ঢাকা : পাহাড়সম অভিযোগ মাথায় নিয়ে সোমবার (১৪ ফেব্রুয়ারি) বিদায় নিচ্ছে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
এই কমিশন তাদের মেয়াদের পাঁচ বছরে অনিয়ম, দুর্নীতি, পক্ষপাত, বিতর্কিত নির্বাচন আয়োজনসহ নিজেদের মধ্যে কলহের নানা নেতিবাচক নজির সৃষ্টি করেছে। তাদের বিরুদ্ধে শুধু রাজনৈতিক দলই নয়, নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকেও ছিল নানা অভিযোগ।
এই পাঁচ বছরে অসংখ্যবার ইসির পদত্যাগের দাবি করে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন। রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে ইসির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের দাবিও করেন বিশিষ্ট নাগরিকরা।
ইসির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শরিকরাও সংসদের বৈঠকে সমালোচনায় মুখর হয়। এসব সমালোচনা কখনোই আমলে নেয়নি ইসি। বরং গতকাল রোববার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা দাবি করেছেন, নিরপেক্ষতা এবং সাফল্যের সঙ্গে তারা দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শপথ নেওয়া বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ। এ উপলক্ষে গতকাল সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের সঙ্গে তারা বিদায়ী সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। আজ সোমবার সন্ধ্যায় আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশন ভবনে বিদায় অনুষ্ঠান করবেন ইসি সচিবালয়ের কর্মকর্তারা।
সিইসি আজ সকাল ১১টায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন করবেন। তবে তিনি গতকাল রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে নির্বাচন কমিশনের এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে নিরপেক্ষ ও সফলতার সঙ্গে পুরো পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালন করেছেন বলে দাবি করেন।
তিনি বলেন, আইনের মধ্যে থেকে তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছেন। কমিশনের সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে নিজের মূল্যায়ন জানতে চাইলে সিইসি বলেন, সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছে কমিশন। কারও কথায় নয়, আইনের শাসনের মধ্যে থাকার চেষ্টা ছিল তাদের। আর একটা পদের জন্য নির্বাচন করেন সাতজন, পাস করেন একজন। তাই সমালোচনা তো হবেই।
সিইসি আরও বলেন, কমিশন সাফল্যের সঙ্গেই কাজ করেছে। সবগুলো নির্বাচন শেষ করতে পেরেছে। একটা নির্বাচনও বাকি নেই।
সব নির্বাচন সুষ্ঠু ছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সব সুষ্ঠু হয়েছে, তা নয়। মারামারি হয়েছে। কোথাও ব্যালট ছিনতাই হয়েছে। আবার ধরাও পড়েছে। নির্বাচন বন্ধ হয়েছে। আবার নির্বাচন হয়েছে। সুতরাং সব নির্বাচন পরিপূর্ণ সুষ্ঠু হয়েছে বলা যাবে না।
তবে গণমাধ্যমই বলেছে- শান্তিপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হচ্ছে।
শীতের দিনে, রোদের মধ্যে, নারী-পুরুষ লাইন দিয়ে ভোট দিচ্ছে। ইভিএমে ৭০ শতাংশ ভোট দিচ্ছে। এর চেয়ে সফল নির্বাচন আর কী হতে পারে।
এদিকে সংবিধানের নির্দেশনা মোতাবেক ইসির মেয়াদ পাঁচ বছর। সে হিসেবে আজ বর্তমান ইসির শেষ দিন। নতুন ইসি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। ইসি নিয়োগ আইনানুযায়ী, নতুন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নাম সুপারিশ করার জন্য প্রাসঙ্গিক কাজ গুছিয়ে আনছেন।
এদিকে সংবিধানের নির্দেশনা মোতাবেক নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ পাঁচ বছর। সে হিসেবে আজ বর্তমান কমিশনের শেষ দিন। তবে নতুন ইসি গঠন প্রক্রিয়া চলছে।
ইসি নিয়োগ আইনানুযায়ী, নতুন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সার্চ কমিটি গঠিত হয়েছে। এই কমিটি রাষ্ট্রপতির কাছে ১০ জনের নাম সুপারিশ করার কার্যক্রম গুছিয়ে আনছে। এই ১০ জনের তালিকা থেকেই সিইসিসহ নতুন কমিশনের পাঁচজনকে নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি।
সার্চ কমিটি গঠনের পর থেকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে এই নাম পাঠাতে হবে। সেই হিসেবে নাম সুপারিশের জন্য আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় পাচ্ছে কমিটি।
তবে সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, দু-এক দিনের মধ্যেই নতুন ইসি শপথ নিতে পারে। সার্চ কমিটির কাজ শুরুর দিনেই মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছিলেন, ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় থাকলেও সার্চ কমিটি আগেই কাজ শেষ করবে।
এদিকে বিদায়ী কমিশন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পেরেছে বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
তিনি গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, মেয়াদ শেষ হলেও আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনের পদে কোনো শূন্যতা হবে না।
সংবিধান বা আইনে শূন্য থাকতে পারবে না- এরকম কোনো কথা নেই। নতুন ইসি গঠনে একটু বিলম্ব হলে তা আইনে শূন্যতা হিসেবে গণ্য হবে না। তবে নতুন ইসি গঠন ও দায়িত্ব নেওয়ার আগ পর্যন্ত বর্তমান কমিশনের দায়িত্ব চালিয়ে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সংবিধানে তাদের কাজের মেয়াদ পাঁচ বছর সুনির্দিষ্ট করা আছে। এর বেশি সময় তাদের পদে থাকার সুযোগ নেই। এ সময়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় প্রশাসনিক দায়িত্ব চালিয়ে যাবে। নতুন ইসি দায়িত্ব নেওয়ার পর নতুন কোনো নির্বাচনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারবে।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ : ভবিষ্যতের সব নির্বাচন আরও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ। তিনি গতকাল সন্ধ্যায় সিইসি কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, মো. রফিকুল ইসলাম ও কবিতা খানম বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে গেলে রাষ্ট্রপতি এ আশা ব্যক্ত করেন।
পরে রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন গণমাধ্যমকে বলেন, সাক্ষাৎকালে নির্বাচনী কার্যক্রমসহ কমিশনের বিভিন্ন কার্যক্রম ও উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা হয়। তারা দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতির সহযোগিতা ও দিকনির্দেশনার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান।
এ সময় রাষ্ট্রপতিকে 'বীর মুক্তিযোদ্ধা' সংবলিত জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদান করা হয় এবং সিইসির পক্ষ থেকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ ও জাতীয় সংসদের নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ আইন-২০২১-এর বাংলা পাঠ হস্তান্তর করা হয়।
প্রেস সচিব জানান, রাষ্ট্রপতি বলেন, নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশন মুখ্য ভূমিকা পালন করে। একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক দল ও জনগণের সহযোগিতা অপরিহার্য।
তাই নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগ, রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণের সহযোগিতা নিয়ে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করেন, ভবিষ্যতে সব রাজনৈতিক দল ও জনগণের সহযোগিতায় নির্বাচন কমিশন স্থানীয় পর্যায়সহ সব নির্বাচন আরও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যভাবে অনুষ্ঠানে সক্ষম হবে।
এ সময় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব সম্পদ বড়ূয়া, সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম সালাহ উদ্দিন ইসলাম, রাষ্ট্রপতির প্রেস সচিব মো. জয়নাল আবেদীন, সচিব (সংযুক্ত) মো. ওয়াহিদুল ইসলাম খান এবং নির্বাচন কমিশনের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার উপস্থিত ছিলেন।
সোনালীনিউজ/এমটিআই