ঢাকা : আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা অনিশ্চিয়তায় শ্লথ হয়ে পড়েছিল সর্ববৃহৎ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী জাতীয় পেনশন স্কিম।
তবে নতুন অন্তর্বর্তী সরকারের ইতিবাচক বার্তা পাওয়ার পর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিগত সরকারের আলোচিত এই প্রকল্পে আবারও গ্রাহকের আস্থা ফিরে আসতে শুরু করছে বলে জানিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।
কর্তৃপক্ষের সদস্য (ফান্ড ম্যানেজমেন্ট) গোলাম মোস্তফা বলেন, গত ৫ অগাস্টের পরে অনেকে হয়তো মনে করেছিল যে, এই স্কিম থাকবে কি থাকবে না, আমি আর টাকা দেব না। এজন্য কিছু ডিফল্টিং কেইস হয়েছিল। কিন্তু আমরা যখন আবার গিয়ে বললাম যে, নতুন সরকার এই কর্মসূচি চালাবে, তখন গ্রাহকদের আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি কেটে যাওয়া শুরু হয়েছে।
সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে আর্থিক নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসতে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দীর্ঘ প্রস্তুতি শেষে গতবছরের ১৭ অগাস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার।
শুরুতে ‘প্রবাস’, ‘প্রগতি’, ‘সুরক্ষা’ ও ‘সমতা’ স্কিম চালু করা হয়েছিল। গত জুলাইয়ে সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘প্রত্যয়’ স্কিম চালু করতে গিয়ে ধাক্কা খায় কর্তৃপক্ষ। অংশীজনদের বিরোধিতার মুখে ওই প্যাকেজ চালু করা যায়নি।
গোলাম মোস্তফা বলেন, এটা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অংশ। আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রয়োজন সব সময় রয়েছে। সুতরাং এই কর্মসূচি কখনও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। জাতীয় পেনশন কর্মসূচি আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান। এটা একটি রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি। সুতরাং এটা কোনোভাবেই স্থবিরও হবে না।
[235570]
পরিস্থিতি কতটা খারাপ হয়েছিল?
পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা বলেন, গত ৫ অগাস্টের পর সদস্যদের চাঁদা জমা দেওয়ার পরিমাণ একেবারেই কমে গিয়েছিল। কিন্তু সেটাকে আমরা কোনো সমস্যা মনে করছি না। কারণ, এমন পরিস্থিতিতে এটা হতেই পারে। আমরা নিজেরাও এক ধরনের অনিশ্চিয়তার মধ্যে ছিলাম।
চাঁদার টাকা বিলম্বে দেওয়ার নিয়ম পেনশন স্কিমেই রয়েছে। যারা অনিশ্চিয়তার কারণে চাঁদা দেননি তারা ইতোমধ্যেই দুই মাসের টাকা একসাথে দেওয়া শুরু করেছেন। এটা আমরা কোনো সমস্যা মনে করছি না।
নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রবণতা কেমন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে একটা বড় ধরনের ধাক্কা এসেছে। গত জুন মাসেও দৈনিক ৫ হাজারের মতো নতুন লোক পেনশন স্কিমে যুক্ত হচ্ছিলেন। জুলাই মাসে আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তা কমতে শুরু করে। অগাস্টে সরকার পতনের পর প্রায় এক মাস ধরে নতুন এনরোলমেন্ট ড্রাস্টিকভাবে কমে যায়। তবে এখন আর সেই পরিস্থিতি নেই। এখন নতুন লোক যুক্ত হওয়ার পরিমাণ বাড়তে শুরু করেছে।
[235568]
নতুন কী থাকছে
গতবছর পেনশন স্কিম চালু হওয়ার পরই অনেক আগ্রহ নিয়ে এখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন আইনজীবী নাহিদা জাহান। ভবিষ্যতের সঞ্চয় বাড়াতে সরকারি এই সেবায় যুক্ত হলেও এখানে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা থাকা উচিত বলে মনে করছেন তিনি।
নাহিদা বলেন, এই পেনশন স্কিমের বড় একটা দুর্বলতা হচ্ছে এখানে বীমা সুবিধা নেই। দেশে প্রচলিত অনেক ডিপোজিট স্কিমে বীমা সুবিধা রয়েছে। পেনশন স্কিমে বীমা সুবিধা চালু করলে তাতে জনগণের আগ্রহ আরও বাড়বে।
পাশাপাশি গ্রাহকের মৃত্যুর পর নমিনির জন্য ৭৫ বছর বয়সের যে সীমা রাখা হয়েছে তা আমৃত্যু করে দেওয়ার দাবিও জানান নাহিদা।
অর্থসচিব খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সরকারের পরিকল্পনা হচ্ছে জাতীয় পেনশন স্কিমের বর্তমান কর্মসূচিগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেজন্য সময়ে সময়ে আরও কোনো সুযোগ-সুবিধা যোগ করা যায় কিনা সেটা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখবে।
গত ১৭ অগাস্ট পর্যন্ত এক বছরে জাতীয় পেনশন স্কিমে যুক্ত হয়েছেন তিন লাখ ৭২ হাজার ৪০১ জন। এদের মোট জমা টাকার পরিমাণ ১৩১ কোটি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ করা হয়েছে ১২৪ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। বাকি টাকাও কিছুদিনের মধ্যে বিনিয়োগ করা হচ্ছে।
স্কিমের ভবিষ্যৎ
স্থগিত ‘প্রত্যয়’ স্কিম সম্পর্কে গোলাম মোস্তফা বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী সংখ্যা ১৪ লাখ। স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে তিন থেকে চার লাখ। এই মানুষগুলোর বাইরেও বাংলাদেশে ১৮ কোটি জনগণ রয়েছে।
২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষকে আমরা প্রত্যয় স্কিমে আনতে চেয়েছিলাম। কারণ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন সরকারের কোষাগারে বড় ধরনের একটা বার্ডেন হচ্ছে। এই বার্ডেনটা শিফট করতে চেয়েছিলাম। ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষের জন্য এখন ব্যয় ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। জনমত যাচাই করতে গেলে দেখা যাবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এই বাড়তি সুবিধা টিকবে না। আমরা থাকি আর না থাকি কোনো না কোনো সময় এটা হতেই হবে, এটা মাস্ট।
[235550]
আর অর্থসচিব বলছেন, সরকার আপাতত নতুন কোনো স্কিমের কথা ভাবছে না। চলমান স্কিমগুলো সফল হলে ভবিষ্যতে নতুন স্কিম নিয়ে ভাবা হবে।
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর নতুন সরকার বিগত দিনের এই প্রকল্পকে কীভাবে নিচ্ছে জানতে চাইলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য গোলাম মোস্তফা গোলাম মোস্তফা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টার সঙ্গে ইতোমধ্যে আমাদের সভা হয়েছে। ১৪ অক্টোবর প্রথম বোর্ড সভা হয়েছে। বর্তমান সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে এই পেনশন স্কিম চলমান রাখা।
নতুন সরকার আসার পর কোনো ধরনের সংস্কার আনা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকারের কাছ থেকে যে ধরনের নির্দেশনা পাব আমরা সে অনুযায়ী কাজ করব। জনসাধারণকে আকৃষ্ট করার জন্য এই স্কিমগুলোতে আর কী সুযোগ-সুবিধা যোগ করা যায় সেটা খুঁজে বের করার কথা আমাদের বলা হয়েছে।
আমরা এখন এমন কিছু করব না, যাতে আগে যারা যুক্ত হয়েছে তাদের কোনো সুযোগ-সুবিধা কমে। যারা আগে যুক্ত হয়েছে তাদেরকে বলা হবে যে, এই পরিবর্তন এসেছে। গ্রাহকদের নতুন সংস্করে কিংবা আগের সংস্করণে থাকার সুযোগ থাকবে।
সম্পূর্ণ দেশীয় পরিকল্পনায় সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হওয়ার তথ্য জানিয়ে প্রকল্পের শুরু থেকে যুক্ত থাকা এই কর্মকর্তা বলেন, বিদেশি দাতা সংস্থাও এই পেনশন স্কিমে সহযোগিতা করতে এগিয়ে এসেছে। এডিবি সহায়তা দেওয়ার জন্য আমাদের কাছে এসেছে। তারা প্রকল্প সহায়তা দিতে চায়। ইতোমধ্যে তারা দুইজন আইটি কনসালটেন্ট যুক্ত করেছে। অধিকাংশ উন্নয়ন সহযোগী এই স্কিমের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়।
রাজধানীর বনশ্রীর গৃহিনী নিগার সুলতানা বলেন, ভবিষ্যতের জন্য কিছু টাকা জমাতে নির্ভরযোগ্য উপায় খুঁজছেন তিনি। কিন্তু সরকার যে এই ধরনের স্কিম চালু করেছে সে সম্পর্কে তিনি আগে জানতে পারেননি।
পেনশন কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি সোশাল মিডিয়া ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার চালানোর একটি পরিকল্পনা তারা হাতে নিয়েছে।
এমটিআই