ঢাকা : ঢাকা বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্পের কাজের সময় ব্যস্ততম এ সড়কে নিরাপত্তার অবহেলার বিষয়টি আগে ধরা পড়লেও সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে চিঠি দিয়েই দায়িত্ব সেরেছে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি ও প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান।
আর আলোচিত এ উড়াল সড়ক নির্মাণের বড় অংশের কাজের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি) নিরাপত্তাবিষয়ক চিঠি এবং প্রকল্প পর্যালোচনার সভায় দেওয়া পরামর্শকে আমলেই নেয়নি; কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি নির্মাণ এলাকায়।
এ কারণে ব্যস্ততম ঢাকা-ময়মনসিংহ রোডে নির্মাণাধীন এ উড়াল সড়কের প্রকল্প এলাকার যান ও জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগ করেছে প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএমইসি ইন্টারন্যাশনাল প্রোপাইটারি লিমিটেড অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। গত ২৫ জুলাই এক চিঠিতে এ বিষয়ে সতর্ক করে তারা।
চিঠিতে অভিযোগ করা হয়, নিরাপত্তা নিয়ে একাধিকবার নির্দেশনা ও উপদেশ দেওয়ার পরও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এসব নির্দেশনা প্রতিপালন করা না হলে জনগণের নিরাপত্তার জন্য তা প্রকল্পের ‘কাজ বন্ধের নির্দেশনার’ মত সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
তবে নির্মাণকাজের সময় নিরাপত্তায় ঘাটতির বিষয়টি সামনে এলেও প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় এবং ঢাকা বিআরটি কোম্পানির পক্ষ থেকে জোরালো পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ যেমন ওঠে, তেমনি এ বিষয়ে তাদের ‘নিষ্ক্রিয়তা’ নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।
বুধবার (১৭ আগস্ট) এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য জানতে প্রকল্প পরিচালক মো. মহিরুল ইসলাম খানকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
আর নিরাপত্তায় যথাযথ ব্যবস্থা না নেওয়া কিংবা কাজ বন্ধ না হওয়ার বিষয়ে ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানির (ঢাকা বিআরটি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ইসলাম সরাসরি কোনো উত্তর দেননি।
তিনি বলেন, কাজ চলাকালীন পুরো প্রকল্প এলাকায় প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয়ের লোকজন পরিদর্শনে যান। কিন্তু পুরো বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের। এজন্য তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
সুপারিভিশন একটা বিশাল কাজ। এজন্যই কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়।
তবে ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে নিরাপত্তা গ্রহণে চিঠি দেয়া হয় বলে দাবি করেন।
আর সোমবার ভয়াবহ এ দুর্ঘটনায় প্রাণহানির পর বিকালে ঢাকা বিআরটির পরিচালক ও সওজের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের সময় নিরাপত্তায় অভাব থাকার কথা জানিয়েছিলেন।
‘নিরাপত্তার অভাবের’ বিষয়টি তারা ঠিকাদারকে প্রায়ই বলেছেন বলেও তিনি দাবি করেন।
তার ভাষ্য, তাদের যে সেইফটির অভাব আছে তা আমি সেদিনও মিটিংয়ে বলেছি। মন্ত্রণালয়ে আমাদের একটা রিভিউ মিটিং হয়েছে যেখানে এডিবির প্রতিনিধিও ছিলেন। সেখানে সেইফটি অডিট করার জন্য আমি মিটিংয়ে বলেছি। এটা নিয়ে গতকালও একটা মিটিং হয়েছে।
গত সোমবার ঢাকার উত্তরায় জসীম উদ্দীন সড়কের মাথায় প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনের ক্রেন দিয়ে একটি গার্ডার তোলার সময় তা একটি প্রাইভেট কারের উপর আড়লে পড়লে একই পরিবারের পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহত হন গাড়িতে থাকা আরও দুজন।
ওই ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশনের (সিজিজিসি) গাফিলতি পাওয়ার কথা মঙ্গলবার জানিয়েছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের গঠিত তদন্ত কমিটি।
এদিকে বুধবার হাই কোর্ট উন্নয়ন প্রকল্প এলাকায় গত ৫ বছর ধরে জনগণের নিরাপত্তায় বিআরটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন ৬০ দিনের মধ্যে দিতে নির্দেশ দিয়েছে।
দুর্ঘটনার সময় ক্রেইন দিয়ে বিশাল আকারের ক্রংক্রিটের গার্ডারটি ট্রেইলারে তোলার সময় তা উপরে ঝুলে থাকা অবস্থাতেও এর নিচ দিয়ে গাড়ি চলাচল করে। এরই একপর্যায়ে ক্রেইনটি ভারসাম্য হারিয়ে কাত হয়ে গেলে গার্ডারটি একটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে যায়।
ওই দুর্ঘটনার একাধিক ভিডিওতে ওই সময় কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনীও চোখে পড়েনি। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নিহতের স্বজনরা।
নিরাপত্তার অভাব, সতর্ক করে পরামর্শকের চিঠি : ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কে যান চলাচল সহজ করতে ২০১২ সালে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের শিববাড়ি পর্যন্ত এ উড়াল সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের ১৬ কিলোমিটার অংশের কাজ করছে চীনা ঠিকাদারি কোম্পানি সিজিজিসি।
উত্তরা থেকে গাজীপুরের শিববাড়ি পর্যন্ত অংশের কাজ করছে কোম্পানিটি। মাঝখানে হাউজ বিল্ডিং থেকে চেরাগ আলী পর্যন্ত অংশ নির্মাণের দায়িত্ব অন্য একটি ঠিকাদারি কোম্পানির।
এ প্রকল্পের কাজ তদারকের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাজ করছে এসএমইসি ইন্টারন্যাশনাল প্রোপাইটারি লিমিটেড অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস, যারা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে নিরাপত্তার ব্যাপক ঘাটতি দেখতে পায়।
নির্মাণ কাজের সময় পথচারী এবং যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার কথা তুলে ধরে গত ২৫ জুলাই সিজিজিসির প্রতিনিধি লু হুইকে চিঠি দেন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির টিম লিডার টিগ ম্যাকরিন।
ওই চিঠির একটি অনুলিপি এসেছে আমাদের হাতে।
বিআরটি প্রকল্পের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন ম্যানেজমেন্টের (ইপিসিএম) টিম লিডার টিক ম্যাকরিনের পাঠানো সেই চিঠিতে বলা হয়েছে, টঙ্গীর গাজীপুরা এলাকায় ইউটার্ন ১ এর এক নম্বর পিয়ারের জন্য গভীর গর্ত করা হয়েছে। ওই কাজ করার সময় সেখানে যেসব নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা পর্যাপ্ত না। সেখানে শুধু কয়েকটি ব্লক এবং সতর্কতামূলক টেপ দিয়ে জায়গাটি ঘিরে দেওয়া হয়েছিল।
চিঠিতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঠিকাদার কোম্পানিকে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এতে খনন এলাকায় প্রবেশ ঠেকাতে লোহার বার বা স্টিল শিটের মাধ্যমে প্রতিবন্ধক দেওয়া। ব্যারিকেড যেন ভালোভাবে দৃশ্যমান হয় সেজন্য তা হলুদ ও কালো রঙ করে দেওয়া। খনন করা জায়গা বেশি দিন ফেলে না রাখার তাগাদা দেওয়া হয়।
এছাড়া নির্মাণ এলাকায় যেখানে যানবাহন চলাচল করে সেখানে ডাইভারশন চিহ্ন-রোড মার্কিং করা, রাতের বেলা প্রয়োজনীয় সিগন্যাল বাতি, প্রতিফলক দেওয়া এবং যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ফ্ল্যাগম্যান এবং সিগন্যালম্যান রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল ওই চিঠিতে।
এসব বিষয়ে কথা বলতে লু হুইয়ের মোবাইল নম্বরে কল করা হলে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তিনি এখন চীনে অবস্থান করছেন।
সিজিজিসির প্রকল্প ব্যবস্থাপক লু’য়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, এ বিষয়ে কথা বলার উপযুক্ত ব্যক্তি তিনি নন।
এসব বিষয়ে ঢাকা বিআরটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুল বলেন, এ ধরনের আরও অনেক চিঠি ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখানে চিঠি দেওয়ার পাশাপাশি পরামর্শকের উচিত ছিল তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তারাও সেটা নেয়নি।
ঠিকাদারের দায় অবশ্যই আছে। তারা কোনোকিছুই মানছিল না। কিন্তু পরামর্শক শুধু চিঠিই দিয়ে যাচ্ছে। ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পুরো ক্ষমতা কনসালটেন্টকে দেওয়া আছে। এই ক্ষমতা বরং প্রকল্প পরিচালকের নাই।
‘যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার কারণে’ ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেড কী ব্যবস্থা নিয়েছে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রায় প্রতিটি বৈঠকেই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে তাগাদা দেওয়া হয়।
এ প্রকল্পের নির্মাণ সরঞ্জামের ইয়ার্ড টঙ্গীর গাজীপুরে। সেখানে ‘প্রিকাস্ট সেগমেন্ট’ বক্সগার্ডারগুলো বানানোর পর সেগুলো উত্তরার ওই এলাকায় নির্মাণ সাইটে এনে রাখা হয়। সেখান থেকে ট্রেইলরে করে গার্ডার নিয়ে পিয়ারের ওপর তোলা হয়।
সোমবারও একটি পিয়ারের ওপর বসাতে গার্ডারটি স্থানান্তরে ট্রেইলরের ওপর তোলা হচ্ছিল। তখনই প্রাণহানির এ মর্মস্পশী ঘটনা ঘটে। চাপা পড়ে প্রাইভেটকারে আটকা পড়েন পাঁচজন; গার্ডার সরিয়ে ও গাড়ি কেটে তাদের উদ্ধার করতেই লাগে তিন ঘণ্টা, ততক্ষণে তারা মারা যান।
চীনের তিনটি এবং বাংলাদেশের একটি কোম্পানি দীর্ঘদিন থেকে ওই সড়কে ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ানো এ প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে।
এর মধ্যে উড়াল সড়ক ও নিচের সড়ক নির্মাণের কাজ করছে (সিজিজিসি), জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এবং ওয়েহেই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কোপারেটিভ।
আর গাজীপুরে বিআরটির ডিপো নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে দেশি কোম্পানি সেল-ইউডিসি।
সোনালীনিউজ/এমটিআই