চীনের কর্মকর্তারা গত সোমবার আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের জন্য ৫ হাজার কক্ষের এক বিশাল কোয়ারেন্টাইন সেন্টার নির্মাণের ঘোষণা দেন। ভাইরাসের হিংস্রতা থেকে এতদিন নিশ্চিন্ত থাকা অস্ট্রেলিয়াও লাখ লাখ মানুষকে ঘরবন্দি থাকার নির্দেশনা দিয়েছে।
ডব্লিউএইচও সতর্ক বার্তা দিয়েছে, ডেল্টা ধরন তার অতি সংক্রামক বৈশিষ্ট্যের কারণে অন্য ধরনগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে এবং আগামী মাসগুলোয় আধিপত্য বিস্তার করবে বিশ্বে। ব্যক্তি ও কমিউনিটি স্তরের জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক পদক্ষেপ, সংক্রমণ রোধ ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে উপায়গুলো আজ বিদ্যমান তা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টসহ করোনার উদ্বেগজনক ধরনগুলোর বিরুদ্ধেও কার্যকর। সংক্রমণ ঠেকাতে টিকাদান কর্মসূচি আরো জোরদার করার তাগিদ দেয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
তাছাড়া, বিশ্বের সব অঞ্চল মহামারি থেকে মুক্তি না পেলে পৃথিবীর কোনো স্থানই ভাইরাসের মারণ থাবা থেকে নিস্তার পাবে না, মহামারি ইতোমধ্যে তা বেশ কয়েকবার প্রমাণ করেছে। নতুন ধরনের বিস্তারও দিচ্ছে সেই একই ইঙ্গিত। এরমধ্যে বাংলাদেশে গত বৃহস্পতিবার থেকে কঠোর লকডাউন চালু হওয়ার আগেই গ্রামের বাড়ি চলে গেছেন শহরের অনেক পোশাক শিল্প শ্রমিক। ফলে গ্রামাঞ্চলে রোগবিস্তারের ঝুঁকি নতুন মাত্রা পেয়েছে বলে খবর প্রকাশ করেছে মার্কিন দৈনিক পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি এক শতাংশেরও কম। করোনার স্বাস্থ্যঝুঁকির তুলনামূলক বিশ্লেষণে গত এপ্রিল থেকে চালানো হয় এ গবেষণা। যাতে তুলে ধরা হয় টিকা না নেওয়া পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার বেশি। তাই বয়স্কদের দ্রুত টিকা দেওয়ার পরামর্শ গবেষকদের। টিকা নেওয়া ও না নেওয়া ব্যক্তিদের করোনার স্বাস্থ্যঝুঁকি তুলনামূলক বিশ্লেষণে গত ২২ এপ্রিল থেকে গবেষণা চালায় চট্টগ্রাম ভেটেরেনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়। এতে দুই মাস ধরে সিভাসু ও চাঁদপুরের দুটি ল্যাবে করোনা শনাক্ত হওয়া এক হাজার ৯৫ জনের নমুনা পর্যালোচনা করে প্রতিষ্ঠানটি।
এতে দেখা যায় আক্রান্তদের মধ্যে ৯৬৮ জন টিকা গ্রহণ করেননি। টিকা প্রথম ডোজ নেন ৬৩ জন এবং দুটি ডোজ পান ৬৪ জন। গবেষণায় উঠে আসে, টিকা নেওয়া ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যঝুঁকি শূন্য দশমিক ৫ ভাগের নিচে। টিকা না নেওয়া ১৩৭ জন ভর্তি হন হাসপাতালে। তাদের ৮৩ জনের মধ্যে শ্বাসকষ্ট এবং ৭৯ জনের অতিরিক্ত অক্সিজেন সার্পোটের প্রয়োজন হয়। তাদের মধ্যে মারা যায় ১০ জন। অন্যদিকে টিকা নেওয়া রোগীদের মধ্যে ১০ জন ভর্তি হন হাসপাতালে। তবে তাদের মধ্যে কোনো জটিলতা দেখা যায়নি।
গবেষণায় বলা হয় বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন এবং টিকা গ্রহণ করেননি এমন ব্যক্তিদের সংক্রমণের হার ৭৭ ভাগ। বিপরীতের টিকা গ্রহণের ফলে এ হার মাত্র ১২ ভাগ। এছাড়া করোনায় মৃত্যু হওয়া সবার বয়স পঞ্চাশের অধিক। তাই বয়স্কের দ্রুত টিকার আওতায় আনার পরামর্শ দেওয়া হয় এ গবেষণায়।
অন্যদিকে করোনায় সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দিতে একের পর পদক্ষেপ নিয়েও পুরোপুরি সফল হচ্ছে না সরকার। লকডাউন ও কঠোর লকডাউন দিয়ে বাড়ানো যাচ্ছেনা জনসচেতনতা। তারমধ্যে করোনার প্রতিষেধক টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে বাংলাদেশ যে অনিশ্চয়তায় পড়েছিল তা কাটতে শুরু করেছে। আগামী দুই দিনের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন থেকে ৪৫ লাখ ডোজ টিকা আসছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে টিকার বৈশ্বিক জোট কোভ্যাক্সের আওতায় মডার্নার ২৫ লাখ এবং চীন থেকে কেনা সিনোফার্মের টিকার ২০ লাখ ডোজ আসবে। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার রাতে ঢাকায় পৌঁছে চীন থেকে আসা সিনোফার্মের ১১ লাখ আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে মর্ডানার ১২ লাখ ডোজ। আজ শনিবার সকালে মর্ডানার আরো ১৩ লাখ আর সিনোফার্মের ৯ লাখ টিকা ঢাকায় পৌঁছানোর কথা। এরপর ধাপে ধাপে আরো কয়েকটি উৎস থেকে টিকা আসার কথা রয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি বছর প্রায় ১০ কোটি ডোজ টিকা পাবে বাংলাদেশ। এসব টিকাকে কেন্দ্র করেই চলবে দেশে টিকাদান কর্মসূচি।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত দেশের করোনা টিকার আওতায় এসেছে ১ কোটি ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮৫৩ জন। এরমধ্যে অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কোভিশিল্ড নিয়েছেন দেশের ১ কোটি ১ লাখ ৯ হাজার ৯২৮ জন মানুষ। চীনের সিনোফার্মের টিকা নিয়েছেন ৬৪ হাজার ১ জন। আর ফাইজার-বায়োএনটেকের টিকা নিয়েছেন ৯২৪ জন।
এদিকে চলতি মাস অর্থাৎ জুলাই থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর করোনা পরীক্ষা বিনামূল্যে করার নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব ড. বিলকিস বেগম এক তথ্য বিবরণীতে জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। পরীক্ষার ফি প্রদান করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একই পরিবারের একাধিক সদস্যের করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। ফলে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় দরিদ্র জনগণের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুধুমাত্র জুলাই/২০২১ মাসের জন্য বিনামূল্যে করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব সরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হলো।
সামগ্রিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট অবশ্যই শঙ্কার। করোনাভাইরাসের এই ধরনটি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ব্যাপক ধ্বংস চালাচ্ছে। আর ভারতে প্রথম শনাক্ত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের মতো ভাইরাসের নতুন ধরনগুলো এশিয়া থেকে আফ্রিকা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। উন্নয়নশীল অনেক দেশ রেকর্ড মাত্রায় দৈনিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঘটনা জানাচ্ছে। ইতোমধ্যেই, ভারতে শনাক্ত হয়েছে ডেল্টা প্লাস নামক আরেকটি ধরন। নতুন আরো দুটি ধরন হলো, গামা ও লাম্বদা ভ্যারিয়েন্ট। এগুলো টিকাপ্রাপ্তদের দেহে আশ্রয় নিয়ে বংশবিস্তারের মাধ্যমে টিকা প্রতিরোধী সার্স কোভ-২ ভাইরাস জন্ম দিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। তবে ডেল্টার মতো বিপজ্জনক ধরনের বৈশ্বিক সংকটে সামান্যতম অসাবধানতাও তাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের সফলতাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। তাই ভ্যারিয়েন্ট যেটিই হোক, সেটি নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। দ্বিতীয়ত, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে এবং সামগ্রিকভাবে দেশে ব্যাপক টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। এক্ষেত্রে টিকার জন্য সরকার সর্বোচ্চ তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ