ঘরমুখো মানুষের ঢল শিমুলিয়া ঘাটে

বাড়ি ফেরায় চরম ভোগান্তি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ১৯, ২০২১, ১১:৩৯ এএম

ঢাকা : ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে নাড়ির টানে বাড়ি ফিরছে মানুষ। কিন্তু কোরবানির গরুর ট্রাক ঢাকামুখী হওয়ায় মহাসড়কে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ যানজটের। এ কারণে ভেঙে পড়েছে দূরপাল্লার বাসের সিডিউল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসের জন্য কাউন্টারে অপেক্ষা করছেন যাত্রীরা।

এদিকে ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়েছে দুই ফেরিঘাটেও। মাওয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে হাজারো মানুষের ভিড়।

অন্যদিকে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ট্রাকের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় রোববার (১৮ জুলাই) প্রায় ২০ কিলোমিটারজুড়ে ট্রাকের সারি দেখা যায়।

অন্যদিকে গার্মেন্টস ছুটি হলে যাত্রী সংখ্যা আরো বেড়ে যাবে মনে করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, গার্মেন্টস আজ ছুটি হয়ে যাবে। আজ থেকে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত যাত্রীর চাপ থাকবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে জট না থাকলেও গাড়ির চাপ বেড়েছে বলেও খবর পাওয়া গেছে।

সিডিউল বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত : রোববার (১৮ জুলাই) রাজধানীর গাবতলী, কল্যাণপুর ও শ্যামলী বাস কাউন্টারগুলো ঘুরে গণপরিবহন কর্তৃপক্ষ ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, যানজটের কারণে দূরপাল্লার গণপরিবহন সিডিউল বিপর্যয়ে পড়েছে। এতে ঘরমুখী যাত্রীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

এসব কাউন্টার ঘুরে দেখা গেছে, যাত্রীরা সকাল থেকে কাউন্টারে এসে জমায়েত করলেও গাড়ির দেখা নেই। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনেকটাই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তাদের।

রাস্তায় যানজটের কারণে এই শিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। যেখানে প্রতিদিন সাত থেকে আটটি গাড়ি চলাচল করতো সেখানে দুটি গাড়ি চলছে। মহাসড়কে তীব্র যানজটের কারণে এমন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন শ্যামলীতে অবস্থিত কে লাইন পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার মো. রিয়াদ।  

তিনি বলেন, করোনার কারণে একটি বাসে ২০ জন যাত্রী নিয়ে চলতে হয়। তাই যাত্রীর চাপ আছে। তবে শিডিউল বিপর্যয়ের কারণে আমাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে।

রিয়াদ বলেন, আমাদের গাড়ি আসতে দেরি হলে যাত্রীদের ফোন করে জানাচ্ছি। তারপরও টাইমিং হচ্ছে না। অনেক যাত্রী কিছুটা আগেও চলে আসছে। এতে কিছুটা সময় তাদের কাউন্টারে অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

সকালের গাড়ি বিকেলের মধ্যেও আসছেনা। যাত্রীদের একাধিকবার ফোন করেও শিডিউল ঠিক রাখতে পারছি না। আবার কেউ কেউ ফোনে যোগাযোগ না করে সরাসরি চলে আসছেন কাউন্টারে এতে তাদের কিছুটা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সুন্দরবন এক্সপ্রেসের কাউন্টার ম্যানেজার গোলাম কিবরিয়া।

এদিকে কোরবানির কারণে ফেরিতেও গরুর গাড়িকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এতে রাস্তায় দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যার কারণে শিডিউল বিপর্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত হাই ট্রাভেলস দ্রুতি পরিবহনের ফোরম্যান মো. সুমন মিয়া।

তিনি বলেন, রাস্তায় যানজটের কারণে গাড়ির সিডিউল বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। সকালে গাড়ি ফেরার কথা থাকলেও সেই গাড়ি বিকেলেও ফিরছে না। তবে আমরা সিডিউল যাত্রীদের ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি।

ঢাকা থেকে যশোর যাবেন আজাদ হোসেন। দুই ঘণ্টা ধরে বাসের অপেক্ষায় রয়েছেন। কখন বাস আসবে আর কখন বাড়ি ফিরবেন কিছুই বুঝছেন না বলে তিনি জানান।

আজাদ বলেন, ফোন করে কাউন্টারে এসেছি তারপরও দুই ঘণ্টা হয়ে গেল এখনও গাড়ি এসে পৌঁছায়নি। জানি না কখন রওনা দিতে পারব।

অপরদিকে ঈদের পর ‘কঠোর লকডাউন’ থাকায় অনেকেই পরিবার নিয়ে ছুটছেন গ্রামের বাড়িতে। একটু দুর্ভোগ হলেও যাত্রীদের চোখেমুখে ছিল হাসি আর আনন্দে ভরা। পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়িতে ঈদের আনন্দটা সবাই একসঙ্গে উপভোগ করবেন এমনটাই প্রত্যাশা তাদের।

সরকারি ছুটি শুরু না হলেও ফাঁকা হতে শুরু করেছে ব্যস্ত নগরী ঢাকা। সরকারি ছুটির সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীদেরও চাপ অনেক বাড়বে বলে জানিয়েছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

ঘরমুখো মানুষের ঢল শিমুলিয়া ঘাটে : ঈদকে কেন্দ্র করে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া ঘাটে দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার ঘরমুখো মানুষের ঢল নামে গতকাল  রোববার।  

সকাল থেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঘাটে এসে ফেরি ও লঞ্চে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছেন হাজার হাজার মানুষ। অর্ধেক যাত্রী ধারণের কথা থাকলেও অধিক যাত্রী নিয়ে পদ্মা পাড়ি দিচ্ছে লঞ্চ। লঞ্চে ও ফেরিতে যাত্রীদের ভিড়ে হিমশিম অবস্থা।  সকাল থেকে যানবাহন ও যাত্রী পারাপারে নৌরুটে ১৭টির মধ্যে ১৪টি ফেরি ও ৮৩টি লঞ্চ চলাচল করছে।

দেখা যায়, ঘাটের পন্টুনে ফেরি ও লঞ্চ নোঙরের সঙ্গে সঙ্গে যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে উঠে পড়ছে। কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্যবিধির বিষয়ে সতর্ক করলেও বিন্দুমাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই যাত্রীদের।  কে কার আগে নৌযানে উঠবে সে প্রতিযোগিতায় ন্যূনতম সামাজিক দূরত্বও রাখছেন না তারা।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) শিমুলিয়া ঘাটের সহকারী উপ-মহাব্যবস্থাপক শফিকুল ইসলাম জানান, নৌরুটে বর্তমানে ১৪টি ফেরি সচল রয়েছে। শিমুলিয়া ঘাট এলাকায় পারাপারের জন্য পণ্যবাহী ও যাত্রীবাহী মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক যানবাহন অপেক্ষায় রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সকল যানবাহন পারাপার করা হবে।

বিআইডব্লিউটিসি শিমুলিয়াঘাটের মেরিন কর্মকর্তা জানান, নদীতে পানি বৃদ্ধি ও তীব্র স্রোতের কারণে শিমুলিয়া থেকে বাংলাবাজার ঘাটে যেতে ফেরিগুলোর দ্বিগুণ সময় লাগছে। প্রতিটি ফেরিকে স্রোতের বিপরীতে ও নদীতে ৩-৪ কিলোমিটার অধিক পথ ঘুরে যেতে হচ্ছে। স্রোতের বিপরীতে চলাচলে সক্ষমতা না থাকা তিনটি ফেরি নৌরুটের উভয় পাশে নোঙর করে রাখা হয়েছে।

দীর্ঘজটে পারাপারের অপেক্ষায় শত শত ট্রাক : পদ্মায় তীব্র স্রোত থাকায় একদিকে ফেরি চলাচলে সময় লাগছে বেশি, অন্যদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে শিমুলিয়াঘাটে ব্যক্তিগত গাড়ির বাড়তি চাপ রয়েছে। এতে ঘাটের অভিমুখে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে পারাপারের অপেক্ষায় শত শত গাড়ি। এমনকি কিছু গাড়িকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ২৪-৩০ ঘণ্টারও বেশি সময়।

দেখা যায়, এক্সপ্রেসওয়ের মাওয়ামুখী লেনে দোগাছি থেকে শ্রীনগর ছনবাড়ির কাছাকাছি কয়েক কিলোমিটার সড়কজুড়ে শত শত গাড়ির সারি। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকা এসব পরিবহনের চালক-শ্রমিকদের পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। এক্সপ্রেসওয়েতে লেনে পাস দিয়ে চলা অন্যান্য যান চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।

বাগেরহাটগামী একটি ট্রাকচালক খাইরুল হোসেন বলেন, ‘খাবারের কোনো দোকান নাই, টয়লেট নাই। রাস্তার ওপর কতক্ষণ থাকা যায় ভাই? কি করব? বুঝতে পারছি না।’

আরেক চালক লোকমান মিয়া বলেন, ‘লোহার অ্যাঙ্গেল নিয়া ফরিদপুর যামু। ২৪ ঘণ্টার বেশি হইবো রাস্তায় দাঁড়াই আছি। যদি আমাদের ঘাটে নিয়াও রাখতো ওই জায়গায় খাওয়া-দাওয়ার কষ্ট হইতো না।’

এ বিষয়ে হাসাড়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আফজাল হোসেন বলেন, ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে কয়েক শতাধিক গাড়ি ফেরি পারাপারের অপেক্ষা। শিমুলিয়া ঘাটে গাড়ির চাপ ও বিশৃঙ্খলা এড়াতে গাড়িগুলোকে এক্সপ্রেসওয়েতে রাখা হয়েছে। পচনশীল, শিশুখাদ্য ও জরুরি গাড়ি আটকানো হচ্ছে না। ঘাট থেকে আমাদের জানালে ২০-৩০টি করে গাড়ি সেখানে পাঠানো হচ্ছে। স্বাভাবিক ও নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ট্রাকগুলো এখানে রাখা হয়েছে। ফেরি চলাচলে বেশি সময় লাগায় গাড়ি পারাপারে দেরি হচ্ছে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে বাড়ছে চাপ : ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার ১০৪ কিলোমিটার অংশে গতকাল সকাল থেকে কোনো যানজট দেখা যায়নি। ঈদকে ঘিরে কর্মস্থল থেকে মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করায় মহাসড়কে যাত্রীবাহী পরিবহনের সংখ্যা বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে পণ্যবাহী ও কোরবানির পশুবাহী গাড়ির সংখ্যাও।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত শুক্রবার কুমিল্লার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মেঘনা ও গোমতী সেতুর টোলপ্লাজায় জট এবং মহাসড়কে দিনব্যাপী যানবাহনের ধীরগতি থাকলেও শনিবার থেকে গতকাল রোববার ১১টা পর্যন্ত মহাসড়কে যানবহনের ধীরগতি বা কোনো জট দেখা যায়নি। যানজটমুক্ত পরিবেশে ঈদে ঘরমুখো মানুষ স্বস্তিতে বাড়ি ফিরছেন। নেই কোনো ভোগান্তির গল্প।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে জট না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুমিল্লার হাইওয়ে পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ। তিনি বলেন, এবারের ঈদ যাত্রায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এখনো যানজট নেই। যানজট নিরসনে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত হাইওয়ে এলাকায় পুলিশের ৯টি ইউনিট কাজ করছে। একই সঙ্গে পুরো চট্টগ্রাম বিভাগের থানা ও ফাঁড়িসহ হাইওয়ে পুলিশের ২১ ইউনিটের ৩০ পেট্রল দল কাজ করছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন রাখার জন্য পশুর গাড়ি ও মানুষ নিরাপদে পৌঁছানো জন্য পাঁচটি রেকার ও দুটি অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত রাখা রয়েছে। এছাড়াও ১০টি কুইক রেসপন্স টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।

তিনি আরো বলেন, ঈদ ঘনিয়ে আসায় মহাসড়কে গাড়ির চাপ বাড়ছে। তবে কুমিল্লার অংশ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে যানবাহনের কোথাও কোনো জট নেই। সাধারণ যাত্রী ও পশু ব্যবসায়ীরা স্বস্তিতে যাতায়াত করছেন।

সোনালীনিউজ/এমটিআই