ঢাকা : ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে রাজধানী ছাড়তে শুরু করেছে মানুষ। স্বজনদের সঙ্গে প্রতি বছরের মতো এবারও সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল ভোগান্তি ছাড়াই বাড়ি ফেরা নিয়ে। কিন্তু গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকে দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে।
তাই এবার বেশির ভাগ মানুষ স্বপ্নের পদ্মা সেতু দেখার জন্য বাসে করে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিয়েছেন। এ কারণে লঞ্চ ও ট্রেনে যাত্রীদের চাপ কম বলে জানা গেছে।
বৃহস্পতিবার (৭ জুলাই) বিকেল থেকে যাত্রীচাপ আরও বাড়বে বলে মনে করছেন বাস ও ট্রেন সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে বারবার আশ্বাস দেয়া হয়, সমস্যা দূর করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সড়ক, নৌ ও রেলমন্ত্রীরা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বলে আসছিলেন, এবারের ঈদ উপলক্ষে সর্বকালের রেকর্ড প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। যাত্রাপথে কোনো ভোগান্তি হবে না। তাই হচ্ছে বলে গতকাল বুধবার পর্যন্ত জানা গেছে।
নৌ-সড়ক ও রেলপথে তেমন কোনো ভোগান্তি ছাড়াই গন্তব্যে পৌঁছেছেন বেশিরভাগ মানুষ। প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেয়েছেন হাসিমুখে। এর মধ্য দিয়ে অনেকটাই এখন রাজধানী ফাঁকা যানজটের নগরীতে রূপ পাচ্ছে। ১০ জুলাই ঈদ ধরে ছুটি শুরু হবে আজ বৃহস্পতিবার শেষে। তাই বৃহস্পতিবার বিকেলের পর থেকে সড়ক ও নৌপথে কিছুটা যাত্রীচাপ বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। তবে চাপ সামাল দিতে প্রস্তুতি আছে নৌযান মালিকসহ পরিবহন সংশ্লিষ্টদের।
ঈদযাত্রার দ্বিতীয় দিনে ট্রেনেও স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরছে মানুষ। বাড়ি ফিরতে খুব বেশি ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না ঘরমুখো মানুষদের। এখন পর্যন্ত স্বস্তিদায়ক রয়েছে ঈদযাত্রা। গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশনে দেখা যায় মানুষ দলে দলে স্টেশনে প্রবেশ করছে। যার যার ট্রেনের জন্য প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছে। যাত্রীরা বলছেন, এখন পর্যন্ত বাড়ি ফিরতে তাদের কোনো ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে না।
রংপুর এক্সপ্রেসে যাওয়ার জন্য অপেক্ষারত জায়েদ নামে এক যাত্রী জানান, ঈদযাত্রায় ঝামেলায় যেন না পড়তে হয়, একটু আগেভাগেই বাড়িতে যাচ্ছি। আরেক যাত্রী জানান, অনেক কষ্টে টিকিট সংগ্রহ করেছি। এবার ভালোভাবে যেতে পারলে হয়। এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ঝামেলা হচ্ছে না।
গতকাল সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ৫১টি ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন ছেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারোয়ার। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত ট্রেনের তেমন কোনো শিডিউল বিপর্যয় ঘটেনি। দুএকটা ট্রেন এক দেড় ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে গেছে। তবে এটাকে শিডিউল বিপর্যয় বলা যাবে না।
এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে যাত্রীদের সুবিধার্থে ৬ জোড়া বিশেষ ট্রেন পরিচালনা করা হবে। সেগুলো হলো- দেওয়ানগঞ্জ স্পেশাল, চাঁদপুর স্পেশাল ১, ২, বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম (পঞ্চগড়) ঈদ স্পেশাল, শোলাকিয়া স্পেশাল ১, ২।
এছাড়া গতকাল থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত ঢাকামুখী একতা, দ্রুতযান, পঞ্চগড়, নীলসাগর, কুড়িগ্রাম, লালমনি ও রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোর বিমানবন্দর স্টেশনে যাত্রাবিরতি থাকবে না। ৬ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত মিতালি এক্সপ্রেস এবং আজ বৃহস্পতিবার থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত মৈত্রী এক্সপ্রেস ও বন্ধন এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল করবে না। দূরপাল্লায় বাসে ঈদযাত্রার প্রথম দিনই বৃষ্টি বিড়ম্বনা ও যানজটের কবলে পড়েছেন ঘরমুখী যাত্রীরা। তারপরও হাসিমুখে বাড়ি যাচ্ছেন তারা। এবার পদ্মা সেতু চালুর ফলে কাউন্টারগুলোতে যাত্রী চাপ বেড়েছে আগের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বলে জানান কাউন্টার মাস্টাররা।
তবে বৃষ্টিস্নাত প্রথম দিনে বাসযাত্রায় পড়তে হয় দুর্ভোগে। যানজট ঠেলে কাউন্টারে এসে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তবু স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে যাওয়ার আনন্দের কাছে কোনো ভোগান্তিকেই পাত্তা দিচ্ছেন না যাত্রীরা।
কমলাপুর রেল স্টেশনের ব্যবস্থাপক মাসুদ সারওয়ার জানিয়েছেন, ট্রেনগুলো যেন সময়মতো স্টেশন ছেড়ে যায় সেজন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া আছে। শিডিউল বিপর্যয় ঠেকাতে বিমানবন্দর স্টেশনে ঢাকামুখী কয়েকটি ট্রেনের যাত্রাবিরতি বাতিল করা হয়েছে।
তিনি বলেন, গতকাল থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত উত্তরাঞ্চল থেকে ছেড়ে আসা ৭টি ট্রেন বিমানবন্দর স্টেশনে না থামানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ঢাকামুখী একতা, দ্রুতযান, পঞ্চগড়, নীলসাগর, কুড়িগ্রাম, লালমনি ও রংপুর এক্সপ্রেস বিমানবন্দর স্টেশনে থামবে না। তবে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া ট্রেনগুলো বিমানবন্দর স্টেশনে যথারীতি থামবে।
এদিকে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) নৌনিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উদ্যোগে যাত্রী সেবা নিশ্চিতকরণ, নৌরুট ব্যবস্থাপনা নৌযান পুনর্বিন্যাস, কো-অর্ডিনেশনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হওয়ায় আসন্ন ঈদে ঘরমুখো মানুষ নৌপথে সুষ্ঠু ও নিশ্চিতভাবে চলাচলের আশা প্রকাশ করছেন। বর্তমানে সারাদেশে ১০৭টি নৌপথের মধ্যে ৪৩টি পথ ঢাকার সদরঘাট থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের সংযোগকারী। এই ৪৩টি নৌরুটে চলাচলকারী লঞ্চের সংখ্যা প্রায় দুইশ। আর শিমুলিয়া থেকে মাঝিরকান্দি ও বাংলাবাজারে চলাচল করে ৮৭টি লঞ্চ।
লঞ্চ মালিকরা বলেছেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর শিমুলিয়া (মাওয়া) থেকে বাংলাবাজার ও মাঝিরকান্দি রুটে সরাসরি প্রভাব পড়লেও সার্বিকভাবে দেশের লঞ্চ ব্যবসায় তেমন প্রভাব পড়বে না। জরুরি প্রয়োজনে অনেকেই হয়তো সড়কপথে গন্তব্যে যাবেন, কিন্তু স্বস্তির যাত্রা খুঁজবেন নৌপথেই। সেই আত্মবিশ্বাস থেকে এখনো নতুন নতুন লঞ্চ নির্মাণও করছেন লঞ্চ মালিকরা।
আর সদরঘাটের যাত্রীরা বলছেন, শুরুতে পদ্মা সেতুর দেখার জন্য তারা দু-একবার সড়কপথে বাড়ি যাতায়াত করতে চান। তবে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য লঞ্চকেই বেছে নেবেন বলে আশা প্রকাশ করছেন যাত্রীরা।
সদরঘাট থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, ভোলা, শরীয়তপুর, মাদারীপুর ও চাঁদপুরে চলাচলকারী লঞ্চে যাত্রী পেতে বেগ পেতে হবে বলে মনে করছেন না লঞ্চ ব্যবসায়ীরা। তবে শুরুতে কিছুটা প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করছেন তারা। তবে পরে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ইতোমধ্যে গতকাল থেকে বিপুল সংখ্যক যাত্রী ট্রেনে করে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। আগামীকাল শুক্র ও শনিবার দুদিন ছুটির দিনে সড়ক এবং নৌপথেও ঘরে ফেরা মানুষের চাপ লক্ষ করা যেতে পারে। কিন্তু কোনো মহাসড়কেই যানজট হয়নি। বরং চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে এখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। অথচ ঢাকা-চট্টগ্রাম ফোর লেন প্রকল্পটি যানজটের বিষফোঁড়া হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এক সপ্তাহ আগে এই সড়কে খুলে দেয়া হয়েছে চার লেনের তিনটি সেতু। একদিনের মধ্যেই মহাসড়কে মহাভোগান্তি সিকেয় উঠেছে।
ঢাকা-সিলেট রুটেও কোনো ভোগান্তি নেই। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ফোর লেন প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। তাছাড়া সড়কের সংস্কার কাজ পুরোপুরি না হওয়ারও অভিযোগ আছে। কিন্তু যাত্রাপথে কোনো সমস্যা এখনো হয়নি। সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়ি ফিরছেন। আব্দুল্লাপুর থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত বাস র্যাপিট ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের নির্মাণকাজ হওয়া, সড়কে নানা সমস্যার কারণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভোগান্তি হতে পারে এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সংকট সমাধানে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। মোতায়েন করা হয় ৩০০ স্বেচ্ছাসেবক। পুলিশের পক্ষ থেকেই এই সড়কে নেওয়া হয় বিশেষ ব্যবস্থা। সব মিলিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহের যাত্রীরাও নিরাপদে ঘরে ফিরছেন।
এ বিষয়ে প্রবীণ শ্রমিক নেতা আলী রেজা বলেন, অন্যান্য সময়ের চেয়ে এবারের সড়ক, নৌ ও রেলপথে স্বাচ্ছন্দ্যে যাত্রীরা বাড়ি ফিরছেন। ভোগান্তি না হওয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষ সরকারের কাছ থেকে তেমন কিছু চায় না। তারা চায় বাড়ি ফিরতে যেন ভোগান্তি না হয়। এজন্য যতটুকু ব্যবস্থা নেয়ার দরকার তা যেন নিশ্চিত করা হয়।
এবার সড়কের পরিস্থিতি অনেক ভালো বলে দাবি করেছেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি জানান, আশা করি ঈদযাত্রায় কোনো সমস্যা হবে না। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের অবস্থাও আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে বলে জানান তিনি। এখন পর্যন্ত কোনো মহাসড়কে ভোগান্তি হয়েছে তেমন খবর আসেনি। আশা করি আগামী দিনগুলোতেও কোনো সমস্যা হবে না।
নৌ-সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি বলছে, এবারের ঈদযাত্রায় ঢাকা, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের চারটি সিটি করপোরেশনসহ এ তিন জেলা ছেড়ে যাচ্ছে এক কোটি ৪৭ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও জেলার অন্যান্য স্থান থেকে যাবে এক কোটি ১০ লাখ মানুষ। গাজীপুর থেকে যাবে ২৫ লাখ ৫০ হাজার মানুষ। আর ১১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ যাবে নারায়ণগঞ্জ থেকে। এই বিপুলসংখ্যক ঘরমুখো যাত্রীর ৫৫ শতাংশ সড়কপথে ও ২৫ শতাংশ নৌপথে যাবে। বাকি ২০ শতাংশ যাবে রেলপথে। ঈদ উপলক্ষে নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির ঈদ-পূর্ব বার্ষিক প্রতিবেদনে এ পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি ঈদে আনুমানিক ৫০ শতাংশ মানুষ ঢাকা মহানগরী ছেড়ে যায়। গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ শহর ছাড়ে ৩০ শতাংশ মানুষ। এই হিসেবে এবার ঈদে এক কোটি মানুষ ঢাকা শহর ছাড়ছে আর গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ শহর ছাড়ছে যথাক্রমে ১৯ লাখ ৫০ হাজার ও ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ।
এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ, ঢাকা উত্তর, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ-চারটি সিটি করপোরেশনের বাইরে এ তিন জেলার অন্যান্য স্থান থেকে আরও ২০ লাখ মানুষ ঈদে ঘরমুখী হয়। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকার ১০ লাখ, গাজীপুরের ৬ লাখ ও নারায়ণগঞ্জের ৪ লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে তিন জেলার এক কোটি ৪৭ লাখ (প্রায় দেড় কোটি) মানুষ এবার ঈদযাত্রায় শামিল হচ্ছে।
সোনালীনিউজ/এমএএইচ