ঢাকা : ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বেড়ে চলা খাদ্য সংকট বিশ্বকে ‘মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ফেলে দিয়েছে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, এই যুদ্ধ চলতে থাকলে খাদ্য পণ্যের দাম রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে এবং তা লাখ লাখ মানুষকে অপুষ্টি ও দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ডেভিড ম্যালপাস বলেন ‘এটা মানবিক বিপর্যয়, অর্থাৎ পুষ্টি কমে যাচ্ছে। আবার একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারের জন্য এটা রাজনৈতিক সংকটও সৃষ্টি করছে। যারা এই সংকট মোকাবিলায় কিছুই করতে পারছে না। এর জন্য দায়ী তারা নয়, অথচ তারা দেখছে দাম বেড়েই চলেছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্ব ব্যাংকের বৈঠকের কর্মসূচির মধ্যেই বিবিসিকে এই সাক্ষাৎকার দেন ডেভিড ম্যালপাস।
বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে খাদ্য পণ্যের দামে ‘বড়’ ধরনের উল্লম্ফন হতে পারে (৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি), যা গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য ‘অনেক বেশি’ মনে করেন ম্যালপাস।
তিনি বলেন, ‘তারা নিজেরা কম খেতে এবং সন্তানকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করতে বাধ্য হবে খরচ কমানোর জন্য। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, এটা সত্যিকারের একটা অন্যায্য সংকট। এটা দরিদ্রদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করবে। করোনা মহামারিতেও এই বাস্তবতাই দেখা গেছে।’
বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেন, পণ্যের দাম বৃদ্ধির পরিসর বিস্তৃত এবং গভীর। ভোজ্য তেল, দানাদার শস্য, অন্যান্য খাদ্যশস্যের দামও ক্রমাগত বাড়ছে। ভুট্টার মতো খাদ্য পণ্যের দামেও প্রভাব পড়ছে, কারণ গমের দাম বাড়লে এসব পণ্যের দামও বেড়ে যায়।
‘পৃথিবীর সবাইকে প্রতিদিন খাওয়ানোর মতো পর্যাপ্ত খাবার এখন আমাদের রয়েছে, বৈশ্বিক খাদ্য মজুতও এখন ঐতিহাসিক মানের বিচারে বড়। কিন্তু এই খাদ্য পণ্য বাটোয়ারা বা বিক্রির একটি প্রক্রিয়া থাকতে হবে, যাতে যেখানে খাদ্যের দরকার, সেখানে তা পৌঁছানো সম্ভব হয়।’
খাদ্য উৎপাদনে ভর্তুকি দেওয়া বা দাম বেঁধে দেওয়ার পদক্ষেপকে নিরুৎসাহিত করছেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট। বরং তার পরামর্শ, বিশ্বজুড়ে সার ও খাদ্যসামগ্রীর সরবরাহ বাড়াতে মনোযোগ দিতে হবে। আর হতদরিদ্র মানুষের জন্য বিশেষ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
‘একটি সংকটের মধ্যে থেকে আরেকটি সংকটের জন্ম’ নেওয়ার যে ঝুঁকি, সে বিষয়েও সতর্ক করেছেন ডেভিড ম্যালপাস। মহামারির সময়ে উন্নয়নশীল অনেক দেশের ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেছে, অনেক কিস্তি জমে গেছে। এখন খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দামের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে বিদেশি মুদ্রার সংকটে পড়ে কিস্তি পরিশোধে সমস্যায় পড়ছে অনেক দেশ। এরকম সংকটে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ভেঙে পড়ার দশা হয়েছে।
ম্যালপাস বলেন, এই আশঙ্কা খুবই বাস্তব। কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটতে শুরু করেছে, আমরা জানি না এটা কতদূর গড়াতে পারে। দরিদ্র দেশগুলোর ৬০ শতাংশই হয় ঋণের নিচে চাপা পড়ছে, অথবা চাপা পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছ।
‘ঋণ সংকট নিয়ে আমাদের শঙ্কিত হওয়ার কারণ আছে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি আগে-ভাগেই পদক্ষেপ নেওয়া যায়। কীভাবে দেশগুলোর ঋণের বোঝা কমিয়ে আনা যায় এই অস্থিরতা দূর করতে আপনি যতো দেরি করবেন, ততই পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাবে।’
এ মাসের শুরুতে জাতিসংঘ জানিয়েছে, ইউক্রেইনে যুদ্ধের কারণে মার্চে বিশ্বে খাদ্যের দামের বৃদ্ধিতে রেকর্ড হয়েছে। সূর্যমুখী তেলের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, বিকল্প উৎসগুলোর খরচ বেড়ে গেছে। গম ও ভুট্টার মতো পণ্যেরও অন্যতম উৎপাদনকারী দেশ ইউক্রেইন। এই যুদ্ধের কারণে ওই দুই পণ্যের দামও বেড়েছে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল যুদ্ধের আওতায় থাকায় ভেজিটেবল অয়েল ও খাদ্যশস্যের বিশ্ব বাজারে বড় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
জাতিসংঘের খাদ্য মূল্য সূচক বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কেনাবেচা করা ভোগ্য পণ্যের দরের ওঠানামা পর্যবেক্ষণ করে। এসব পণ্যের মধ্যে আছে- শস্য, ভেজিটেবল অয়েল, দুগ্ধজাত পণ্য, মাংস ও চিনি।
৬০ বছর আগে শুরু হওয়া এই সূচকের হিসাব বলছে, এ বছরের ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে প্রায় ১৩ শতাংশ দাম বেড়েছে এসব পণ্যের, যা ইতিহাসের সর্বোচ্চ।
সোনালীনিউজ/এমটিআই