করোনায়ও বাড়ছে কৃষি উদ্যোক্তা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১০, ২০২১, ০২:০৬ পিএম

ঢাকা : করোনা মহামারির এই দুঃসময়েও দেশে নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, আমদানিনির্ভর বিদেশি ফল ও সবজি এখন দেশে চাষ হচ্ছে। তারা আরো জানান, এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ছে।

রংপুরের খায়রুল আলম। বছর দুয়েক হলো কৃষিতে বিনিয়োগ করেছেন। মোট ১২ বিঘা জমিতে দেশি বিদেশি নানা জাতের সবজি ও ফলের চাষ করছেন। পণ্যের তালিকায় দেশি বিভিন্ন সবজির পাশাপাশি রয়েছে ক্যাপসিকাম, ব্রকলি, রেড ক্যাবেজসহ নানা জাতের বিদেশি সবজি। এই কৃষি উদ্যোক্তা জানান, গত বছর শুধু ক্যাপসিকাম বিক্রি করেছেন প্রায় ৯ লাখ টাকার। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে ক্ষতি হলেও লোকসান গুনতে হয়নি।

কৃষি বিভাগের কর্তকর্তারা বলছেন, একসময় আমদানি করা ক্যাপসিক্যাম বাজারে বিক্রি হতো ৮০০-১০০০ টাকায়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখন এই ক্যাপসিকাম ব্যাপকহারে চাষ হচ্ছে। হলুদ, সবুজ, লাল রঙের ক্যাপসিকাম অহরহ পাওয়া যাচ্ছে। এসব বিক্রিও হচ্ছে ২০০-৪০০ টাকার মধ্যে।

কর্মকর্তারা জানান, শুধু ক্যাপসিকামই নয়, লেটুসপাতা, চায়নিজ পাতা, বিট রুট, ব্রকলি, রেড ক্যাবেজ, স্কোয়াশ, ফ্রেঞ্চ বিন, সুইট কর্ন, বেবি কর্ন, থাই আদা, থাই তুলসী, লেমনগ্রাস, স্যালারি পাতা, শিমলা মরিচ, চায়নিজ ক্যাবেজসহ বিভিন্ন বিদেশি সবজি এখন দেশেই চাষ হচ্ছে। আমাদের আর আমদানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। তবে এখনো এসব বিদেশ থেকে আমদানি হয়, যা কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ বলেন, একসময়ের আমদানি নির্ভর বিদেশি সবজি ও ফলগুলো এখন দেশব্যাপী চাষ হচ্ছে। বিশেষ করে করোনাকালীন সময়ে যখন মানুষ কাজ হারাচ্ছে তখন এ জায়গায় বিনিয়োগ বাড়ছে। প্রচুর নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে কৃষিতে। যাদের একটু বেশি বিনিয়োগ সক্ষমতা রয়েছে তারাই বিদেশি সবজি বা ফল চাষে আসছে।

তিনি বলেন, করোনায় অনেক মানুষ বিদেশ থেকে এসেছে, চাকরি হারিয়েছে। তাদের অনেকেই কৃষিতে বিনিয়োগ করছে। দেশি ফসলের পাশাপাশি বিদেশি বিভিন্ন সবজির চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশি সবজি ও ফল চাষে বাড়তি পরিচর্যা, পরিশ্রম ও বিনিয়োগ করতে হয়। এ কারণে সবাই চাইলেও তা করতে পারে না। যাদের ভালো সামর্থ্য রয়েছে তারা বিদেশি ফসলে আসে। তবে এর বাইরেও পদ্ধতির আধুনিকায়নের মাধ্যমে লাউ, ঝিঙা, মরিচ, শসা, গাজর, টমেটো, পেঁপেসহ দেশি ফলের উৎপাদনের হাজার হাজার উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছেন।

এইচ এম রাকিবুল আলম, পেশায় একজন ব্যাংকার, তবে স্বপ্ন দেখেন কৃষি উদ্যোক্তা হওয়ার। সেই স্বপ্ন থেকেই আজ প্রায় ১০০ বিঘা জমির উপর তার প্রকল্প। আম, ড্রাগন ফ্রুট, ক্যাপসিকাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সবজি ও ফল চাষ করছেন তিনি। কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহে রয়েছে তার চাষাবাদের এলাকা। নিজের বাগানে লাগানো খেজুর থেকে গুড় তৈরি করে বাজারজাত করেন তিনি। এই উদ্যোক্তা বলেন, কৃষির এই প্রকল্পটা আমার স্বপ্ন। চাই নিজের চাষের সমস্ত পণ্য সরাসরি ভোক্তার হাতে পৌঁছে দিতে। এজন্য মুড়িমুড়কি নামের একটি অনলাইন পেজ পরিচালনা করেন এবং পণ্যের অর্ডার নেন তিনি।

নাটোরের বড়াইগ্রামের রবিউল ইসলাম পেশায় শিক্ষক। এর পাশাপাশি করেন ড্রাগন ফলের চাষ। দেড় বছর ধরে চাষাবাদের সঙ্গে যুক্ত হলেও এখন তিনি সরাসরি ড্রাগন ফল ও চারা উৎপাদন করছেন। ৯ বিঘা জমির বেশিরভাগেই ড্রাগন ফল চাষ হচ্ছে এবং বাকিগুলোতে চারা তৈরির কাজ চলছে।

রবিউল ইসলাম বলেন, প্রচুর চাহিদা রয়েছে ড্রাগন ফলের। বাজারে ৪০০-৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও আমরা বিক্রি করছি ১৫০-৩০০ টাকার মধ্যে। অফ সিজনে অবশ্য ৫০০-৬০০ টাকা কেজি দরেও এই ফল বিক্রি করা যায়।

রাজশাহীর ছেলে মশিউর রহমান ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে চাকরির চেষ্টা করেছেন কিছুদিন। বিসিএসে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে টিকেননি। এর মধ্যে শুরু করোনা। শারীরিক অসুস্থতা ও করোনার কারণে ঘরবন্দি এই তরুণ মনে মনে পরিকল্পনা করেন কৃষিতে বিনিয়োগের। কিন্তু টাকা নেই।

বাবার কাছে কৃষি বাগান করার জন্য জমি চাইলে তাতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ বাবা চান ছেলে চাকরি করুক। তবে দমে যাওয়ার পাত্র নন মশিউর। ঠিকই কর্মসংস্থান ব্যাংক থেকে টাকা জোগাড় করে এবং জমি লিজ নিয়ে নিজেই নেমে পড়েন উদ্যোগ বাস্তবায়নে।

এখন চার বিঘা জমিতে তার বাগান। বিটরুট, বিদেশি মেলন, বেদানার মতো দামি ফলের চাষ করছেন। পাশাপাশি বাগান কিনে আমের ব্যবসাও করছেন বর্তমানে। এই উদ্যোক্তা জানান, এখন তার সমস্ত মনোযোগ কৃষিতে। আধুনিক কৃষির সঙ্গেই নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতে চান।

ঢাকা, মানিকগঞ্জ, রংপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, নাটোর, চট্টগ্রামের হাটহাজারী, রাউজান, ফটিকছড়ি, ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, ঝিনাইদহে কৃষিতে বিনিয়োগ করে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে।

কৃষিতে বিগত ২-৫ বছরে কি পরিমাণ উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আসাদুল্লাহ বলেন, বড় পরিসরে কৃষি খামার করছে এই সংখ্যাটা ১ হাজারের বেশি। এদের অনেকেই এখন দেশব্যাপী পরিচিত। তিনি বলেন, আমাদের কাছে সব উদ্যোক্তা ও পরিমাণ জানা নেই। তবে আমরা অধিদপ্তর থেকে উদ্যোগ নিয়ে দ্রুত এই উদ্যোক্তার সংখ্যা ও বিনিয়োগের পরিমাণ তালিকাবদ্ধ করবো।

শুধু যে উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে তা-ই নয়। দেশে গড়ে উঠেছে কৃষি উদ্যোক্তা তৈরির প্রতিষ্ঠানও। যারা প্রশিক্ষণ, বীজের জোগান, সার-কীটনাশকের পরামর্শ থেকে শুরু করে সব ধরনের কৃষি প্রযুক্তিরও সহযোগিতা প্রদান করেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই