ঢাকা : করোনা মহামারির মধ্যেই দেশে ভয়ংকর হয়ে উঠছে ডেঙ্গু। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুয়ায়ী, জুলাই মাসে এ বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে। শুধু জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের ৯৯ শতাংশই ঢাকায়।
দেশে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে একদিনে হাসপাতালে ভর্তির সর্বোচ্চ রেকর্ড হয়েছে। গত একদিনে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ২৩৭ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় নতুন ভর্তি রোগী ২১৮ জন।
রোববার (১ আগস্ট) বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের নিয়মিত ডেঙ্গু বিষয়ক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত একদিনে হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ২৩৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় নতুন ভর্তি রোগী ২১৮ জন এবং ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন ১৯ জন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, এ পর্যন্ত দুই হাজার ৮৯৫ ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ছাড়পত্র পেয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে দুই হাজার ২৯ জন। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সর্বমোট ভর্তি থাকা ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৬২ জনে। ঢাকার ৪১টি হাসপাতালে বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৮২৮জন। চলতি বছরে এখন পর্যন্ত শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২ হাজার ৮৯৫ জন।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু সন্দেহে চারজনের মৃত্যুর তথ্য জানা গেছে।
করোনার মধ্যে ডেঙ্গুর এই বিস্তার নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে সরকার। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র এডিস মশা নির্মূলে নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। নগরীর বিভিন্ন ভবনে অভিযান চালিয়ে এডিস বিস্তারের পরিবেশ থাকায় জরিমানা করা হয়েছে। সচেতনতা বাড়াতে চলছে প্রচারণা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়ায় মশার মাধ্যমে। আর অন্য মশার সঙ্গে ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশার পার্থক্য আছে। মূলত এই মশাগুলোর জন্ম হয় আবদ্ধ পরিবেশে। ফলে নাগরিকরা সচেতন না হলে এই রোগ প্রতিরোধ করা কঠিন।
২০১৯ সালে ডেঙ্গু রোগে ব্যাপক প্রাণহানি ও লক্ষাধিক মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর গত বছর সতর্ক অবস্থানে ছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। তারপরও ২০২০ সালে সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১ হাজার ৪০৫ জন, যাদের মধ্যে ৬ জন মারা যান।
২০১৯ সালে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তারে আক্রান্ত হয় ১ লাখের বেশি মানুষ। যাদের মধ্যে মারা যায় ১৭৯ জন। গত বছর সংক্রমণের মাত্রা অনেকটা কম থাকলেও এ বছর পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, ‘আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা অরো বেড়ে যাবে। শহরের মানুষ ঈদের জন্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়ায় ৬৪টি জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু। ঢাকা শহরের সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা এখন লকডাউনের কারণে বন্ধ, এগুলো এডিস মশার প্রজননের বড় ক্ষেত্র।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধে জরুরিভিত্তিতে মশা নিধন কার্যক্রম আরো জোরদার করতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম বাড়াতে হবে, এডিস মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংস করতে হবে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করলে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে পারে।’
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছে ডেঙ্গু জ্বর। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। ডেঙ্গু রোগীদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিশ্চিতে কয়েকটি হাসপাতাল নির্দিষ্ট করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার এমন তথ্য জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
মন্ত্রী বলেন, ‘করোনা সংক্রমণের এমন পরিস্থিতিতে নতুন সংকট তৈরি করেছে ডেঙ্গু। প্রতিদিনই হাসপাতালের বারান্দায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। ডেঙ্গু আক্রান্তদের অনেকেই হাসপাতালে এসে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিতে পড়ছেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় ডেঙ্গু রোগীদের জন্য সুনির্দিষ্ট হাসপাতাল ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা নিচ্ছি।’
সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতাল, লালকুঠি হাসপাতাল, ১০০ শয্যাবিশিষ্ট রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালসহ বেশ কয়েকটি হাসপাতালকে ডেঙ্গু চিকিৎসায় ‘ডেডিকেটেড’ করা হবে বলে জানা গেছে।
এদিকে গত কয়েক বছরে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে নানা প্রকল্প, উদ্যোগ ও পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছিল। সে অনুযায়ী এ বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশক নিধন কাজে কিছুটা গুরুত্ব দিয়েছে। বাড়িয়েছে এ খাতের বরাদ্দও। এরপরও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। এতে শঙ্কিত নগরবাসী বলছে, সিটি করপোরেশনের উচিত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আরো ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) অঞ্চল ৩ এলাকায় ২০ সদস্যের একটি মশক নিধন টিম ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়ি বাড়ি ঢুকছে। পিঠে বাঁধা আছে মশার লার্ভা ধ্বংসের ওষুধেরপত্র। একজন হ্যান্ড মাইকে ডেঙ্গু বিস্তার রোধে করণীয় বিষয়ে সচেতনতামূলক বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশার লার্ভা ধ্বংসে প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। মশার লার্ভা পাওয়া গেলে জরিমানা করা হচ্ছে বাড়ির মালিকদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে অভিযানের ফলে সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে, ডেঙ্গুর প্রকোপ কমে আসবে। তবে বাসিন্দারা বলছেন, ডিএনসিসি কেবল জরিমানা করাতেই ব্যস্ত। পাড়া-মহল্লায় নিয়মিত মশক নিধন অভিযান তাদের নেই। এক দিন ওষুধ দিলে তিনদিন খবর থাকে না।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবুল বাশার মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানিয়েছেন, করোনাকালে যেন ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় কারো মৃত্যু না হয়, সেজন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১০টি অঞ্চলের ৫৪টি ওয়ার্ডে একযোগে ২৭ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত ১০ দিনব্যাপী মশক নিধনে চিরুনি অভিযানসহ জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। ভবন ও বাসা-বাড়িতে গিয়ে মশক নিধন কর্মীরা ওষুধ ছিটাচ্ছে। সেই সঙ্গে অভিযানও পরিচালিত হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের জানিয়েছেন, ডিএসসিসির প্রতিটি অঞ্চলে নিয়মিত ডেঙ্গুবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। আজো প্রতিটি অঞ্চলে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। গত শনিবার অভিযানে এডিস মশার লার্ভা নিয়ন্ত্রণে সাতটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। অভিযানে মশার লার্ভা পাওয়ায় ১৩টি নির্মাণাধীন ভবন ও বাসা-বাড়িকে এক লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই