ঢাকা : স্বজনপ্রীতি, অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে আজ শেষ হচ্ছে ৬ দিনের দেশব্যাপী গণটিকাদান কার্যক্রম। তবে এতসব অভিযোগের পরও গণটিকা কার্যক্রমে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণ আশা জাগিয়েছে সংশ্লিষ্টদের।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছয় দিনব্যাপী গণটিকাদান কার্যক্রম শুরু হয় গত ৭ আগস্ট শনিবার। মোট ৩২ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজের আওতায় আনতে এ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেওয়ায় সুযোগ পাওয়ায় আগ্রহী হন বৃদ্ধরাও। ব্যাপক সাড়া পাওয়া গেছে এ কর্মসূচিতে। তবে ‘গণচাপ’ সামাল দিতে না পারায় অধিকাংশ টিকাকেন্দ্রেই তৈরি হয় ‘গণবিশৃঙ্খলা’। অভিযোগ ওঠে ব্যাপক স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের।
একেকটি কেন্দ্রে সাড়ে তিনশ থেকে ছয়শ টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি থাকলেও অতিরিক্ত তিন থেকে চারগুণ মানুষ ভিড় করেন সব কেন্দ্রেই। শুরুতে নিবন্ধন ছাড়া টিকা পাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় অনেকে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে কেন্দ্রে যান। তবে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করেছেন, তবে টিকা দেওয়ার এসএমএস পাননি, অনেক কেন্দ্র এমন কাউকে টিকা দেওয়া হয়নি।
এদিকে গণটিকা দেওয়ার সময় স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত হওয়ায় করোনার উচ্চ সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের অভিমত, এ ধরনের কার্যক্রম শুরুর আগে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ কর্তৃপক্ষ তা করেনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, সাধারন মানুষের উপচে পড়া ভিড়ের কারণে কিছুটা বিশৃঙ্খলা হয়েছে, এটি সত্য। তবে আগামীতে যাতে এটি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত একযোগে গণটিকাদান কার্যক্রম শুরুর পর মানুষের ব্যাপক সাড়া মিলেছে। ভবিষ্যতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে দ্রুততম সময়ে টিকার আওতায় আনতে হলে এ ধরনের কার্যক্রম চালাতে হবে। সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য বিভাগের কতটুকু সক্ষমতা রয়েছে তা যাচাই করতেই সারা দেশে ছয় দিনব্যাপী এই ক্যাম্পেইন বলে জানান তিনি।
এদিকে টিকা দিতে গত কয়েকদিন ধরেই রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোর থেকেই লাইনে অপেক্ষা করছে সাধারন মানুষ। তবে অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েও তারা টিক পাচ্ছেন না। আবার অনেকে লাইনে না দাঁড়িয়েও পেয়ে যাচ্ছেন টিকা! আবার কোথাও কোথাও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ওই ওয়ার্ডের ভোটার ছাড়া কাউকে টিকা দিচ্ছেন না বলেও অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায় ক্ষুব্ধ টিকা নিতে আসা মানুষরা। আবার রেজিস্ট্রেশন ছাড়া টিকা নেওয়া যাবে-সরকারি এমন ঘোষণা দিলেও অনেক কেন্দ্রেই বয়স্ক ব্যাক্তিদের সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি।
বুধবার (১১ আগস্ট) রাজধানীর ধলপুর নগর মাতৃসদনে গিয়ে দেখা যায়, বয়স্ক এরকম বেশ কিছু মানুষকে রেজিস্ট্রেশন করে এসমএস না পাওয়ার কারণে ফিরিয়ে দেয় হয়। ধূপখোলা থেকে এই কেন্দ্রে বেলা ১১টার সময় টিকা নিতে আসেন আব্দুর রহমান ও তার স্ত্রী। গত ১৫ দিন আগে ষাটোর্ধ্ব এই দম্পতি রেজিস্ট্রেশন করলেও এসএমএস পাননি। তারপরও সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী তারা জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে আসেন টিকা দিতে। কিন্তু কেন্দ্রের বাইরে দায়িত্বরতরা তাদের ফিরিয়ে দেন।
আবার টিকা নিয়ে উঠেছে স্বজনপ্রীতির অভিযোগও। রাজধানীর মিরপুরের কল্যাণপুর গালর্স স্কুলের টিকা কেন্দ্রে সকিনা আক্তার নামে এক নারী করোনাভাইরাসের টিকা নিতে টানা তিন দিন লাইনে দাঁড়ান। কিন্তু লম্বা লাইনে ৪-৫ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ফিরে যেতে হয়েছে তাকে। অবশেষে গতকাল ৫ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকা নিতে পেরেছেন তিনি।
তিনি অভিযোগ করেন, টিকা নিতে তাকে লাইনে দাঁড়াতে হলেও অনেকেই লাইন ছাড়াই টিকা নিয়ে যাচ্ছেন; যারা কি না স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলের পরিচিত কিংবা দলীয় নেতাকর্মী বা তাদের স্বজন। এমনকি জাতীয় পরিচয়পত্র থাকার পরও সেই ওয়ার্ডের ভোটার না হওয়ায় অনেককেই ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা হলেও রাফসানা বেগম বরিশালের ভোটার হওয়ায় তাকে কেন্দ্র থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, টিকার জন্য ঘোষণায় তো বলা হয়েছে আইডি কার্ড নিয়ে যেতে, আমার আইডি কার্ড আছে তাও টিকা দেয়নি। বললো আমি যেখানে ভোটার সেখানে যেতে। আমার পক্ষে তো আর এখন বরিশাল যাওয়া সম্ভব না।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুরের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কল্যাণপুর গার্লস স্কুলে জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে গেলেও কেন্দ্রের স্বেচ্ছাসেবকরা স্থানীয় ওয়ার্ডের ভোটার না হলে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
শত শত মানুষ লাইনে দাঁড়ালেও ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নানের পরিচিত, দলীয় নেতাকর্মী, নেতাকর্মীদের স্বজনরা এলে লাইন ছাড়াই মুহূর্তেই টিকা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, ওয়ার্ড কাউন্সিলের নির্দেশ রয়েছে, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটার না হলে টিকা না দিতে। এ জন্য ১১ নম্বরের ওয়ার্ডের ভোটারের বাইরে কেউ এলে তাদের বলা হচ্ছে, তিনি যেখানে ভোটার সেখানে যেতে।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নানকে একাধিকবার টেলিফোন করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
গত রোববার ভোররাতে রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডার পূর্বাঞ্চল সড়কের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে টিকা নিতে কেন্দ্রে এসে সিরিয়ালে দাঁড়ান এলাকার বাসিন্দা সদরুল ইসলাম। পুরুষদের লাইনে তার সিরিয়াল নম্বর ছিল ২৭। তবুও টিকা না নিয়েই ফিরে যেতে হয়েছে তাকে। সদরুল ইসলাম বলেন, আমি ফজরের নামাজের পরই টিকা নিতে কেন্দ্রে এসেছি। তখন ২৬ জনের পেছনে ছিলাম। আমার সিরিয়াল নম্বর ছিল ২৭-এ।
যদি সাড়ে তিনশ টিকা দেওয়া হয়, তবে আমাদের লাইন থেকে ১৭৫ সিরিয়াল পর্যন্ত টিকা পাওয়ার কথা। কিন্তু আমার সিরিয়াল আসার আগেই ভেতর থেকে জানানো হচ্ছে টিকা শেষ।
তিনি বলেন, আমি অপারেশনের রোগী। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। আমরা কী অপরাধ করেছি? আমরা কী স্বাধীন দেশে বাস করি না!
টিকা নিতে ভোরে এসে সিরিয়ালে দাঁড়িয়েও টিকা না পেয়ে এমন ক্ষোভ জানিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। তাদের অভিযোগ সিরিয়ালে দাঁড়ানোদের টিকা না দিয়ে প্রভাবশালীরা নিজেদের ‘কমিশনারের লোক’ পরিচয় দিয়ে পরে এসেও আগে টিকা নিয়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে সিরিয়ালে দাঁড়ানো মানুষ টিকা পাচ্ছেন না।
আবার ভিড় ঠেলে লাইনে দাঁড়িয়ে যারা টিকা পাচ্ছেন, তারা নিজেদের অনেকটা সৌভাগ্যবান মনে করছেন। তাদেরই একজন সোমা বেগম।
পূর্বাঞ্চল সড়কের প্রাথমিক বিদ্যালয় টিকাকেন্দ্রে টিকা নিয়ে বেরিয়ে তিনি বলেন, আমি ফজরের আজানের আগে এসে দাঁড়িয়েছি। নারীদের লাইনে আমার সিরিয়াল নম্বর ছিল ৭০। অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল, আমি ভেতরে যেতে পারব না। পুলিশের একজন সদস্যের সহযোগিতায় আমি ভেতরে ঢুকতে পেরেছি।
শুধু রাজধানীতেই নয়, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে ঢাকার বাইরেও। সাকলায়েন নামে খুলনা সরকারি বিএল কলেজের এক শিক্ষার্থী বলেন. দেশব্যাপী গণটিকাদান কার্যক্রমে মানুষের ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলো, কিছু মানুষ লাইনে না দাঁড়িয়ে আগেভাগে টিকা নিতে স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে তদবির করছেন।
এরই ধারাবাহিকতায় স্বেচ্ছাসেবকরা কৌশলে নিজেদের পরিচিত লোকজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কেন্দ্রে ঢুকিয়ে দিয়ে আগে টিকা নেওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছেন। এর ফলে দীর্ঘ লাইনে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও টিকা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
আমি মনে করি, পঞ্চাশোর্ধ্ব বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও নারীদের টিকা গ্রহণে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। গণটিকাদান কেন্দ্রের অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা ও স্বজনপ্রীতি বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
এদিকে দেশে গণটিকার কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে যখন অনেক জায়গায় টিকার সংকট দেখা দিয়েছে, তখন যারা দ্বিতীয় ডোজ পাবে তাদের অভয় দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সংস্থাটির মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেছেন, দ্বিতীয় ডোজের টিকা নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তা নেই। আমাদের হাতে ফাইজার, মডার্না এবং সিনোফার্মের দ্বিতীয় ডোজের জন্য পর্যাপ্ত টিকা রয়েছে। টিকা নিয়ে কোনো আশঙ্কার অবকাশ নেই। সুতরাং কোনো ধরনের বিভ্রান্তি বা অপপ্রচারে কান দেবেন না।
বুধবার (১১ আগস্ট) দুপুরে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভার্চুয়াল বুলেটিনে তিনি এসব কথা বলেন।
নাজমুল ইসলাম বলেন, যাকে যেসব কেন্দ্র থেকে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া হয়েছে, তার টিকা কার্ডে দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার নির্ধারিত সময় লিখে দেওয়া হয়েছে।
সে অনুযায়ী টিকাকেন্দ্রে গেলেই যিনি প্রথম ডোজে ফাইজারের টিকা নিয়েছেন তাকে ফাইজারের দ্বিতীয় ডোজ, যিনি মডার্না বা সিনোফার্মের টিকায় প্রথম ডোজ নিয়েছেন, তাকে সে অনুযায়ী মডার্না ও সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কর্মসূচি শুরুর পর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়েছে এক কোটি ৯৬ লাখ ৭১ হাজার ৬২০ ডোজ। এর মধ্যে এক ডোজ নিয়েছেন এক কোটি ৪৭ লাখ ৬৯ হাজার ৪৪৭ জন এবং টিকার দুই ডোজ নিয়েছেন ৪৯ লাখ ২ হাজার ১৭৩ জন। এগুলো দেওয়া হয়েছে অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রাজেনেকা, চীনের তৈরি সিনোফার্ম, ফাইজার এবং মডার্নার ভ্যাকসিন।
তাদের মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকায় প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৫৮ লাখ ২০ হাজার ৬৩ জনকে। ফাইজারের টিকায় প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে ৫০ হাজার ২৫৫ জনকে। সিনোফার্মের দেওয়া হয়েছে ৬৮ লাখ ২৭ হাজার ৩৮৩ জনকে এবং মডার্নার টিকা দেওয়া হয়েছে ২০ লাখ ৭১ হাজার ৭৪৭ জনকে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই