ঢাকা: ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে সরকার গঠনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরীকে একই মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে এ পদে নতুন নিয়োগ পেয়েছেন মোখলেসুর রহমান। তিনি প্রশাসন ক্যাডারের ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা। এর আগে গত ১৭ আগস্ট ৫ জনকে চুক্তিভিত্তিক সচিব নিয়োগ দেয় সরকার। তারাও প্রশাসন ক্যাডারের একই ব্যাচের কর্মকর্তা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জনপ্রশাসনে নতুন নিয়োগ মোখলেসুর রহমান ১৯৮৪ সালে বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেজারত ডেপুটি কালেকটর পদে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা পরিষদের সচিব, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানা নির্বাহী অফিসার, সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে কাজ করার পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ভোলা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর ইউরোপীয় কমিশন প্রকল্প, বিপিএটিসির পরিচালক পদে কাজ করার পর ২০০১ সালে বিএনপির শাসনামলে তিনি মৌলভিবাজার জেলা প্রশাসক হিসেবে আড়াই বছর দায়িত্ব পালন করেন।
[230752]
এরপর ২০০৬ সালে তিনি চট্রগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এবং ১/১১ এর সময় তাকে দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলে তাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়।
এর আগে গত ১৭ আগস্ট সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. এসকে আব্দুর রশিদ এর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ১৯৮২ ব্যাচের এই কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার, উপজেলা নির্বাহী অফিসার পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯২ সালে বিএনপির শাসনামলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগে সিনিয়র সহকারী সচিব পদে প্রায় দুই বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯৭ সালে বিপিএটিসিসি, সচিবের একান্ত সচিব, সিনিয়র সহাকারী সচিব পদে ২০০১ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ২০০৬ সাল পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক, ওয়াকফ জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১/১১ এর পর ২০০৯ এর জানুয়ারী পর্যন্ত তিনি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ও জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তাকে ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বদলী করা হয়।
[230751]
সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সিনিয়র সচিব এহছানুল হকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৯৮৩ সালে নোয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর সহকারী কমিশনার, উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, থানা নির্বাহী অফিসার, সিনিয়র সহকারী সচিব, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক হিসেবে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের পর বিএনপির শাসনামলে তিনি জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব, ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১/১১ এর সময়ে তিনি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জনপ্রশাসন সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পুরো প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৯৮২তম নিয়মিত ব্যাচের কর্মকর্তারা। দীর্ঘ ১৫ বছর পর অর্ন্তবর্তী সরকারে আবার সেই ৮২’র নিয়মিত ব্যাচের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ফিরে এসেছেন।
এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সচিব সুরাইয়া বেগম এই ব্যাচের মেধাতালিকায় ১৭৮তম হওয়ার পরও তিনি জ্যেষ্ঠ সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান। একই সঙ্গে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, আইএমইডি, পরিসংখ্যান বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ চারটি মন্ত্রণালয়-বিভাগে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিব হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছিলেন। এরপর অবসরে গিয়ে তথ্য কমিশনার হিসেবে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি হলে সুরাইয়া বেগম সচিব হতে পারতেন না। অথচ আট বছরে ছয়টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে রেকর্ড গড়েছেন তিনি।
[230759]
আবুল কালাম আজাদ বিদ্যুৎ, ইআরডি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সচিব ও মুখ্য সচিব ছিলেন। পরে তাকে চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কের পদ সৃষ্টি করা হয়। সর্বশেষ তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী তথ্য, শিক্ষা, জনপ্রশাসন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন।
মোজাম্মেল হক খান সড়ক ও রেলওয়ে, স্বরাষ্ট্র এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও জ্যেষ্ঠ সচিব ছিলেন। অবসরে যাওয়ার আগে পাঁচ বছরের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার করা হয়।
তারা সবাই ছিলেন ৮২’র ব্যাচের কর্মকর্তা এবং সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সদস্য। ফলে অলিখিত অনেক নিয়মে প্রশাসনের পদোন্নতি দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময় তারাই নানাভাবে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন। অভিযোগ রয়েছে, এই ব্যাচের কর্মকর্তাদের একক ভূমিকা থাকায় পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো ব্যাচেই মানা হয়নি মেধা ও জ্যেষ্ঠতার নিয়ম। এতে প্রশাসনজুড়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। বঞ্চিত হয়েছেন অনেক মেধাবী কর্মকর্তা। ফলে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিক্ষোভ করছেন বঞ্চিতরা। এখন প্রশাসনের শৃঙ্খলা ফেরানোই হবে চুক্তিতে নিয়োগ পাওয়া সচিবদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
এসআই/আইএ