ঢাকা : দেশে করোনাভাইরাসের টিকার পরিকল্পনায় নেওয়া অগ্রাধিকার তালিকাতে ‘ঝুঁকিপূর্ণদের’ প্রথম দিকেই রাখা হয়েছিল। এরই মধ্যে বয়সসীমা কয়েক ধাপ নামিয়ে শিশুদের পর্যন্ত পরীক্ষামূলক টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। আর এতে টিকা নেওয়ার তালিকা বাড়লেও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে যাদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা, তাদের টিকা পাওয়ার হার কমে যাচ্ছে।
করোনাভাইরাসের টিকা পেতে গত আগস্ট মাসে নিবন্ধন করেছিলেন রওশন আরা হোসেন। ৬৫ বছর বয়সি ওই নারী উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসে ভুগছেন; চারবার স্ট্রোকও করেছেন তিনি। কিন্তু ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত রওশন আরা হোসেন টিকা নেওয়ার এসএমএস পাননি।
অথচ কেবল দেশে নয়, বিশ্বজুড়েই মহামারির শুরু থেকে বৃদ্ধ এবং অন্য জটিল রোগে আক্রান্তদের ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের মৃত্যুঝুঁকিও তরুণদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৪ অক্টোবরের করোনা বিষয়ক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে থেকে জানা যায়, দেশে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে মোট মৃত্যু হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩৭ জনের। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ৬১ থেকে ৭০ বছর বয়সীরা; ৮ হাজার ৬১৪ জন। এরপর রয়েছেন ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সিরা, এই বয়সসীমার ৬ হাজার ৫৪৪ জন মারা গেছেন।
৭১ থেকে ৮০ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪ হাজার ৮১৪ জনের, ৪১ থেকে ৫০ বছর বয়সিদের মৃত্যু ৩ হাজার ২৮৫ জনের, ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের মৃত্যু ১ হাজার ৬৫৪ জনের, ৮১ থেকে ৯০ বছরের মধ্যে মৃত্যু ১ হাজার ৫৬৭ জনের, ২১ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মৃত্যু ৬৪১ জনের, ৯১ থেকে ১০০ বছর বয়সীদের মৃত্যু ৩২৮ জনের, ১১ থেকে ২০ বছর বয়সীদের মৃত্যু ১৮০ জনের, শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সীদের মৃত্যু হয়েছে ৭৭ জনের আর ১০০ ঊর্ধ্ব বয়সী মারা গেছেন ৩৩ জন।
টিকা বিষয়ক পরিকল্পনা নিয়ে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটি টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী’র কথা উল্লেখ করে। কমিটি বলে, যেহেতু প্রথমেই দেশের সবার জন্য ভ্যাকসিন পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে, তাই ‘উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী’ বাছাই করে পর্যায়ক্রমে ভ্যাকসিন দেওয়া যেতে পারে।
কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, বয়স্করা যে কোনো রোগের বেলাতেই সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ। তারা আগে থেকেই নানান জটিল রোগে আক্রান্ত থাকেন। তারা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, লিভার, হূদযন্ত্রের সমস্যায় ভোগেন। যার কারণে তারা স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল থাকেন এবং সহজেই কাবু হয়ে যান। তাদের মৃত্যুঝুঁকিও স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের চেয়ে বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৪ অক্টোবর টিকা বিষয়ক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, দেশে এখন পর্যন্ত টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন ৫ কোটি ৪০ লাখ ৬২ হাজার ৩৬২ জন, আর তাদের মধ্যে এসএমএসের অপেক্ষায় রয়েছেন ১ কোটি ৬৩ লাখ ১৫ হাজার ৮৩১ জন।
দেশে ৫৫ কিংবা তদূর্ধ্ব বয়সসীমার ব্যক্তিদের জন্য সুযোগ রেখেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকাদান কর্মসূচির নিবন্ধন শুরু হয় চলতি বছর ২৬ জানুয়ারি। পরে দ্বিতীয় দফায় বয়সসীমা কমিয়ে ৪০ বা তদূর্ধ্ব করা হয়, তৃতীয় দফায় কমিয়ে ৩৫ বছর এবং এরপর চতুর্থ দফায় ৩০ বছর করা হয় গত ১৯ জুলাই। তবে করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলায় সম্মুখ সারিতে যারা কাজ করছেন, তাদের জন্য এই বয়সসীমা প্রযোজ্য নয়।
গত বৃহস্পতিবার দেশে ১২ থেকে ১৭ বছর শিক্ষার্থীদের পরীক্ষামূলক টিকা দেওয়া হয়েছে। তাদের আগামী ১০ থেকে ১৪ দিন পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ওই টিকাদান কর্মসূচি উদ্বোধন করে প্রথম পর্যায়ে ৩০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে জানিয়ে বলেন, সারা দেশে ১ কোটিরও বেশি ছেলেমেয়েকে আমরা টিকা দেবো। তবে এটা পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে। হাতে এখন ৬০ লাখ ডোজ ফাইজারের টিকা আছে- জানিয়ে তিনি বলেন, সারা দেশে ২১টি জায়গায় শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম চালানো হবে। ঢাকায় একটি বড় অনুষ্ঠানের মাধ্যমেও টিকাদান হবে।
তবে বয়স্কদের শেষ না করেই শিশুদের টিকা দেওয়া ‘ঠিক হচ্ছে না’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন্স সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম জানান, দেশে পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তি রয়েছেন মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ অর্থাৎ ২ কোটি ৮৭ লাখ ৪৮ হাজার ৭০০ জন। ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২০’ অনুযায়ী, গত ১ জানুয়ারি জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ, যার আট দশমিক তিন শতাংশ ষাটোর্ধ্ব আর ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে রয়েছেন পাঁচ দশমিক দুই শতাংশ।
যে প্রক্রিয়ায় এখন টিকা দেওয়া হচ্ছে ‘এটা ঠিক পথ নয়’ মন্তব্য করে অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেন, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যারা, তাদের আগে টিকার জন্য টার্গেট করতে হবে। সেক্ষেত্রে জনসংখ্যার ষাটোর্ধ্ব রয়েছে আট দশমিক তিন শতাংশ। এই মানুষগুলোর করোনা হলে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। তাই তাদেরই টিকাদানে সবচেয়ে অগ্রাধিকার হিসেবে নিতে হবে, তাদের আগে বাঁচাতে হবে। সেইসঙ্গে এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদের কোমর্বিডিটি (আগে থেকেই অন্যান্য রোগে আক্রান্ত) রয়েছে, তাদের রিস্কটা যেন রিডিউস করা যায়।
তিনি বলেন, সেজন্যই আমরা বলেছিলাম আগে বয়স্কদের টিকা নিশ্চিত করে পরবর্তী গ্রুপে যাবেন। কিন্তু বয়স্কদের কত শতাংশের টিকা দেওয়া হয়েছে সেই পরিসংখ্যান কি আমাদের কাছে রয়েছে? এখনো এই জনগোষ্ঠীর সবাইকে টিকা দেওয়া হয়নি। আর সেটা না করেই বয়সসীমা কমিয়ে আনা হলো, এখন তো কমিয়ে শিশুদের পর্যন্ত নিয়ে এসেছি। শিশুদের অবশ্যই দেওয়া হবে কিন্তু সেটা বয়স্ক এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে নয়, তাদের টিকা নিশ্চিত হওয়ার পর ক্রমান্বয়ে সেখানে যেতে হবে, বলেন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম।
জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু বলেন, বিজ্ঞান, অগ্রাধিকার এবং ন্যায্যতা বা সমতার প্রশ্নে কোনো ধরনের ‘ডেভিয়েশন’ (বিচ্যুতি) করা উচিত হবে না। ৮০ শতাংশ মানুষ কখনো অগ্রাধিকার হতে পারে না, ৮০ শতাংশ মানুষ টার্গেট। লক্ষ্য আর অগ্রাধিকার এক বিষয় নয়।
৮০ ভাগ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য আমাদের পর্যায়ক্রমে যেতে হবে, সে পর্যায়ক্রমে যাদের আগে টিকা দেওয়ার কথা তার নাম অগ্রাধিকার। এই অগ্রাধিকার তালিকায় টিকার পরিকল্পনায় কারা ছিলেন, সেটা দেখতে হবে। বিশ্বজুড়েই প্রিন্সিপাল তৈরি করা আছে, টিকার ক্ষেত্রে কারা অগ্রাধিকার হবেন।’
ফ্রন্টলাইনাররা অগ্রাধিকার পাবেন, এরপর যারা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন তারা পাবেন, এরপর যারা কোমর্বিডিটি আছেন তারা, এভাবে গ্রাজুয়েলি বয়স নামতে হবে উল্লেখ করেন অধ্যাপক সায়েদুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘এটা পরিষ্কার ৪৫ বছরের উপরেই মৃত্যুর শতকরা ৮৫ থেকে ৯০ ভাগ হচ্ছে। তাই ৪৫ বছরের নিচে নামাই (টিকা দেওয়া) উচিত হয়নি কোনোভাবে, শিশুরা তো আরো পরের বিষয়।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে শিশুদের মৃত্যু অন্যদের তুলনায় ৪০ ভাগের এক ভাগ, যাদের ৪০ গুণ বেশি ঝুঁকি তাদের পুরো টিকা না দিয়ে কী করে শিশুদের টিকা দেওয়া হচ্ছে-প্রশ্ন তোলেন অধ্যাপক সায়েদুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘৮০ বছরের উপরে কেউ করোনায় সংক্রমিত হলে ১৮ বছরের কম বয়সীদের চেয়ে তার মৃত্যুঝুঁকি ৭৬ গুণ বেশি। অথচ তাদের টিকা না দিয়ে শিশুকে টিকা দেওয়া নৈতিকভাবে উচিত না।
সোনালীনিউজ/এমটিআই