ছাত্র আন্দোলনে নিহত পারভেজের মা

‘ছেলের কথা মনে পড়লে কান্না চলে আসে’

  • জামাল উদ্দিন বাবলু, লক্ষ্মীপুর | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২০, ২০২৪, ০৫:৫০ পিএম

লক্ষ্মীপুর: লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের ধন্যপুর গ্রামের মো. নবী উল্যা ও ফাতেমা বেগমের বড় ছেলে পারভেজ। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সে ছিলো সবার বড়। বাবা মানসিক রোগী হওয়ায় আর্থিক কারনে চতুর্থ শ্রেণিতেই পড়ালেখা শেষ হয়ে যায় তার। এরপর এলাকায় বিভিন্ন কাজকর্ম করে পরিবারের হাল ধরে পারভেজ। কিন্তু সেখানে কষ্টের চেয়ে উপার্জন কম আর অল্প বয়সেই পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে চলে আসায় মাত্র ১২ বছর বয়সে পাড়ি দিয়েছিলেন রাজধানীতে। সেখানে মিরপুর ১০ নম্বরের সেনপাড়ায় এলাকায় একটি থাই গ্লাসের দোকানে কাজ করতেন পারভেজ।

গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মিরপুর ১০ নম্বর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন পারভেজ। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই দিন রাতেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালের তার মাথায় অস্ত্রোপচার (অপারেশন) করা হয়। সেখানে ১ মাস ৮দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর মারা যান তিনি। সন্তান হারিয়ে এরপর থেকেই স্তব্ধ হয়ে গেছেন মা ফাতেমা বেগম। একমাত্র উপার্জণক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অর্ধাহারে-অনাহারে দিন কাটচ্ছে পরিবারটি।

[232431]

শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) পারভেজের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, কাঁচা মেঝে আর মরিচা ধরা ভাঙা টিনের জীর্ণ ঘরে নির্বাক বসে আছেন তার বাবা-মা। ছোট দুই ভাই এখনও বুঝে উঠতে পারেনি আর কখনো ফিরবেনা তাদের বড় ভাই। আদর করে টেনে নিবে না কাছে, রাখবেনা পরম মমতায় মাথায় হাত।

পারভেজের মা ফাতেমা বেগম সোনালীনিউজকে বলেন, আমার ছেলের বয়স যখন ১২ বছর, তখন সংসারের অভাব-অনটন দেখে সে ঢাকায় চলে যায়। সেখানে থাই গ্লাসের দোকানে কাজ করতো। তার টাকায় আমাদের সংসার ও ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখা চলতো। সে মারা যাওয়ায় পরিবারে আর কেহ উপার্জনের মতো রইল না। স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোন রকম ভাঙা ঘরে থাকি। এখন সংসার চলছে না। মানুষের সহযোগীতায় কোন রকম সংসার চলে। আমরা সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই যাতে আমি স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে বেঁচে থাকতে পারি। এবং দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে পারি। 

তিনি আরও বলেন, আমার স্বামী মানসিক ভারসাম্যহীন। বড় ছেলেটা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলো। তার মৃত্যুতে স্বামী-সন্তানদের নিয়া নিঃস্ব হয়ে গেলাম। পরিবারে আর কেহ উপার্জনের মানুষ না থাকায় স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের দেখাশোনার কেউ রইলো না। আমি এখন স্তব্ধ। ছেলের কথা মনে পড়লে কান্না চলে আসে।

নিহত পারভেজের বাবা নবী উল্যা মানসিক রোগী। গুছিয়ে কোন বিষয়ে কথা বলতে পারেন না তিনি। তারপরও এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, আমার ছেলেটা একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলো। গুলিবিদ্ধ হয়ে সে মারা গেছে। সে এই কোরবান ঈদে বাড়িতে আসার কথা ছিল। যদি বাড়িতে আসতো, তাহলে হয়তো মারা যাইত না।

পারভেজের বোন নাহিদা আক্তার সোনালীনিউজকে বলেন, আমার ভাই যখন গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালের আইসিউতে ভর্তি, আমি যখন তার সাথে দেখা করতে গেলাম। তাকে দেখলাম সে কথা বলতে পারে না। আমার হাত ধরে কথা বলার চেষ্টা করছিল। ইশারা দিয়ে কি বলতে চাইলো, আমি বুঝলাম না। আমার ভাইয়ের আয়েই আমাদের সংসার চলতো। তাকে হারিয়ে এখন আমরা নিঃস্ব।

[232426]

একই কথা বললেন পারভেজের চাচাতো ভাই আরাফাত হোসেন। সোনালীনিউজকে তিনি বলেন, পারভেজ বাড়ীতে আসলে আমার সাথে বেশি চলতো। সে যখন গত ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তখন তার সাথে দেখা করার ইচ্ছা ছিলো। কিন্তু দেখা আর হলো না। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যান। এই আক্ষেপটা সারাজীবন থেকে যাবে। তার রুজির উপর তাদের সংসার চলতো। এখন এই পরিবারটির হাল ধরবে, এমন কেউ নাই। তার বাবাও একজন মানসিক রোগী। 

চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বরত গ্রাম্য পুলিশ সাইফুল ইসলাম সোনালীনিউজকে বলেন, আমার চাকরি এই ওয়ার্ডে প্রায় ৯ বছর। আমি সবসময় দেখতাম তাদের অনেক অভাব-অনটন ছিলো। ছেলেটা অল্পবয়স থেকেই কাজ করতো। তার টাকায় সংসার চলত। তার বাবা একজন মানসিক রোগী, সে কাজকর্ম করতে জানে না। পারভেজ মারা যাওয়ার পর এলাকার লোকজন এবং স্থানীয় মেম্বার তাদের পরিবারকে সহযোগিতা করছে। এখন যদি সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসে ও সহযোগীতা করে তাহলে তারা উপকৃত হতো। 

উল্লেখ্য, গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় মিরপুর ১০ নম্বর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পারভেজ মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ওই দিন রাতেই ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস হাসপাতালের তার মাথায় অস্ত্রোপচার (অপারেশন) করা হয়। পরে দীর্ঘ ১ মাস ৮ দিন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে গত ১২ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় পারভেজ। ১৩ সেপ্টেম্বর শুক্রবার তার লাশ বাড়ীতে নিয়ে আসা হয়। জানাজার নামাজ শেষে দাফন করা হয় বাড়ির পাশের কবরস্থানে।

এসএস