বিতর্ক এড়াতে পারছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

  • নিজস্ব প্রতিবেদক:  | সোনালী নিউজ
  • প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২৪, ০৭:৫৬ পিএম

ঢাকা: ছাত্র জনতার গণঅভ্যত্থানের পর জনপ্রশাসনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদায়ন নিয়ে নজির বিহীন ঘটনা ঘটে। তিন দফায় ৫৯ জেলায় ডিসি নিয়োগের পর সমালোচনার মুখে ৯ জেলা থেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পতিত হাসিনা সরকারের বৈষ্যমের শিকার বঞ্চিত কর্মকর্তাদের হাতে লাঞ্চিত হন যুগ্মসচিব পদমর্যাদার দুই কর্মকর্তা। 

এই ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার আগেই আরেক কর্মকর্তার রুমে তিন কোটি টাকার চেক পাওয়ার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনারও তদন্তে কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এভাবেই একের পর এক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। 

[232857]

প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে শেখ হাসিনার আস্থাভাজন কর্মকর্তারই বহাল থাকায় এমন ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগ আমলে টানা ১৫ বছর ধরে বঞ্চিত মেধাবী ও যোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি এবং পদায়নের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে জেলা প্রশাসক নিয়োগের জন্য যাচাই বাছাই শুরু করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তিন দফায় ৫৯ জেলায় ডিসি পদায়ন করা হয়। পদায়ন পাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে ২/৩ জন ছাড়া বাকী সবাই পতিত স্বৈরাচারী সরকারের সুবিধাভোগী। ঐ সরকারের মন্ত্রী-সচিবের পিএসসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ব্যাপক যাচাই-বাছাই করে ফিটলিস্ট তৈরির পরও ডিসি পদে বিগত সরকারের সুবিধাভোগী ও আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তারা কী করে নিয়োগ পেলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে জনপ্রশাসনে। 

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে বিতর্কিত করতে এবং বেকায়দায় ফেলতে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে থাকা শেখ হাসিনার আস্থাভাজন কর্মকর্তারই এমন বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে।

[232838]

আওয়ামী সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তা মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুবুর রহমান। শেখ হাসিনার অনুগত হওয়ায় এই কর্মকর্তাকে নিয়মিত চাকুরীর পর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তাদের মধ্যে আস্থাভাজন কর্মকর্তা হওয়ায় প্রথমে সচিব পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিমকে। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করা পরিক্ষীত জাহাঙ্গীর আলম রয়েছেন পরিকল্পনা কমিশনের সচিব হিসেবে। এর আগে তিনি সমাজকল্যাণ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। পতিত সরকারের প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক, নরসিংদী ও ফরিদপুরের জেলাপ্রশাসক, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক এবং আইডিয়াল কলেজের ৪০০ কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা আবু হেনা মোরশেদ জামান আছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হিসেবে। তার মন্ত্রণালয়ে পূর্ণবাসন করেছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও যশোরের ডিসি তমিজুল ইসলাম খানকে। 

স্বৈরাচারী সরকারের জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি সালমা চৌধূরীর স্বামী সোলেমান খান আছেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) হিসেবে। বিপুল অর্থপাচারে অভিযুক্ত সাবেক জ্বালানী ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর সহযোগী হাবিবুর রহমান রয়েছেন বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হিসেবে। মৌলভীবাজারের সাবেক ডিসি ও চট্রগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ হল সভাপতি কামরুল হাসান রয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে। ২০১৪ সালে সাতক্ষীরায় জামায়াত কর্মীদের নিপীড়নের কুশীলব নাজমুল আহসান রয়েছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক ও রংপুরের সাবেক ডিসি, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ ও সাবেক মেয়র ফজলে নুর তাপসের ঘনিষ্ট ফরিদ আহম্মদ রয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে।

[232767]

শেখ হাসিনার সাবেক এপিএস কাজী নিশাত রসুল এর বোন কাজী তুহিন রসুল রয়েছেন রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে। সাবেক সচিব ও গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের ঘনিষ্ট সহযোগী অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সিরাজুন নুর চৌধুরী, দিলরুবা শাহীন, যুগ্ম সচিব মেহেদী মাসুদুজ্জামান। বহাল তবিয়তে থেকে অর্থ বিভাগে কোন অফিসার আসবে, কে কোথায় পদায়িত হবেন এখনও নিয়ন্ত্রণ করছেন এই কর্মকর্তারা। 

ভোটারবিহীন নির্বাচনের গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাঙ্গীর আলমকে সরকার বাধ্যতামূলক অবসর দেয়। তার ঘনিষ্ট সহযোগী একান্ত সচিব একেএম সাইফুল আলম বহাল তবিয়তে আছেন জননিরপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের পিএস এর মত সংবেদনশীল জায়গায়। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. সারোয়ার বারী। নিজের একান্ত সচিব হিসেবেও নিয়োগ দিয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাহিদ হাসানকে। যিনি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ-এর সাথে সচিবালয়ে ঘোরাঘুরি করে তার তদবির বাণিজ্যে সহায়তার করতেন। এই প্রভাব খাটিয়ে তার স্ত্রী আকতারুন্নেসাকেও পদায়ন করেছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের মত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে।

স্বৈরাচার সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী গ্রেপ্তার হলেও বহাল তবিয়তে আছেন দশ বছর তার একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করা মাশুকুর রহমান সিকদার। ঐ পদে থাকাকালীন বাজার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করে মন্ত্রীর সাথে ভাগাভাগি করে হাজার কোটি টাকা কামিয়ে বিদেশে পাচার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। নাটোরের সাবেক ডিসি, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, এরপর পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব হিসেবে কাজ করা মশিউর রহমান রয়েছেন সুরক্ষা ও সেবা বিভাগের সচিব হিসেবে। গোপালগঞ্জের সাবেক ডিসি মোখলেসুর রহমানের স্ত্রী রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান এর বোন তানজিয়া সালমা রয়েছেন ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার হিসেবে।

নিয়োগ ও পদোন্নতি নিয়ে জটিলতা সৃষ্টির পেছনে সরকারের একজন উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মহাপরিচালক আহসান কিবরিয়া সিদ্দীকীকে দায়ী করেছেন ক্ষুব্ধ কর্মকর্তরা। 

বঞ্চিত কর্মকর্তারা বলছেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতন হলেও প্রশাসনের সর্বস্তরে তার সরকারের সুবিধাভোগীদের পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন অব্যাহত রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। এই পুরো প্রক্রিয়ার কলকাঠি নেড়েছেন অর্ন্তবর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা। এর আগেও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিগত সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের পুনর্বাসনের অভিযোগ উঠে ওই উপদেষ্টার বিরুদ্ধে। তিনিই যোগ্য, মেধাবী ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রদানে শুরুতেই বাধা হয়ে দাঁড়ান। 

শুধু তা-ই নয়, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নিযুক্ত মন্ত্রিপরিষদ সচিব, জনপ্রশাসন সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীনদের সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি ছিল তার। আওয়ামী লীগ আমলে সাজানো প্রশাসনে কোনো ধরনের পরিবর্তনে সম্মত ছিলেন না তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত নানা চাপের কারণে কয়েকদিন পর এসব পদে রদবদল আনা হয়। 

২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালে রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালে ডামি নির্বাচনে সহায়তাকাকারী ইউএনও, ডিসি, এসপি ও বিভাগীয় কিমিশনারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের পুনরায় পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়নের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন তিনি। সর্বশেষ ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া তালিকায় সেটি ফুটে ওঠেছে।

এসআই/আইএ