ঢাকা : শিল্পখাতে বছরে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ দক্ষ কর্মী প্রয়োজন। কিন্তু দেশে সে পরিমাণ দক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছে না। কপক্ষে ৩৬ শতাংশ নিয়োগদাতা ভুগছেন দক্ষ ও বিশেষজ্ঞ কর্মী সংকটে। বর্তমানে বছরে দেশে ২১ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। এরমধ্যে সামান্য অংশই দক্ষ। অথচ বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ শিল্পতে সাড়ে ১৮ লাখ এবং বিদেশের শ্রমবাজারে ৫ লাখ দক্ষ জনশক্তির চাহিদা রয়েছে।
শুধুমাত্র দেশের পোশাকখাতেই করোনা পরবর্তী সময়ে ৩ লাখ দক্ষ শ্রমিক প্রয়োজন হবে। কিন্তু এখনো গড়ে উঠেনি কোনো প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন পোশাকখাতে দক্ষ শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ থেকেও বিভিন্ন দেশে শ্রমিকরা চলে যাওয়ায় পোশাক শিল্পে তৈরি হতে পারে শ্রমিক সংকট।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৭২টি দেশে কাজ নিয়ে যায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা। একসময় অনেক দেশে বৈধভাবে কর্মসংস্থানের জন্য কর্মীরা গেলেও গত কয়েক বছরে সেই বাজার সংকুচিত হয়ে উঠেছে। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বে শ্রমবাজার আরো চাপে পড়েছে।
জানা গেছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে থেকে সরকারিভাবে আট থেকে ১০ লাখ শ্রমিক বিদেশে যান। এদের বেশিরভাগই যান অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে। তবে অন্যান্য ভিসা মিলিয়ে ২০ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে যান বলে জানায় বায়রা।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক আতিকুর রহমান জানান, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। এরপরই রয়েছে ওমান, কাতার, বাহরাইন। জর্ডান, সিঙ্গাপুর, রোমানিয়া দেশেও অল্প কিছু কর্মী যাচ্ছেন। কম বেশি বৈধভাবে ১৭২টি দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা যাচ্ছেন বলে তিনি জানান। কিন্তু দক্ষ শ্রমিকের সংকটের কারণে বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকের চাহিদা কমছে।
কিছুদিন আগেও কুয়েত, মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালদ্বীপ বাংলাদেশের জন্য বড় শ্রমবাজার ছিল। এখনো এসব দেশে বৈধ-অবৈধ মিলিয়ে অনেক বাংলাদেশি কাজ করেন। কিন্তু এসব দেশে বৈধভাবে এখন কর্মীরা যেতে পারছেন না। আর করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পর প্রায় দুই লাখ শ্রমিক বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন।
দেশে দক্ষ শ্রসিক সংকট নিয়ে মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) এক সেমিনার আয়োজন করে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-এনএসডিএ।
এতে জানানো হয়, দেশের ২৫ থেকে ৫৪ বছরের মানুষের মধ্যে ৮২ শতাংশই বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত। তবে এরমধ্যে মাত্র ৬.৩ শতাংশের কোনো বিশেষ বিষয়ে দক্ষতা রয়েছে। আর ৫৩ শতাংশ মোটামুটি দক্ষ এবং ৪০.৭ শতাংশ একেবারেই অদক্ষ।
এবিষয়ে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, দেশের অর্থনীতি ক্রমে কৃষিনির্ভর থেকে শিল্পনির্ভর হচ্ছে। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ কর্মী তৈরি হচ্ছে না। অথচ সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে ৩ কোটি দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে চায়। পাশাপাশি ২০২৫ সালের মধ্যে ১৫০ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আহরণ করতে চায়। এজন্য প্রায় ৮০ লাখ দক্ষ কর্মীর প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে দক্ষ শ্রমিক রয়েছে মাত্র ২৬ লাখের মতো।
তিনি জানান, বাংলাদেশে প্রায় ১৬ কোটি ৯০ লাখ মানুষের মধ্যে ৭০ শতাংশই কর্মক্ষম। যদিও বেকারত্বের হার ১২.৩ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে ১৮-৩৫ বছর বয়সী জনসংখ্যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ কোটিতে। এবিপুল যুব জনগোষ্ঠীকে দক্ষতা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশের শ্রমবাজারের চাহিদার উপযোগী করে গড়ে তোলা দরকার। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিভিন্ন পলিসি প্রণয়নে সরকারকে সহযোগিতার জন্য ব্যবসায়ীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, দক্ষ জনবল তৈরির মাধ্যমে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন সহজতর হবে। করোনার অস্বাভাবিক এ সময়ে পেশার ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য তৈরি হয়েছে।
করোনাকালীন মানুষ ব্যাপকভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফরম-নির্ভর হয়েছে। ফ্রি-ল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয়ের পরিমাণ বেড়েছে। সামাজিক ও পেশাগত পরিবর্তনগুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা নিতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নে প্রচলিত প্রশিক্ষণ কোর্সের কার্যকারিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আধুনিক ও আগামীর প্রযুক্তির চিন্তা মাথায় রেখে স্ট্যান্ডার্ড ও প্রশিক্ষণ কারিকুলাম প্রণয়ন করতে হবে।
তিনি জানান, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে অনেকে চিন্তিত। তবে মেশিন কখনো মানুষকে স্থান দখল করতে পারবে না। এ জন্য ওই বিষয়ে শিক্ষা নিতে হবে, দক্ষ হতে হবে।
অধ্যাপক মো. হাবিবুর রহমান জানান, বর্তমানে প্রতিবছর দেশের শ্রমবাজারে প্রায় ২২ লাখ যুবক যুক্ত হচ্ছে। তাই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুযোগ কাজে লাগানোর এখনই প্রকৃত সময়। কর্মক্ষম জনবলকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে একদিকে উৎপাদনশীলতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, অন্যদিকে দক্ষ জনবল বিদেশে প্রেরণের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব।
এনএসডিএ নির্বাহী চেয়ারম্যান দুলাল কৃষ্ণ সাহার মতে, দেশের দক্ষতা উন্নয়নের চিত্রটি খুব আশাপ্রদ নয়। এর কারণ শিল্পখাত এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংযোগ হয়নি। এটা কাগজে-কলমেই রয়েছে। এখনো ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে দেওয়া হয় না।
তিনি বলেন, শ্রমশক্তির ৮৫.১ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে রয়েছে। এর মধ্যে ৩৯.৯ শতাংশ কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। অন্যদিকে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর ২৯.৮ শতাংশ কোনো ধরনের শিক্ষা, শ্রম বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই। এই বিপুল স্বল্পশিক্ষিত শ্রমজীবী মানুষকে দক্ষ করে তোলা বড় চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি আমাদের দক্ষ প্রশিক্ষকেরও সংকট রয়েছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমেদ সায়েম বলেন, ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক প্রয়োজন। সেক্টর গ্রোথ কেমন, কোন সেক্টরে কত লোক প্রয়োজন, তা আগে নিরূপণ করতে হবে। সে অনুযায়ী কারিকুলাম ডেভেলপ করতে হবে।
সোনালীনিউজ/এমটিআই