ঢাকা : সারা দেশে ইউনিয়ন পর্যায়ে চলছে পরীক্ষামূলক গণটিকাদান কর্মসূচি। গত শুক্রবার এ কর্মসূচি শুরু হলেও এখনো বিভিন্ন কেন্দ্রে দেখা যাচ্ছে চরম বিশৃঙ্খলা।
টিকাদান কর্মসূচিতে পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী-পুরুষ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও প্রথম এবং দ্বিতীয় দিনে ২৫ বছরের বেশি বয়সি সবাই হাজির হয় টিকাকেন্দ্রে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা এবং ভোগান্তির।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবারের টিকাদান কর্মসূচিতে অনভিজ্ঞদের হাতে পরিকল্পনার দায়িত্বভার দেওয়ায় এমন পরিস্থিতি হয়েছে।
তাদের মতে, কয়েকদিনে এই টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে দফায় দফায় সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে।
গত সপ্তাহে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ৭ আগস্ট শুরু হওয়া ৭ দিনের গণটিকা কর্মসূচিতে ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সবাই টিকা নিতে পারবে। একই সঙ্গে কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা অগ্রাধিকার পাবে। ওই ঘোষণার পর ১৮ বছরের বেশি বয়সিরা টিকার জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করতে থাকে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও গত ১ আগস্ট শিক্ষার্থীদের টিকা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। তবে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে টিকা দেওয়ার বয়সসীমা ১৮ বছর থেকে ২৫ বছরে বহাল করা হয়।
এছাড়া ১ কোটিরও বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে সেখানে আরো বলা হয়েছিল, পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সিদের টিকার জন্য কোনো নিবন্ধনের প্রয়োজন হবে না। তারা কেবলমাত্র টিকাকেন্দ্রে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে গেলেই হবে।
এরপর ৭ দিনের পরিবর্তে ১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলক টিকাদান কর্মসূচির কথা বলা হলেও সেটিও সংশোধন করে ৬ দিনে ৩২ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য পুনর্নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি শুধু পঞ্চাশোর্ধ্ব নারী-পুরুষ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী এই তিন শ্রেণির মানুষকে টিকা দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
কিন্তু ৭ আগস্ট টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলে বয়স্ক ছাড়াও ২৫ বছরের বেশি বয়সি নিবন্ধনধারী সবাই টিকাকেন্দ্রে ভিড় করেন। এতে কেন্দ্রগুলোতে প্রচণ্ড ভিড় তৈরি হয়। এমনকি টিকা নিতে গিয়ে মারাত্মকভাবে ব্যহত হয় স্বাস্থ্যবিধি। আর দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা না পেয়ে ফিরে যেতে হয়েছে অনেককেই। ফলে ভোগান্তিতে পড়া মানুষগুলোর মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তবে বিশৃঙ্খলা এড়াতে এসএমএস ছাড়া কাউকে টিকাকেন্দ্রে ভিড় না করার পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এদিকে টিকা দিতে গিয়ে এ ধরনের ভোগান্তি এবং বিশৃঙ্খলা অব্যাহত থাকলে সাধারণ মানুষের আস্থা কমে যেতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
তারা এই কর্মসূচির শুরুর আগেই এ নিয়ে সতর্ক বার্তা দিয়েছিলেন। কিন্তু তা আমলে না নেওয়ায় যথারীতি বিশৃঙ্খলা থেকে রেহাই মেলেনি। তাই আগামী ১৪ আগস্ট গণটিকা কর্মসূচির আগে আরো ভালোভাবে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক এবং জাতীয় টিকা কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাক্তার বে-নজির আহমেদ গত ৫ আগস্ট জানিয়েছিলেন, টার্গেট ঠিক না করেই টিকাদান কার্যক্রম শুরু করা ঠিক হয়নি।
তার মতে, জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি ইপিআই’তে যেভাবে টার্গেট নির্ধারণ করে টিকা প্রদান করা হয়, করোনার টিকার বেলায়ও সেটি অনুসরণ করা যেতো।
ডাক্তার বে-নজির আহমেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বয়স্কদের এখন আগে টিকা দেওয়া হবে, এটি আগেভাগে তালিকা থাকলে সেই অনুযায়ী টিকা দেওয়া হলে একটা হিসাব থাকত। পাশাপাশি কারা বাদ পড়েছে এবং কারা টিকা গ্রহণ করেছে সেটার একটি সুনির্দিষ্ট হিসাব থাকত।’
তিনি রোববার (৮ আগস্ট) আবারো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তালিকা তৈরির পর গণটিকা কর্মসূচি শুরুর তাগিদ দিয়ে বলেন, ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে যদি তালিকা করা হতো তাহলে আমরা সহজেই টার্গেটেড পিপলকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারতাম। আর তালিকাভুক্ত করাটা খুব কঠিন কিছু না। কারণ আমাদের কমিউনিটি ক্লিনিকের চারদিকে ১২০০ থেকে ১৮০০ খানা রয়েছে। এদের মাধ্যমে তালিকা করলে মাত্র ৩ থেকে ৪ দিনেই তা সম্ভব।’
তার মতে, একটা কেন্দ্রে ২০০ জনকে টিকা দেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সেটা কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সাধারণত তাদের একদিনে এতজনকে টিকা দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই।
সুতরাং, এটা বাড়তি চাপ। তাই এ ব্যাপারে প্রস্তুতিটা আরো ভালো করে নেওয়া দরকার বলে মনে করেন তিনি। একই সাথে সমস্যাগুলো চিহ্নিত না করে টিকাদান কর্মসূচি শুরু করলে অনিয়ম বিশৃঙ্খলা ধরা পড়লে মানুষের আস্থা নষ্ট হতে পারে বলে মত দেন এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।
এদিকে ওয়ার্ড-ইউনিয়ন পর্যায়ে গণটিকাদান কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনেও কেন্দ্রগুলোতে বরাদ্দ ভ্যাকসিনের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ আসায় অনেককে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।
দ্বিতীয় দিনে সিটি করপোরেশন এলাকায় এ কর্মসূচি চলছে, এছাড়া প্রথম দিন যেসব এলাকায় টিকা দেওয়া যায়নি সেসব এলাকার মানুষও রোববার টিকা পাচ্ছেন।
ছয় দিনে ৩২ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়ার টার্গেট নির্ধারণ করলেও তা ৩৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ধারণা।
এছাড়া কর্মসূচির আওতায় দুর্গম এলাকাগুলোতে টিকাদান নিশ্চিত করতে হেলিকপ্টারে টিকা পাঠানোর পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার।
কোভিড-১৯ টিকা বাস্তবায়ন জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক জানান, যে টার্গেট ছিল, আমরা তার কাছাকাছি চলে এসেছি। ২৯ লাখ মানুষ টিকা নিয়েছেন। আমাদের ধারণা এটা ৩৫ লাখের উপরে চলে যাবে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরীক্ষামূলক গণটিকা কর্মসূচির প্রথমদিনে সারাদেশে রেকর্ড ২৮ লাখ ৩৬ হাজার ৯৭০ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ২৭ লাখ ৮৩ হাজার ১৭২ জনকে প্রথম ডোজ এবং ৫৩ হাজার ৭৯৮ জনকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, টিকাগ্রহীতাদের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ২৭ হাজার ৭৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ রয়েছেন ১৬ হাজার ২১৯ জন, নারী ১০ হাজার ৮৬০ জন।
সোনালীনিউজ/এমটিআই