লোডশেডিংয়ে বিপর্যস্ত গ্রামগঞ্জ

  • নিউজ ডেস্ক | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: জুলাই ২৫, ২০২২, ০২:০২ পিএম
লোডশেডিংয়ের কারণে রাজধানীতে বাড়ছে মোমবাতির চাহিদা। তাই মোমবাতি তৈরিতে ব্যস্ত কেরানীগঞ্জের কারিগররা

ঢাকা : জ্বালানি সংকটের কারণে সপ্তাহখানেক ধরে সারা দেশে এলাকাভিত্তিক চলছে লোডশেডিং। কিন্তু গ্রাম এলাকায় পল্লী বিদ্যুতের মাধ্যমে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, সারা বছর এমনিতেই তা নিরবচ্ছিন্ন থাকে না। আর ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরু করার পর গ্রামে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। শহর এলাকায় রাতে লোডশেডিং কম করার চেষ্টা হলেও গ্রামে রাতে বেশি বিদ্যুৎ যাচ্ছে।

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, গত বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত শহরের নগুয়া এলাকায় বিদ্যুৎ গেছে একবার, সেটি মিনিট দুয়েকের জন্য। অন্যদিকে সেখান থেকে কিলোমিটার সাতেক দূরে রহিমপুর গ্রামে শুক্রবার রাত ১১টায় বিদ্যুৎ যায়, আসে রাত ৩টায়। নগুয়া এলাকাটি কিশোরগঞ্জ শহরের এক প্রান্তে। সেখানে বিদ্যুতের এই ভালো অবস্থা জেলা সদরের মানুষের কাছে বিরল নয় মোটেও।

একযুগ আগে দেশে বিদ্যুতের যখন অসহনীয় পরিস্থিতি তখনও কিশোরগঞ্জ শহরের পরিস্থিতি খারাপ ছিল না অতটা। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ার পর সেটির উন্নতি হয় আরো বেশি। রহিমপুর গ্রামের বাসিন্দা হাফিজ উদ্দিন বলেন, দিনের বেলায় যেমন তেমন, রাতের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। যখন তখন কারেন্ট যায়। আর এবার শ্রাবণ মাসেও বৃষ্টি নাই, গ্রামে এত গরম পড়বে, সেটি কল্পনায়ও ছিল না।

কিশোরগঞ্জ শহরের মতো দেশের সব জেলা সদরে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি অতটা ভালো নয়। তবে কিশোরগঞ্জে শহর ও গ্রামে যে ব্যবধান, সেটি সব জেলাতেই। শহরে লোডশেডিং যতটা করা হচ্ছে, গ্রামে করা হচ্ছে বহুগুণ। কুমিল্লা প্রতিনিধির কাছে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একজন কর্মকর্তা জানান, আমাদের অধীন উপজেলাগুলোতে প্রতিদিন মুহূর্তে গড়ে ৭ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা থাকলেও দিনের বেলা মাত্র তিন মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাপ্লাই দিতে পারছি। এক মাস ধরে দিনে তিন থেকে চার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকছেই।

কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা বিভিন্ন গ্রামের মধ্যে শিমপুর, কালিরবাজার, জগন্নাথপুর এলাকার বেশ কয়েকজন বাসিন্দা জানান, রাত ৮টা বাজলেই লোডশেডিং শুরু হয়। এক ঘণ্টা পর বিদ্যুৎ আসে। রাত ১২টায় আবার যায়, এরপর ভোরে আরেকবার। গত চার-পাঁচ দিন ধরে এভাবেই চলছে।

কুমিল্লা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির তথ্য বলছে, জেলার চার সমিতির অন্তর্ভুক্ত উপজেলাগুলোয় দিনে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা আছে। নিয়মিত ১০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। প্রয়োজনের তুলনায় গড়ে ২০ শতাংশ কম বিদ্যুৎ পান গ্রামাঞ্চলের লোকজন।

কুমিল্লা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেন প্রামাণিকের দাবি অবশ্য ভিন্ন। তিনি বলেন, অনেক সময় ফিডারের সমস্যার কারণে তা মেরামত করতে হয়। ওই সময় প্রয়োজনেই লোডশেডিং করা লাগে। কুমিল্লায় বেঁধে দেওয়া সময়ের বাইরে লোডশেডিং হয় না।

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি জানান, এ জেলার গ্রাম এলাকায় দিন-রাত মিলিয়ে লোডশেডিং হচ্ছে ৮ থেকে ১০ বার। ঘণ্টার হিসেবে বিদ্যুৎহীন সময় কাটাতে হচ্ছে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। জেলার পাঁচ উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। পিক আউয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ৯৭ মেগাওয়াট। কিন্তু অধিকাংশ সময়ে সরবরাহ অনেক কম।

লক্ষ্মীপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মহাব্যবস্থাপক জাকির হোসেন বলেন, রাত-দিন মিলে ৪-৫ বার লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে কোনো কিছু করার নাই। ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ হাবিবুর রহমান সবুজ বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে শিক্ষার্থীরা হাঁপিয়ে উঠেছে। পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারছে না। দ্রুত এ সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।

জেলা বণিক ও দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকার এলাকাভিত্তিক যে সময় দিয়েছে, সেটা কার্যকর হচ্ছে না। যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্যের কী হবে জানি না।

মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, জেলা ও উপজেলা সদরে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লোডশেডিং হলেও এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ বন্ধ থাকছে।  দৌলতপুরের জিয়াউল হক বলেন, আগে তো কারেন্ট কম যাইত। কিন্তু সরকারের ঘোষণার পর থেকে কারেন্ট বেশি যায়। বুধবার রাতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা কারেন্ট ছিল। এরপর সকাল থেকে আসা-যাওয়ার মধ্যেই আছে। বর্তমানে এমন অবস্থা হইছে, যে আমাদের এলাকায় টানা এক ঘণ্টাও কারেন্ট থাকে না।

সাটুরিয়ার আবু বকর সিদ্দিক বলেন, দিনের বেলায় একটু কম যায়। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং দেয়। তা ছাড়া রাতে একবার কারেন্ট গেলে সারা রাতে আসার খবর থাকে না। এখন তো মনে হইতেছে সরকারের ঘোষণার আগেই আমরা ভালো ছিলাম।

সিংগাইরের রিয়াজুল ইসলাম বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ৭ ঘণ্টাও আমরা কারেন্ট পাই না। সরকার যে ঘোষণা দিছে, তার চেয়ে দুই ঘণ্টা বেশি বিদ্যুৎ না থাকলেও সমস্যা কম হবে। কিন্তু বর্তমানের অবস্থায় আমরা সবাই খুব বিরক্ত হইতেছি।

মানিকগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মো. আব্দুর রশিদ মৃধা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি এক ঘণ্টার মধ্যে থাকতে। কিন্তু নানা কারণে পারছি না। তাছাড়া শহর ও শিল্প কারখানাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।

মেহেরপুর প্রতিনিধি জানান, জেলায় ২৪ ঘণ্টায় যে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা লোডশেডিং হয়, তার বেশিরভাগই রাতে হয় বলে জানাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। গরমে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছেন অনেকে। পরিস্থিতি এতটাই শোচনীয় যে, অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জেও সমস্যা হচ্ছে।

ব‍্যাটারিচালিত ভ‍্যানচালক সবুজ বলেন, আমাদের ভ‍্যান চার্জ হতে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগে। অথচ গত রাতে বিদ্যুৎই ছিল তিন ঘণ্টা। গাড়িতে চার্জ না থাকলে ভাড়া মারব কীভাবে। মোবাইল মেরামতকারী দোকানি মো. মামুন বলেন, এক সপ্তাহ আগে যারা মোবাইল সারাতে দিয়ে গেছে, তাদের কাজ এখনো শেষ করতে পারিনি। সারা দিনে বিদ্যুৎ পাচ্ছি তিন থেকে চার ঘণ্টা। আবার রাতের অবস্থা আরো খারাপ।

মেহেরপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জেনারেল ম‍্যানেজার মোহাম্মদ আবু রাহান জানান, জেলায় পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ১১৬ মেগাওয়াট। অফপিক আওয়ারে চাহিদা ৭০ মেগাওয়াট। বতর্মানে তারা পাচ্ছেন অর্ধেকেরও কম।

নীলফামারী প্রতিনিধি জানান, চাহিদার অর্ধেক পাচ্ছেন নীলফামারীর সাড়ে চার লাখ গ্রাহক। ফলে ২৪ ঘণ্টার অর্ধেক সময়ই থাকতে হচ্ছে বিদ্যুৎহীন। এই গ্রাহকের মধ্যে নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড বা নেসকোর গ্রাহক এক লাখ ৩৬ হাজার এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ৩ লাখ ১৬ হাজার।

নীলফামারী জেলা শহরের প্রগতি পাড়া এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আহমেদ আজিজ শুভ বলেন, শুনেছি এক ঘণ্টা করে বিদ্যুৎ থাকবে না। কিন্তু চিত্র পুরোটাই আলাদা। কয়েক দফায় লোডশেডিং হয়েছে এবং বিদ্যুৎ থাকছে না। আমার ব্যবসা বিদ্যুৎনির্ভর। এভাবে চলতে থাকলে নিঃস্ব হতে হবে।

পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি নীলফামারীর মহাব্যবস্থাপক সুলতান নাছিমুল হক জানান, তাদের ৬৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হলেও পাওয়া যাচ্ছে ৪০ মেগাওয়াট।

নোয়াখালী প্রতিনিধি জানান, লোডশেডিংয়ের ‘শিডিউল বিপর্যয়ের’ পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতের নোখাখালীর কর্মকর্তারা সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে পারছেন না। মাইজদী হাউজিং এস্টেট এলাকার ফয়জুল ইসলাম বলেন, দিনে রাতে একাধিক বার লোডশেডিং হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চলে যায়। জেলার সব এলাকায় একইভাবে লোডশেডিং করা হচ্ছে।

নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুতের জেনারেল ম্যানেজার জাকির হোসেন বলেন, জেলায় ১৫৫ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে পাওয়া যাচ্ছে ১০০ মেগাওয়াট। ফলে সিডিউল অনুযায়ী লোডশেডিং দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে ও মাইকিং করে জনগণকে সচেতন করার কার্যক্রম চলছে।

রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানান, সাপছড়ি ইউনিয়নের ঘোষণা দিয়ে লোডশেডিং শুরুর দিন মঙ্গলবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কমপক্ষে ৮-৯ বার লোডশেডিং হয়েছে। কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া এলাকার এক স্থানীয় সুমন চাকমা বলেন, হুট করে লোডশেডিং হয় আবার ৩-৪ মিনিট পর বিদ্যুৎ চলে আসে। আবার অনেক সময় একবার বিদ্যুৎ গেলে প্রায় দেড় ঘণ্টার অধিক সময় লাগে বিদ্যুৎ আসতে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের রাঙ্গামাটি বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকোশলী মো. জালাল উদ্দীন বলেন, সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক লোডশেডিং শুরু হয়েছে। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে প্রথম প্রথম একটু হিমশিম হতে পারে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে।

সোনালীনিউজ/এমটিআই