ঢাকা : দেশে করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমে এলেও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। এরই মধ্যে হাসপাতালগুলোতে কমেছে করোনা রোগীর চাপ। কমেছে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যাও।
এদিকে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। তবে আশঙ্কার কথা হলো, ডেঙ্গু আক্রান্তের ৪০ ভাগই শিশু।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে করোনা সংক্রমণ আগামী সেপ্টেম্বরে হয়তো আর বাড়বে না। তবে আগামী মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ জুন থেকে সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুর মৌসুম। ২০১৯-এর মতো এবারো ভয়ংকর হতে পারে ডেঙ্গু। এ বছর শনাক্ত রোগীর বেশিরভাগই ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ থ্রি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। দুই বছর আগেও এ ধরনের ভ্যারিয়েন্টে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। ডেঙ্গুর এখন পর্যন্ত চারটি ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে, যার মধ্যে সেরোটাইপ থ্রি বেশি সংক্রমিত করতে সক্ষম।
এছাড়া করোনা এবং ডেঙ্গুর উপসর্গ প্রায় একই রকম হওয়ায় বিভ্রান্তি বাড়ছে। তাই জ্বর দেখা দিলে এখন করোনা ও ডেঙ্গুর টেস্ট একই সঙ্গে করানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
এদিকে বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে ১০২ জন মারা গেছে। এ নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ২৫ হাজার ৭২৯ জন। এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত চার হাজার ৬৯৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত মোট ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৬২৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। গত ২৮ জুলাই একদিনে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার ২৩০ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল।
বৃহস্পতিবার (২৬ আগস্ট) বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বুধবার সকাল ৮টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় অ্যান্টিজেন ও আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে ৩৪ হাজার ১১১টি নমুনা পরীক্ষায় চার হাজার ৬৯৮ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। পরীক্ষা বিবেচনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, বুধবার (২৫ আগস্ট) পর্যন্ত চলতি বছর ৮ হাজার ৮৫৩ জনের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৪০ জন। এর মধ্যে আগস্ট মাসের প্রথম ২৫ দিনেই ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঢাকায় সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেশি।
আর ডেঙ্গু আক্রান্তের প্রায় ৪০ শতাংশেরই বয়স ১ থেকে ১২ মধ্যে। চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্বই ঝুঁকিতে ফেলছে শিশুদের। ফলে চলতি বছর ডেঙ্গুতে প্রাণ হারানোদের প্রায় ত্রিশ শতাংশই শিশু।
এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগী প্রায় নয় হাজার এর মধ্যে প্রায় ৪০০ ভর্তি হয়েছে ঢাকা শিশু হাসপাতালে। রোগীর চাপ সামাল দিতে তাই হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতাল কর্তপক্ষকে। ফাঁকা নেই আইসিইউ, রোগীদের বড় একটি অংশই দেরি করে হাসপাতালে আসায় সংকট আরো বাড়ছে।
ঢাকা শিশু হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক ডা. সারাবন তহুরা বলেন, এক-একটা রোগ কিন্তু এক ধরনের, যেমন করোনা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে কিন্তু ততটা খারাপ হয় না। যতটা বড়দের হয়। তেমননি ডেঙ্গু। এতে শিশুরাই বেশি ঝুঁকিতে আছে। তারাই বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ওভার ফ্লুইড হয়ে বাচ্চারা অনেক খারাপ হয়ে যাচ্ছে, তারপরে হাসপাতালে আসছে। তখন কিন্তু কঠিন হয়ে পড়ছে আমাদের কাছে চিকিৎসা দেওয়া। করোনা সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বিএসএমইউর সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম মনে করেন,
করোনা সংক্রমণ আরো কমবে। গত বছরও এই সময়েই সংক্রমণ কমে গিয়েছিল। তবে এর কারণ কী সে সম্পর্কে আমাদের কোনো গবেষণা নেই। গত বছর করতে চেয়েছিলাম, পারিনি। তবে এবার একটা গবেষণা শুরু করেছি। এখনো ফল হাতে পাইনি।
তিনি আরো মনে করেন, এবার কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে এখানে আর হয়তো করোনা বাড়বে না। ভ্যাকসিন যদি দ্রুত দিয়ে দেওয়া যায় তাহলে অনেক ভালো হবে। আর স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এটা আরো কড়াকড়ি করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আমাদের এখনই খুশি হওয়ার কিছু নাই। অক্টোবরে করোনার আরেকটি ওয়েভ আসতে পারে। সেটা ঠোকতে হলে আমাদের এখনই ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
ডেঙ্গুর এই পরিস্থিতির জন্য আমাদের দায়িত্বহীনতাই দায়ী উল্লেখ করে লেলিন চৌধুরী বলেন, এবার বছরের শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন যে এবার ডেঙ্গু ভয়বহ হবে। কারণ এডিস মশার উপস্থিতি অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ডেঙ্গু মশার চার ভাগের তিন ভাগই হচ্ছে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত স্থাপনায়। আর এক ভাজ বাসাবাড়িতে। নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। কিন্তু বাকি তিন ভাগ মশার দায় কার। মেয়র নগরবাসীকে দায়ী করছেন। কিন্তু তারা কি দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ অবস্থায় করোনা এবং ডেঙ্গুর উপসর্গ প্রায় একই রকম হওয়ায় বিভ্রান্তি বাড়ছে। তাই এখন করোনা এবং ডেঙ্গুর টেস্ট একই সঙ্গে করানোর পরামর্শ দিলেন তিনি।
মিটফোর্ড হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী রশিদ উন নবী বলেন, গত বছর সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গু রোগী তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। সে অনুযায়ী আমরা সেপ্টেম্বরের জন্য প্রস্তুত আছি। এক সপ্তাহে আগের চেয়ে বেশি রোগী ছিল। আমাদের এখানে ডেঙ্গু রোগী ক্রমাগত বৃদ্ধির প্রবণতায় আছে।
মশা বিষয়ে জাপানের কানাজোয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, চলতি বছর ডেঙ্গুর ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতার পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। এ বছর এপ্রিল ও মে মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি ছিল। দেশে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার বংশবৃদ্ধির উপযোগী তাপমাত্রা ছিল। তাছাড়া এক বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ হলে পরেরবার তা কম হয়।
কারণ, অনেকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। আবার লোকজনও সচেতন থাকে। সেই হিসাবে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে প্রকোপ বেশ কম ছিল। কিছু সময় পার হলে মানুষ ডেঙ্গু নিয়ে দুর্ভাবনাহীন হয়ে যায়। অসচেতনতার কারণে আবার বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ গত বছরের তুলনায় বেশি। তাই এবার ডেঙ্গু রোগ সেপ্টেম্বরে আরো বাড়তে পারে। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব ও বৃষ্টিপাতের ধরন দেখা বলা যায়, সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ প্রকোপ কমবে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন ২০১৯ সালের ডেঙ্গু ভয়াবহতা যেনো এবারও চোখ রাঙ্গাচ্ছে। তারা বলছেন মহামারি করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে সবাইকে অবশ্যই স্বাস্থ্য সচেতনতা মেনে চলতে হবে। একই সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে কর্তৃপক্ষকে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই